ডেস্ক রির্পোট:- রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (রুয়েট) প্রায় সাড়ে ৪ কোটি টাকার রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারকাজের গোপনীয় প্রাক্কলিত দর নির্দিষ্ট কয়েকজন ঠিকাদার আগেই জেনে গেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ওই ঠিকাদাররা প্রাক্কলিত দর থেকে ৯ শতাংশের ওপরে এবং ১০ শতাংশের নিচে ছাড় দিয়ে প্রাথমিকভাবে চূড়ান্ত হওয়ায় এই সন্দেহের সৃষ্টি হয়। কেননা গোপনীয় প্রাক্কলিত দর না জেনে শুধু ধারণার ওপর ভিত্তি করে ১০ শতাংশ ছাড়ের (নিচে) কাছাকাছি দর দেওয়া প্রায় অসম্ভব বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
যদিও দরপত্র খোলার আগে সংশ্লিষ্ট কাজগুলোর গোপনীয় প্রাক্কলিত দর শুধু উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন দপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. জগলুল শাদত এবং প্রধান প্রকৌশলী ইঞ্জিনিয়ার মো. শাহাদত হোসেন জানতেন বলে জানা গেছে। ফলে এ ঘটনায় এই তিন কর্মকর্তার দিকেই অভিযোগের তির উঠেছে।
জানা যায়, গত বছরের ২০ আগস্ট রুয়েটের নতুন উপাচার্য হিসেবে যোগদান করেন অধ্যাপক ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম। তিনি চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। রুয়েটের দায়িত্ব নিয়েই তিনি এই ক্যাম্পাসের শিক্ষা, প্রশাসনিক ও উন্নয়ন অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে সবাইকে একটি পরিবারের মতো ঐক্যবদ্ধভাবে নিজ নিজ দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালনের আহ্বান জানান। কিন্তু তার মেয়াদে প্রথম কোনো বড় কাজ শুরু হতেই গোপনীয় প্রাক্কলিত দর আগেই পছন্দের ঠিকাদারকে জানিয়ে দিয়ে কাজ পাইয়ে দেওয়ার গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। এতে একদিকে রুয়েটের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা হতাশা প্রকাশ করেছেন, অন্যদিকে বঞ্চিত ঠিকাদাররা চরম ক্ষুব্ধ হয়েছেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, রুয়েটের আটটি ভবনের রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারকাজের জন্য গত ২৮ জানুয়ারি পৃথক পৃথক দরপত্র আহ্বান করা হয়। দরপত্রগুলো খোলা হয় গত ১৩ ফেব্রুয়ারি। এতে দেখা যায়, পাঁচটি কাজের প্রাক্কলিত দর থেকে ১০ শতাংশের কাছাকাছি ছাড় দিয়ে দরপত্র জমা দেয় পাঁচটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ফলে ই-জিপির নিয়ম অনুযায়ী সেই পাঁচটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ৪ কোটি ৩৬ লাখ ৬ হাজার ৫০৯ টাকার কাজের জন্য প্রাথমিকভাবে চূড়ান্ত হয়।
এর মধ্যে শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান হলের ১ কোটি ৭২ লাখ ১৯ হাজার ৮১৮ টাকার কাজের জন্য প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হয় মেসার্স রোজেলীন ট্রেড; টিনশেড হলের ১ কোটি ১৪ লাখ ৩৮ হাজার ৯৫২ টাকার কাজে নির্বাচিত হন মো. আব্দুল মান্নান; একাডেমিক ভবনের ৪৭ লাখ ৮৬ হাজার ৮৭৭ টাকার কাজে নির্বাচিত হয় মেসার্স আরিফ অ্যান্ড কোং; একাডেমিক ভবন-১ (সিএসই)-এর ৩৪ লাখ ৪৫ হাজার ৮২৫ টাকার কাজে নির্বাচিত হয় জারা কনস্ট্রাকশন এবং একাডেমিক ভবন-৩-এর ৩৪ লাখ ৭৫ হাজার ৩৭ টাকার কাজে নির্বাচিত হয় মেসার্স আব্দুল গনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
কাজগুলো পেতে প্রাক্কলিত দর থেকে ৯ দশমিক ৯১৯ শতাংশ ছাড়ে দরপত্র জমা দেয় মেসার্স রোজেলীন ট্রেড; মো. আব্দুল মান্নান দেয় ৯ দশমিক ৫১৯ শতাংশ; মেসার্স আরিফ অ্যান্ড কোং ৯ দশমিক ৭১৫ শতাংশ; জারা কনস্ট্রাকশন দেয় ৯ দশমিক ৮৮৯ শতাংশ এবং মেসার্স আব্দুল গনি দেয় ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এ ছাড়া বাকি তিনটি কাজের জন্য ৯ শতাংশের কাছাকাছি ছাড় দিয়ে দরপত্র জমা দিয়ে প্রাথমিকভাবে চূড়ান্ত হয়েছে অন্য ৩ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে মো. শিহাব উদ্দিন ৮ দশমিক ৮৯ শতাংশ, খালেদ মোহাম্মদ সেলিম ৮ দশমিক ৭৪ এবং রিথিন এন্টারপ্রাইজ ৮ দশমিক ৭০ শতাংশ ছাড়ে দরপত্র জমা দিয়ে সর্বোচ্চ নিম্নদরদাতা হিসেবে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হয়।
