নতুন বাংলাদেশ, গণতান্ত্রিক উত্তরণে সংকট

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০২৫
  • ১৫ দেখা হয়েছে

ডেস্ক রির্পোট:- বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক উত্তরণে উভয় সংকট। নির্বাচনকে সামনে রেখে এখানে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতিশ্রুত সংস্কারের জন্য। ক্ষমতা ছেড়ে পালানো সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়েছে ভারত। তারা এখনো আওয়ামী লীগপন্থি অবস্থানে। ফলে বাংলাদেশে ভারতবিরোধী সেন্টিমেন্ট বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে ক্ষমতাকে সামনে রেখে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও ক্ষমতার অংশীদার হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় থাকা অন্যদের মধ্যে সংকট দেখা দিচ্ছে। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক উত্তরণে যে সংকট চলছে তার প্রেক্ষিতে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও তাদের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর করণীয় কি হতে পারে তা জোরালোভাবে তুলে ধরে গতকাল ৭ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ব্রাসেলসভিত্তিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি)। এটি একটি নিরপেক্ষ সংগঠন। কাজ করে যুদ্ধ প্রতিরোধ নিয়ে। আইসিজি’র রিপোর্টের শিরোনাম- বাংলাদেশ: দ্য ডিলেমাস অব এ ডেমোক্রেটিক ট্রানজিশন।

এতে বলা হয়েছে, সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ছয় মাসেরও কম সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার নতুন নির্বাচনের সময় ঘোষণা করেছে। তারা বলেছে, ২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে হবে এই নির্বাচন। এই সরকারের নেতৃত্বে আছেন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তার নেতৃত্বাধীন সরকার এবং এর সমর্থকরা আশা করেন, এই নির্বাচন শুধুই গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার নির্বাচন হবে না। একই সঙ্গে ১৫ বছর ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদী এবং নিষ্পেষণকারী শাসনের পরে দেশের রাজনীতিতে একটি নতুন যুগের উদয় হবে। শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগ দলীয় নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিল বেশির ভাগ রাষ্ট্রীয় যন্ত্র। সংবিধান, নির্বাচনী ব্যবস্থা, প্রশাসন ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সংস্কারের সুযোগ করে দিয়েছে এর মধ্যদিয়ে। হাসিনার পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার যে একচেটিয়া সমর্থন পেয়েছিল, তা আস্তে আস্তে ক্ষয়ে যেতে শুরু করেছে। ড. ইউনূস এখন সুদৃঢ় ফলাফল দেয়ার চাপ মোকাবিলা করছেন। অন্য রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে ফাটল মেরামতের জন্যই শুধু তার সরকার চেষ্টা করছে না। একই সঙ্গে দিনের পর দিন ব্যবস্থাপনা নিয়ে জনগণের সমালোচনাও মোকাবিলা করছে। আগামী বছর এই চ্যালেঞ্জ আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। কারণ, বিরোধী দলগুলো, ছাত্রনেতারা, ইসলামপন্থি গ্রুপগুলো এবং অন্য গুরুত্বপূর্ণ পক্ষ নির্বাচনে সুবিধা নিতে চাইছে। বিশাল প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক উত্তেজনাপূর্ণ। এর কারণ, শেখ হাসিনার রেজিমের শেষ পর্যন্ত তাদের দৃঢ়ভাবে সমর্থন দিয়েছে। সেটা স্থিতিশীলতার জন্য আরও বড় বাধা হয়ে উঠেছে। উপরন্তু কমপক্ষে ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর ব্যবস্থাপনা ও যুদ্ধবিধ্বস্ত মিয়ানমারের সঙ্গে অস্থিতিশীল সীমান্ত অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে বোঝা হয়ে আছে। এসব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও ইউরোপকে বিরল সুযোগ এনে দিয়েছে বাংলাদেশ। তা হলো বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণ এবং গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অংশীদারকে সমর্থন করা। এটা এ অঞ্চলে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব। বাংলাদেশকে সমর্থন করতে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং এর সদস্য রাষ্ট্রগুলো কি কি সহযোগিতা করতে পারে তার কিছু সুপারিশ তুলে ধরেছে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ। এক্ষেত্রে বলা হয়েছে- বাংলাদেশে উচ্চ পর্যায়ের সফর করতে হবে। ড. ইউনূসের সরকারের সংস্কার কার্যক্রমে জোরালো সমর্থন অব্যাহত রাখতে হবে। এটা করতে হবে এ জন্য যে, তাতে দেশের ভেতরে ইউনূস প্রশাসনের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে এবং যেসব শক্তি তাকে খর্ব করার চেষ্টা করছে তাদের শক্তি দুর্বল হবে। একই সঙ্গে একটি নতুন পার্টনারশিপ অ্যান্ড কো-অপারেশন এগ্রিমেন্টের বিষয়ে অব্যাহতভাবে সংলাপ চালিয়ে যাওয়া উচিত ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের। অন্তর্বর্তী সরকারের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারে প্রযুক্তিগত ও আর্থিক সমর্থন দেয়া উচিত। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন বিভিন্ন ক্ষেত্রে এমন সহযোগিতা করতে পারে। এর মধ্যে আছে মূল প্রতিষ্ঠাগুলোকে শক্তিশালী করা, সুশাসনকে উন্নত করা এবং মানবাধিকার সুরক্ষিত রাখা। নির্বাচন মনিটরিং করতে একটি নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী মিশন পাঠানো উচিত হবে। এতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশে অধিক পরিমাণ আর্থিক সমর্থন দেয়ার জন্য আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ইউরোপ তার প্রভাব ব্যবহার করে জাতীয় অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করায় অবদান রাখতে পারে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। এ জন্য বৈদেশিক বিনিয়োগের জন্য অধিক আকর্ষণীয় পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়তা করতে পারে ইউরোপ- যেটা হতে পারে অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য একটি অগ্রাধিকার। তৈরি পোশাক খাত থেকে অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে আরও অনেক উদ্যোগে সহায়তা করা যেতে পারে। দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিবর্গ এবং কর্মকর্তাদের সঙ্গে সম্পর্ক আছে এমন সব সম্পদ পুনরুদ্ধারে সহায়তা করতে পারে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। একই সঙ্গে ২০২৯ সালের পরেও ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশের অগ্রাধিকারমূলক সুযোগ বিস্তৃত করতে ঢাকার সঙ্গে অব্যাহতভাবে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া উচিত।

