আলম রায়হান:- ষাটের দশকে স্কুলের পাঠ্য তালিকায় একটি প্রধান বিষয় ছিল রচনা। আর পাঠ্য হিসেবে নির্ধারিত রচনাগুলোর মধ্যে একটির শিরোনাম ছিল, ‘যদি লক্ষ টাকা পাই’। বলা বাহুল্য, তখনকার লাখ টাকা আজকের কোটি টাকার কাছাকাছি। অবশ্য, বিতাড়িত ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের কারসাজিতে কোটি টাকা তেমন কোনোই টাকা নয়, যদি তার সঙ্গে শ’ অথবা হাজার শব্দটি যুক্ত না হয়। যাক, এটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। ‘যদি লক্ষ টাকা পাই’—শিরোনামের রচনা প্রসঙ্গে আসি। এ রচনায় বিভিন্ন পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে। এমনকি ‘সব ভাত গুড় দিয়ে’ খাবার কথাও বলা আছে উল্লিখিত রচনায়। সব ভাত গুড় দিয়ে খাবার অবাস্তব কথা বলা হয়েছে কিশোর মননকে আকৃষ্ট করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু র্যাব বিলুপ্তির দাবি তোলার মূল উদ্দেশ্য কী?
এদিকে গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নানা মহল থেকে র্যাব বাহিনী বিলুপ্ত করার দাবির পালে বেশ হাওয়া লেগেছে। এদিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গঠিত গুম কমিশনও র্যাব বিলুপ্তির সুপারিশ করেছে। থেমে থেমে র্যাব বিলুপ্তির জিকির উঠছে, ম্যালেরিয়া জ্বরের মতো। মনে পড়ে সেই সংলাপ, ‘কী বিচিত্র এই দেশ, সেলুকাস!’ জানা যায়, বর্তমান সরকারও র্যাব বিলুপ্তির কথা ভেবেছিল প্রথম দিকে। এমনও ধারণা করা হয়েছিল, যে কোনো সময় বিলুপ্তির ঘোষণা আসতে পারে সেনাবাহিনী ও পুলিশসহ সাতটি সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত এলিট ফোর্স র্যাব। কিন্তু র্যাব বিলুপ্ত হলে দেশের আইনশৃঙ্খলার কী দশা দাঁড়াবে? এটা মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন। এদিকে আইনশৃঙ্খলা নিয়ে নানান প্রশ্ন বিরাজমান, ভবিষ্যৎ নিয়েও আছে চরম উৎকণ্ঠা। এদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার প্রধান শক্তি পুলিশের ভঙ্গুর দশা। এ বাহিনীর মনোবলের করুণ অবস্থা খুবই প্রকট। ডিএমপি কমিশনারের ভাষ্যমতে, ‘বুটপরা পুলিশের পক্ষে খালি পায়ের ছিনতাইকারীর সঙ্গে দৌড়ে পেরে ওঠা কঠিন।’ তিনি যা বলেছেন তা আসলে দৃশ্যমান দুর্দশা। এর নেপথ্য কারণ হচ্ছে, পুলিশের ইমেজ এবং মনোবল সংকট। বিপরীতে অপরাধীদের জোশ এখন ঊর্ধ্বগগনে! এখানে খালি পা অথবা বুটপা মূল বিষয় নয়। আর বরাবরের মতো অদৃশ্য চাপে থাকা পুলিশ যেখানে বিরাজমান সেখান থেকে টেনে তোলার কাজে সহসা সাফল্য আসবে বলে মনে হয় না। বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন, রাজনৈতিক চলমান নাজুক অবস্থায় পেশাদার ও অপেশাদার সন্ত্রাসীরা খুবই বেপরোয়া। এরা কতটা বেপরোয়া তার প্রমাণ প্রতিনিয়ত মিলছে রাজধানী থেকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত। আর ভয়ানক এক উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে নেত্রকোনার দুর্গাপুরে। ছুটিতে আসা এক পুলিশ কর্মকর্তাকে ৯ জানুয়ারি প্রকাশ্যে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। এমনকি তার পা থেকে গোড়ালি বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে। বুঝিয়ে বলার কি অপেক্ষা রাখে, সন্ত্রাসীদের কাছে পুলিশ কতটা নস্যি! এ অবস্থায় র্যাব বিলুপ্ত হলে অপরাধীদের মনোবল সপ্তম আসমানে উঠবে, তাতে অবাক হওয়ার কি কিছু আছে? এদিকে পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এলিট ফোর্স র্যাব এখন খুবই ‘সুশীল’ প্রবণতায় আছে। আছে নিউট্রাল গিয়ারে, অনেকটা যেন রাষ্ট্রের শোপিস। হয়তো এলিট সংস্থাটি বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কায় নিমজ্জিত।