উল্লেখ্য, আইন অনুযায়ী সরকারি বিভিন্ন কাজের দরপত্রে (টেন্ডার) প্রাক্কলিত ব্যয় ১০ শতাংশের বেশি কমানো যাবে না, একইভাবে ১০ শতাংশের বেশি বাড়ানো যাবে না। ফলে দরপত্রে ১০ শতাংশের ভেতর ছাড় দিয়ে আবেদন করতে হয়। এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ছাড়দাতাকে কাজ দেওয়া হয়।
ঠিকাদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রাক্কলিত দর থেকে ৯ শতাংশের ওপরে ছাড় দিয়ে ৪ কোটি ৩৬ লাখ ৬ হাজার ৫০৯ টাকার পাঁচটি কাজে যারা চূড়ান্ত হয়েছেন তারা অবশ্যই গোপনীয় দর জেনে দরপত্র জমা দিয়েছেন। কেননা শুধু ধারণার ওপর ভিত্তি করে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশের ওপরে ছাড় দিয়ে দরপত্র জমা দেওয়া প্রায় অসম্ভব। অথচ এখানে ৯ দশমিক ৯১৯ শতাংশ ছাড়ে দরপত্র জমা পড়েছে, যা অবিশ্বাস্য।
দরপত্রে অংশ নেওয়া ঠিকাদার আমিনুর রহমান খান রুবেল বলেন, ‘শুধু ধারণার ওপর ভিত্তি করে ১০ শতাংশের কাছাকাছি দর দিয়ে টেন্ডার জমা দেওয়া অসম্ভব। রুয়েটের ভিসি বা চিফ ইঞ্জিনিয়ার যদি তাদের অফিসের কোনো ইঞ্জিনিয়ারকে দায়িত্ব দেন, এমনকি চিফ ইঞ্জিনিয়ারকেও যদি দায়িত্ব দেওয়া হয় তিনিও পারবেন না। তারা যদি ৯ দশমিক ৮০ শতাংশ ছাড়ে দরপত্র জমা দিতে পারেন, তাহলেই কেবল বলব এটা লিগ্যাল হয়েছে।’
ঠিকাদার আলিমুল হাসান সজল বলেন, ‘আমি নিজেও ওই টেন্ডারে অংশ নিয়েছিলাম। কিন্তু রাজশাহীর বাইরে থাকায় সঠিক তথ্য জানি না। তবে দরপত্রের শিডিউল যেভাবে করা ছিল তাতে এত কাছাকাছি দর মেলানো সো টাফ, এমনকি প্রায় অসম্ভব। এটা হওয়া মুশকিল।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঠিকাদার বলেন, ‘রুয়েটের টেন্ডারে অনিয়মের বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে উপাচার্য অবশ্যই অবগত আছেন। এই অনিয়মের বিষয়ে তার পদক্ষেপেই বোঝা যাবে তিনি জড়িত আছেন কি না।’
টেন্ডারের দর ফাঁসের বিষয়ে জানতে চাইলে রুয়েটের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন দপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. জগলুল শাদত বলেন, ‘দরপত্রের গোপনীয় তথ্য জানা একেবারে অসম্ভব ব্যাপার। কেননা এটা একটা নির্দিষ্ট আইডি থেকে করা হয়। তার পরও বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি। অসামঞ্জস্য কিছু পেলে আমরা রি-টেন্ডারের সিদ্ধান্ত নিতে পারি।’
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমি শুধু দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সদস্য। আমার কাছে এখনো কোনো রিপোর্ট আসেনি। এলে তা বিশ্লেষণ করে অসামঞ্জস্য মনে হলে আমরা মূল্যায়ন কমিটি থেকে রি-টেন্ডারের সুপারিশ করে দেব।’
১০ শতাংশের কাছাকাছি ছাড়ে দর জমা দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে রুয়েটের প্রধান প্রকৌশলী ইঞ্জিনিয়ার মো. শাহাদত হোসেন বলেন, ‘এটা অসম্ভব বলব না। তবে একেবারে কাছাকাছি যাওয়া কঠিন হয়। কারণ শিডিউলের আইটেম কোড দেওয়া থাকে। গোপনীয় প্রাক্কলিত দর শুধু আমি জানি এমনটা না। পিপিআর অনুসারে এখানে তিনজনের একটা এস্টিমেট কমিটি আছে, ওই কমিটির সবাই দরটা জানে। তবে আপনারা যেটা (দর ফাঁস) সন্দেহ করছেন, আমরাও সেটা আশঙ্কা করছি। এটা পরবর্তীতে যাচাই-বাছাই করে দেখব। প্রমাণিত হলে টেন্ডার বাতিল করতে পারি।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে রুয়েট উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। পরিচয় দিয়ে এসএমএস পাঠানো হলেও তিনি কোনো সাড়া দেননি। পরে গতকাল বেলা ৩টার দিকে জাহাঙ্গীর আলমের দপ্তরে গিয়েও তার খোঁজ মেলেনি। ফলে এ বিষয়ে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। খবরের কাগজ