এতে বলা হয়, বাংলাদেশে সংস্কারে আরও বেশি সমর্থন পাওয়ার ক্ষেত্রে ঢাকা ও নয়াদিল্লির মধ্যে উত্তেজনাকে সীমিত করার কাজ করা উচিত। এক্ষেত্রে ২০২৫ সালে পরিকল্পিত ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের উচ্চ পর্যায়ের যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে তা করা যেতে পারে। ভালো সম্পর্কের জন্য পরস্পরের মধ্যে অনাস্থা ও সম্পর্ক পরিবর্তনে নিজের প্রভাব ব্যবহার করা উচিত ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের। বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী ও তাদেরকে আশ্রয়দানকারী বাংলাদেশ- উভয়কে মানবিক সহযোগিতা হিসেবে অর্থের যোগান দেয়া উচিত। এটা করা উচিত এমন এক সময়ে, যখন রোহিঙ্গা সংকট ইস্যুতে জাতিসংঘের উচ্চ পর্যায়ের কনফারেন্স হওয়ার কথা- তাতে সমর্থন দেয়া উচিত। এর জন্য ঢাকা এরই মধ্যে তদবির করেছে। একই সঙ্গে মিয়ানমার সীমান্ত জুড়ে আরাকান আর্মির সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারকে যোগাযোগ করার ক্ষেত্রে উৎসাহিত করা উচিত।

ওই রিপোর্টে ক্রাইসিস গ্রুপ আরও লিখেছে, আগস্টের শুরুতে লাখো বিক্ষোভকারী পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাসভবনের খুব কাছে চলে যাওয়ায় তিনি বাংলাদেশ থেকে পালিয়েছেন। মোটামুটি এক মাস আগে এই বিক্ষোভ শুরু হয়। সরকারি চাকরিক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থাকে সামনে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এই আন্দোলন, বিক্ষোভ শুরু করেন। তাদের আন্দোলনকে নৃশংসতা ব্যবহার করে দমন করার চেষ্টা করেছেন হাসিনা। তার শাসন নিয়ে ভয়াবহ অসন্তোষের মধ্যে এই প্রতিবাদ বিক্ষোভ গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়, যার করণে তাকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়। তার পতন বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। কিন্তু তাতে দেখা দেয় অনিশ্চয়তা। কারণ, দেশটিতে আছে বিভক্তি, অনেক সময় রাজনৈতিক সহিংসতা হয়। সেনাবাহিনী, ছাত্র নেতৃত্ব এবং প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো প্রফেসর ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করে। এতে আছেন ছাত্র, নাগরিক সমাজের ব্যক্তিত্ব, সাবেক সরকারি কর্মকর্তা ও বাহিনীর বিভিন্ন কর্মকর্তা। অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে দেশে এবং বিদেশে ড. ইউনূসের কমান্ডকে দেখা হয় অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে। তিনি রাজনৈতিক সংস্কারের উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রতি সমর্থন পান। মূল রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে তিনি ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু একসময় হাসিনার উৎখাতে ড. ইউনূসের প্রশাসনের প্রতি ব্যাপক সমর্থন দেখা গিয়েছিল। কিন্তু এখন সেই ‘হানিমুন’ শেষ। শুধু সংস্কার করার জন্য নয়, একই সঙ্গে দিন দিন সুশাসন উন্নয়নের ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান চাপে সরকার। নতুন জাতীয় নির্বাচন এখন একটি বার্নিং ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। ডিসেম্বর নাগাদ বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি’র পক্ষ থেকে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার জন্য ক্রমবর্ধমান চাপে পড়ে অন্তর্বর্তী সরকার। এই নির্বাচনের মধ্যদিয়ে সংবিধান অনুযায়ী গণতন্ত্রে ফেরার কথা বাংলাদেশের। ১৬ই ডিসেম্বর ড. ইউনূস বলেছেন, ২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। এর অর্থ তার প্রশাসন দুই বছরের কিছু কম সময় ক্ষমতায় থাকবে। পুরোপুরি না হলেও অনেক সমালোচক এই ঘোষণায় নীরব হয়ে গেছেন। কিন্তু নির্বাচন, যদি তা দূরেও হয়, তবু তা নিয়ে বিএনপি, অন্য রাজনৈতিক দলগুলো এবং ছাত্রনেতাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ছাত্রনেতারা এখন একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের পরিকল্পনা করছেন। ওই তারিখের বাইরেও নির্বাচনী প্রক্রিয়া এবং নির্বাচনপরবর্তী সময়ের বিভিন্ন ইস্যু এখনো অনিশ্চিত হয়ে আছে। উচ্চাকাঙ্ক্ষী একটি সংস্কার এজেন্ডার অংশ হিসেবে ড. ইউনূস কমপক্ষে এক ডজন কমিশন গঠন করেছেন। তাদের কাজ সংবিধান সংশোধন থেকে শুরু করে নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার। এর মধ্যে চারটি কমিশন মধ্য জানুয়ারিতে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে রিপোর্ট জমা দিয়েছে। তাতে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক সংস্কারের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। প্রফেসর ইউনূস আরেকটি কমিশনের নেতৃত্বে রয়েছেন। তিনি প্রথম সারির রাজনৈতিক দলগুলো ও সামাজিক শক্তির সঙ্গে সংলাপ করছেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐকমত্য এই প্রক্রিয়ার সফলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

রিপোর্টে আরও বলা হয়, হাসিনার আওয়ামী লীগ রাজনীতি থেকে অনুপস্থিত। তাদের নেতারা নির্বাসনে। দেশে থাকা তাদের নেতাকর্মীরা আত্মগোপন করে আছেন। ফলে দেশে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক শক্তি এখন বিএনপি। অতীতে যখন, বিশেষ করে ২০০০-এর দশকের শুরুতে বিএনপি ক্ষমতায় ছিল তারাও শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের মতো একইরকম একনায়কতন্ত্রের প্রবণতা প্রদর্শন করেছে। অন্তর্বর্তী সরকার ও তার সমর্থকদের কাছে এটা এখন বড় উদ্বেগের বিষয়। মনে করা হচ্ছে সংস্কারের ফলে দেশকে আবার কর্তৃত্ববাদী শাসনে ফিরে যাওয়া থেকে রক্ষা করবে।

জনসাধারণের মধ্যে রাজনৈতিক সংস্কারের যে গভীর আকাঙ্ক্ষা তা ড. ইউনূসকে সুবিধা দিয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক উত্তেজনায় অন্তর্বর্তী সরকার অন্যান্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো তার অর্থনীতিতে অব্যবস্থাপনা। এর মধ্যে আছে আর্থিক খাতে ভয়াবহ দুর্নীতি ও তার ঘনিষ্ঠদের লুটপাট। এর ফলে কমপক্ষে ১০টি ব্যাংক ‘টেকনিক্যালি ঋণখেলাপি’ হয়েছে। ড. ইউনূস দায়িত্ব নেয়ার সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ক্রমহ্রাসমান। খাদ্যে মূল্যস্ফীতি শতকরা কমপক্ষে ১৫ ভাগে উঠে যায়। গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক কর্মকর্তাদের নিয়োগ, পলিসি তৈরি এবং আস্থা পুনরুদ্ধারে মন্ত্রীদের নিয়োগকে দেখা হয়- অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণ হিসেবে। তারপরও রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তার ফলে এখনো অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত। একরোখা মুদ্রাস্ফীতি থেকে বাংলাদেশিরা অব্যাহতভাবে দুর্ভোগে। এ সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার স্বল্পতার ফলে বিদ্যুৎ কর্তনে অবদান রেখেছে। আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল আইএমএফ আশা করছে আগামী অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি দ্রুত ঘুরে দাঁড়াবে। মুদ্রাস্ফীতি অর্ধেকে নেমে আসবে।

এই রিপোর্টে ভুয়া তথ্য এবং প্রতিবেশীদের সঙ্গে উত্তেজনার বিষয় তুলে ধরা হয়। এক্ষেত্রে ভারত ও সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রসঙ্গ তোলা হয়। এতে বলা হয়, শেখ হাসিনাকে উৎখাতের ফলে ইসলামপন্থি দলগুলো প্রভাব বিস্তার করছে। এসব অভিযোগ এসেছে আওয়ামী লীগের সমর্থক ও ভারত থেকে, যারা আওয়ামী লীগকে এবং হাসিনাকে দীর্ঘ সময় ধরে সমর্থন দিয়ে এসেছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপে তাদের আকর্ষণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সেখানে সমালোচকরা বলছেন, তালেবান নিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তানের মতোই টালমাটাল পরিস্থিতিতে যাওয়ার ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ। তবে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার প্রথম কয়েক দিনের মধ্যে হিন্দুদের ওপর বিক্ষিপ্ত হামলা হয়েছে। এ সময়ে পুলিশ দায়িত্ব পালন করেনি। যারা হামলায় ভিকটিম হয়েছেন তারা ধর্মীয় পরিচয়ের বাইরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের সমর্থক। কিন্তু তা নিয়ে ভারতে অনেকে, মিডিয়া এবং আওয়ামী লীগ মিথ্যা প্রচারণা চালিয়েছে। মানবাধিকার বিষয়ক একটি গ্রুপ ২০২৪ সালে হিন্দুদের বিরুদ্ধে সহিংসতার ১২৭টি ঘটনা ডকুমেন্ট হিসেবে ধারণ করেছে। ২০২১ সালের তুলনায় তা অনেক কম। একইভাবে অভিযোগ আছে, ইসলামপন্থিরা বাংলাদেশের গণ-অভ্যুত্থানের নেপথ্যে ছিল এবং তারা এখন সরকারকে বিভ্রান্ত করতে বড় রকমের প্রভাব রাখছে। বাংলাদেশকে ঘিরে ভারতের মিডিয়া এবং রাজনীতিকরা মিথ্যা তথ্য দিচ্ছে। এমন সব ঘটনা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে কঠিন অবস্থায় ফেলেছে। বাংলাদেশে ক্ষমতাচ্যুত সরকারের প্রতি নয়াদিল্লির সমর্থন বাংলাদেশিদের কাছে গভীরভাবে অপছন্দের। একই সঙ্গে যখনই এমন ধারণা জন্মেছে যে, ড. ইউনূসের সরকারকে হেয় করার চেষ্টা করছে ভারত এবং আওয়ামী লীগকে ফেরাতে চেষ্টা করছে, তখন বাংলাদেশে ভারতবিরোধী সেন্টিমেন্ট বাড়ছে। নির্বাসনে শেখ হাসিনাকে ভারত শুধু আশ্রয় দিয়েছে এমন নয়। একই সঙ্গে বাংলাদেশিদের ভারতীয় ভিসা পাওয়াকে কঠিন করে তুলেছে। সর্বোপরি ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং ধর্মীয় অধিকার নিয়ে ঢাকাকে নিয়ে তারা নিয়মিতভাবে সমালোচনা করছে। ওদিকে পাওনা পরিশোধ না করায় বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রপ্তানি কমিয়ে দেয়। ফলে ব্যাপক বিদ্যুৎ সংকট দেখা দেয়। উত্তেজনার সঙ্গে যোগ হয়েছে সীমান্তে বেড়া নির্মাণ নিয়ে বিরোধ। আঞ্চলিক সুপারপাওয়ারকে মোকাবিলা করা ঢাকার জন্য কঠিন। কিন্তু তারা দেশের ভেতরে জনগণের মতামতকে উপেক্ষা করতে পারে না। সেপ্টেম্বরে পূজাকে সামনে রেখে ইলিশ রপ্তানি স্থগিতের অস্থায়ী সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তারপর ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে ইন্টারনেট সংযোগ বাতিল করে। ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের হাতে বাংলাদেশি হত্যার বিষয়টি তুলে ধরা হয়। এই বিষয়টি হাসিনার সরকার উপেক্ষা করে এসেছে।

এর প্রেক্ষিতে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন কী করতে পারে তার বিস্তারিত তুলে ধরা হয় রিপোর্টে। এতে বলা হয়, হাসিনার পতনের ফলে বাংলাদেশে রাজনৈতিক ব্যবস্থা নতুন রূপ দেয়ার, অধিক অংশগ্রহণমূলক ও জবাবদিহিতামূলক করার এক বিরল সুযোগ এসেছে। এসব সংস্কারের জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে যতটা সম্ভব, সমর্থন দেয়া উচিত ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের। অন্তর্বর্তী সরকারে সংস্কারকে সমর্থন দেয়ার ফলে বাংলাদেশে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ভাবমূর্তি। ইউরোপিয়ান কিছু কূটনীতিক প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগ রেজিমের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন- এখন উচিত হবে দেশের রাজনৈতিক পক্ষগুলোর সঙ্গে তাদের বিস্তৃত যোগাযোগ বৃদ্ধি করা। এর মধ্যে আছে ছাত্র নেতৃত্ব ও ইসলামপন্থি গ্রুপগুলো। কারণ, তারা এখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ বিষয়ে ক্রাইসিস গ্রুপের মিয়ানমার ও বাংলাদেশ-বিষয়ক সিনিয়র কনসালট্যান্ট থমাস কিয়ান বলেন, বাংলাদেশের অন্তর্র্বর্তী সরকারের মধুচন্দ্রিমা এখন পুরোপুরি শেষ। রাজনৈতিক দলগুলো এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পক্ষ সংস্কার নিয়ে দরকষাকষি করায় এবং নির্বাচনী সুবিধার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠায় এই বছর রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো বাড়তে পারে। জিনিসপত্রের ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধির কারণেও অন্তর্র্বর্তী সরকার চাপের মধ্যে রয়েছে যা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অব্যবস্থাপনার উত্তরাধিকার হিসেবে তারা পেয়েছে। আর অর্থনীতিকে আবার সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার চলমান প্রচেষ্টার সুফল বাংলাদেশের জনগণের বাস্তবে পেতে আরও সময় লাগবে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে এখনো টানাপড়েন রয়েছে আর রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অদূর ভবিষ্যতে যুদ্ধবিধ্বস্ত মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। এরপরও আগামী বছর বাংলাদেশের সামনে দেশটির জাতীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা পুনর্গঠন এবং এটিকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও জবাবদিহিমূলক করার একটি বিরল সুযোগ রয়েছে। এই লক্ষ্যে সংস্কার কমিশনগুলো কয়েকশ’ প্রস্তাব সংবলিত প্রতিবেদন জমা দিতে শুরু করেছে। এদিকে নির্বাচনী রাজনীতিতে বাংলাদেশের জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারে অবাধ, সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে। সংস্কার প্রক্রিয়ার সমর্থনে এবং অন্তর্র্বর্তী সরকার যাতে বাংলাদেশকে একটি জাতীয় নির্বাচনের দিকে এগিয়ে নিতে সক্ষম হয় তা নিশ্চিতে কথাবার্তার মাধ্যমে, কারিগরি ও আর্থিকভাবে বিদেশি অংশীদারদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। বিশেষ করে ইইউ’র সামনে গণতান্ত্রিক উত্তরণকে সমর্থন দেয়ার এবং অত্যন্ত ভূরাজনৈতিক গুরুত্বের একটি অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ এক বাণিজ্য অংশীদারের সঙ্গে তাদের সম্পর্কোন্নয়নের সুযোগ এনে দিয়েছে বাংলাদেশ।”

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com
Website Design By Kidarkar It solutions