বলা বাহুল্য, র্যাব বিলুপ্তির ধুয়া সাম্প্রতিক কোনো বিষয় নয়। শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট রাজত্বকালে আমেরিকার স্যাংশন খাওয়া এ সংস্থা বিলুপ্তির দাবি তোলা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে একাধিক কেন্দ্র থেকে। এ দাবিতে নিউইয়র্কভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের বরাবর চিঠিও দিয়েছে। বোধগম্য কারণেই এ চিঠিকে সরাসরি অবহেলার দৃষ্টিতে দেখার সুযোগ কম। এ অবস্থায় অনেক প্রশ্ন উঠতেই পারে। প্রধান প্রশ্ন, অনিশ্চিত এ অবস্থানে পৌঁছানোর দায় কার? র্যাব বিলুপ্ত হলে কার ক্ষতি, কার লাভ? এবং পরিস্থিতি কী দাড়াবে? বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়ার আগে এক বাক্যে বলে রাখা ভালো, র্যাব দানব হয়ে ওঠার পেছনে শেখ হাসিনা সরকারের যেমন দায় রয়েছে, তেমনই সুনির্দিষ্ট দায় আছে র্যাব গঠন প্রক্রিয়া এবং ধার করা আইনেও। মজার বিষয়, বিশাল বাজেটে শানশওকতের র্যাব চলছে নিজস্ব আইন ছাড়াই। জন্ম থেকে জ্বলার মতো। আর ধার করা আইনের মধ্যে লুকিয়ে আছে একটি বাহিনীকে সরকারের ইচ্ছামতো অপব্যবহার করার অবারিত সুযোগ এবং যাকে এ সংস্থাটির মৃত্যু পরোয়ানা হিসেবেও বিবেচনা করা যায়।
র্যাব প্রসঙ্গে একটু পেছনে ফেরা যাক। প্রায় দুই যুগ আগে ২০০১ সালের অক্টোবরের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন হয় বিএনপি। এ বিএনপি-জামায়াত সরকারকে বিব্রত করার নেপথ্য খেলা ছিল সূচনালগ্ন থেকেই। ফলে শুরুতেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকে। খোদ রাজধানীর রাজপথে ঘটতে থাকে একের পর এক হত্যাকাণ্ড। এদের মধ্যে কয়েকজন ওয়ার্ড কমিশনারও ছিলেন। একের পর এক খুনের ঘটনায় পরিস্থিতির দ্রুত অধিকতর অবনতি ঘটলে ২০০৩ সালের অক্টোবর মাসে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ শুরু হয়। এতে প্রত্যাশিত মাত্রারও চেয়েও বেশি সুফল পাওয়া যায়। তিন মাসের মাথায় ২০০৪ সালের জানুয়ারি মাসে সেনাবাহিনী ফিরিয়ে নেওয়া হয় ব্যারাকে। পরিস্থিতি আবার অবনতির দিকে যেতে থাকে। এদিকে আগের সিদ্ধান্ত অনুসারে গঠিত র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ২০০৪ সালের ২৬ মার্চ কার্যক্রম শুরু করে। এ সংস্থার কার্যক্রম শুরু হলে আইনশৃঙ্খলার বেশ উন্নতি হতে থাকে। জনমনে ফিরে আসে অভূতপূর্ব স্বস্তি। কিন্তু এ ধারায় ছন্দপতন ঘটে ক্রসফায়ারের পথ ধরে। র্যাবের বন্দুকযুদ্ধের সূচনা হয় শীর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্চি হান্নানের কথিত ‘ক্রসফায়ারের’ মধ্য দিয়ে। সে সময় অনেক কুখ্যাত সন্ত্রাসী র্যাবের সঙ্গে ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হয়। এতে র্যাবের জনপ্রিয়তা আরও বেড়ে যায়। কোনো কোনো ‘ক্রসফায়ারের’ পর মিষ্টি বিতরণও করা হয়েছে। কিন্তু এ জনপ্রিয়তা একপর্যায়ে কুকর্মের আঁতুড়ঘর হয়ে ওঠে। সরকারের শাসন বহাল রাখা এবং বিভিন্ন ব্যক্তির লালসায় জর্জরিত হয়ে ‘ক্রসফায়ার’ কাণ্ড ঘিরে র্যাবের দানবীয় ইমেজ প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। এলিট এ বাহিনীটি তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে। যে অবস্থা থেকে উত্তরণের বদলে হাসিনা সরকার আমলে আরও ভয়ংকর হয়ে ওঠে র্যাব। কথিত ‘ক্রসফায়ার’ যেন একসময় অনেকটা নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়। তখন থেকেই বিদেশিদের নজরে আসতে থাকে এ বাহিনী। ২০০৫ সালে ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ওয়াশিংটনে যে তারবার্তা পাঠিয়েছিলেন, সেখানে র্যাবের নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এদিকে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রধান পুরুষ প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছিলেন, ‘কোনো র্যাব সদস্য বিশৃঙ্খলা করলে, তার বিরুদ্ধে সরকার কঠোর ব্যবস্থা নেবে।’ এ হুঁশিয়ারিতে র্যাব কিছুটা সংযত হলেও তা ছিল রংধনুর মতোই ক্ষণস্থায়ী। পরবর্তীকালে আওয়ামী শাসনামলে র্যাব হয়ে ওঠে চরম রক্তপিপাসু মূর্তমান এক দানব!
মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের তথ্য অনুযায়ী, শুরু থেকে বিএনপির ক্ষমতার মেয়াদ ২০০৬ সালে শেষ হওয়া পর্যন্ত র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ৩৮০ জন নিহত হয়েছে। আর আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ধারাবাহিক একাধিক মেয়াদে র্যাব ও অন্যান্য আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার দ্বারা কথিত ক্রসফায়ারে অন্তত ৬০০টি হত্যাকাণ্ড এবং ছয় শতাধিক লোকের নিখোঁজের খবর পাওয়া গেছে। এদিকে র্যাবের বিরুদ্ধে ক্রসফায়ারের নামে হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ ব্যাপক প্রচার পায় ২০১৪ সালে নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনায়। অভিযোগ আছে, অর্থের বিনিময়ে এ খুন করানো হয়েছে। এরপর র্যাবের বিরুদ্ধে সমালোচনা অধিকতর জোরালো হয় ২০১৮ সালে টেকনাফে পৌর কাউন্সিলর ও স্থানীয় যুবলীগের সাবেক সভাপতি মো. একরামুল হক নিহত হওয়ার ঘটনায়। সেই হত্যাকাণ্ডের প্রাক্কালে অডিও রেকর্ড প্রকাশিত হওয়ার পর সারা দেশের মানুষ র্যাবের ওপর সংক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এ অবস্থায় অনেকটা আকস্মিকভাবে ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর র্যাব এবং এর ছয় কর্মকর্তার ওপর আমেরিকা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এ নিষেধাজ্ঞা থেকে পরিত্রাণের উপায়ও বাতলে দেওয়া হয়েছিল, যা ২০২২ সালে প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস। কিন্তু হতাশার বিষয় হচ্ছে, আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় না নিয়ে হাসিনা সরকার লোকদেখানো দেনদরবার করেছে। পাশাপাশি বলেছে অনেক হাস্যকর কথাবার্তা। এমনকি আমেরিকার স্যাংশন খাওয়া র্যাবের দুই ডিজি বেনজীর আহমেদ ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে পুলিশের আইজি করেছে আওয়ামী লীগ সরকার। এটি ছিল প্রকারান্তরে আমেরিকাকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করা। আরও বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে, সে সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গ্রাম্য মোড়লের মতো বাগাড়ম্বরও করেছেন, ‘স্যাংশন কখনো একতরফা হয় না। দরকার হলে আমরাও স্যাংশন দিতে পারি।’ কিন্তু শেখ হাসিনা আসলে কী পারেন তা প্রমাণ করেছেন ৫ আগস্ট ৪৫ মিনিটের নোটিশে দেশ ছেড়ে পলায়নের মধ্য দিয়ে।
বহুল শ্রুত নতুন বাংলাদেশ নির্মাণের ৮ আগস্ট থেকে প্রকাশ্য চিন্তক হচ্ছে ড. ইউনূস। তার সঙ্গে দেশ নির্মাণে অনেক কারিগর ও শ্রমিক আছেন। যারা খাদের কিনার থেকে দেশকে টেনে তোলার দায়িত্বে নিয়োজিত বলে শুনে আসছি। এ ক্ষেত্রে প্রধান খাতগুলোর মধ্যে বিশেষ হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা প্রসঙ্গ। এর বিষয়ে এক প্রকার প্রধান ব্যক্তিত্ব স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। এই দায়িত্ব পালনে প্রথমবারের বাছাই প্রশ্নবিদ্ধ হলেও দ্বিতীয় চয়েস লে. জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী প্রশংসিত হয়েছেন। আর সীমান্ত প্রশ্নে তার সিদ্ধান্ত ইতিহাসে বিশেষভাবে লিখিত হবে। যেমন স্বর্ণাক্ষরে লিখিত আছে জেনারেল আ ল ম ফজলুর রহমানের ভূমিকা, যখন তিনি বিডিআরের ডিজি ছিলেন। কিন্তু বিরাজমান জটিল পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার বিশাল কর্মযজ্ঞে যাদের সহযোগিতা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে নিতে হচ্ছে তাদের দক্ষতা এবং নিরপেক্ষতাও খুবই গুরুত্ব বহন করে। তাদের মধ্যে কেউ যদি ‘আমার লোক, তাহার লোক’ খোঁজার প্রবণতায় থাকেন এবং বহু আগে বাড়ি যাওয়াদের এনে র্যাব-পুলিশে হাটবাজার বসানোর ঘোরে ঘুরপাক খান, তাহলে কিন্তু গত সরকারের সময়মতো বাহিনীগুলো হয় আবার দানব হয়ে উঠবে, না হয় লাজুক পান্ডার পরিণত হতে বাধ্য। তখন হয়তো তারা নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা আওড়াবে। না হয় গাইবে, ‘মন ভালো না, আমার দিল ভালো না…।’ যে গান এখন পুলিশ গায় এবং র্যাব ঝিমায়। এই ধারা অব্যাহত থাকলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে? বিশেষ করে, আগামী সংসদ নির্বাচনের বিষয়টি গভীরভাবে বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন। তবে নির্বাচনের নামে রায়টের পরিস্থিতি সৃষ্টি করার কারও কোনো মতলব থাকলে সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ! কালবেলা, লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক