দুই সংস্কার কমিশনের কাছে প্রস্তাবের পাহাড়, আলোচনা করেই সুপারিশ

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর, ২০২৪
  • ২২ দেখা হয়েছে

ডেস্ক রিপেৃাট:- দুই সংস্কার কমিশনের কাছে জমেছে প্রস্তাবের পাহাড়। রাষ্ট্র সংস্কারের ক্ষেত্রে বেশি মনোযোগ যাচ্ছে সংবিধান ও নির্বাচনব্যবস্থার দিকে। গুরুত্বপূর্ণ এই দুই বিষয়ে কী ধরনের সংস্কার হবে তার ওপরই অনেকাংশে নির্ভর করবে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পাওয়া নতুন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। এমন ধারণা অনেকের।

বেশি মনোযোগ সংবিধান ও নির্বাচনব্যবস্থার দিকেসেসব প্রস্তাবে ব্যাপক পরিবর্তনের দাবি রয়েছে। দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন বন্ধ করতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় ফেরা, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনা, দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী না হওয়া এবং নারীদের সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচন প্রস্তাব অনেকের।

দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের কথাও চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। সংবিধানসংশ্লিষ্ট সংস্কারে সংবিধান সংস্কার কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করেই সুপারিশ প্রস্তুত করছে কমিশনগুলো।

দুদককে আমলাতন্ত্রমুক্ত করে ঢেলে সাজানোর জোরালো প্রস্তুতি নিয়েছে দুদক সংস্কার কমিশন। এই কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘আগামী মাসেই আমরা আমাদের প্রতিবেদন জমা দিতে পারব।’ জনপ্রশাসন জনবান্ধব হতে কী ধরনের বাধা আছে সে বিষয়ে মতামত সংগ্রহ করছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। পুলিশ সংস্কার কমিশনের কাছে গত ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত অনলাইনে অন্তত ২০ হাজার মানুষ মতামত দিয়েছে।

বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের বক্তব্য, ‘সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া, এটি চলতে দেওয়া উচিত। আমরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আংশিক প্রতিবেদন জমা দিতে পারব।’

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত ১১ সেপ্টেম্বর নির্বাচনব্যবস্থা, সংবিধান, পুলিশ, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠনের ঘোষণা দেন। গত ৩ অক্টোবর এই ছয় কমিশনের মধ্যে সংবিধান সংস্কার কমিশন ছাড়া অন্য পাঁচটি কমিশন গঠনের প্রজ্ঞাপন জারি হয়। ৬ অক্টোবর প্রজ্ঞাপন জারি হয় সংবিধান সংস্কার কমিশনের।

কমিশনগুলোকে ৯০ দিনের মধ্যে সরকারপ্রধানের কাছে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়।

ছয়টি সংস্কার কমিশনের পর অন্তর্বর্তী সরকার গত ৩১ অক্টোবর আরো পাঁচটি সংস্কার কমিশন গঠনের ঘোষণা দেয়। এগুলো হচ্ছে : গণমাধ্যম, স্বাস্থ্য, শ্রম, নারীবিষয়ক ও স্থানীয় সরকার। গত ১৮ নভেম্বর ৯০ দিন সময় দিয়ে পূর্ণাঙ্গভাবে এই পাঁচটি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়।

নতুন পাঁচটি সংস্কার কমিশনের কাজ এখনো তেমনভাবে শুরু হয়নি বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান। আর প্রথম ছয়টি সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন-সুপারিশ পাওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করতে পারে আগামী বছরের প্রথম দিকে। সে ক্ষেত্রে কবে নাগাদ সংস্কারের কাজ সম্পন্ন হবে তা অনিশ্চিত। এদিকে দ্রুত প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা নিতে রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি ক্রমে জোরালো হচ্ছে।

সংবিধান সংস্কারে জমছে প্রস্তাবের পাহাড় :

সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ কমিশন গঠনের আগে গত ২৯ আগস্ট এক সম্মেলনে বলেছিলেন, গণপরিষদ করে হলেও সংবিধান পুনর্লিখনের বিকল্প নেই। কমিশন গঠনের পর গত ৩ নভেম্বর তিনি বলেন, সংযোজন, বিয়োজন, পুনর্লিখন—সব রকম ব্যবস্থা নিয়েই আলোচনা করা হবে। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানকে পাশ কাটিয়ে সংবিধান প্রণয়নের সুযোগ নেই বলেও তিনি মন্তব্য করেন। এর আগের দিন বিশিষ্ট আইনবিদ ও দেশের সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেন এই কমিশনকে দেশের সংবিধান সময়োপযোগী করার পরামর্শ দেন।

সংবিধান সংস্কার কমিশন গত ৫ নভেম্বর সাধারণ মানুষের মতামত গ্রহণের জন্য ওয়েবসাইট চালু করে। আগামী ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত সেখানে প্রস্তাব ও সুপারিশ জমা দেওয়া যাবে। পাশাপাশি সরাসরি প্রস্তাব গ্রহণের জন্য কমিশন গত ১১ নভেম্বর থেকে অংশীজনদের সঙ্গে মতবিনিময় শুরু করেছে। সরাসরি ও অনলাইনে জমা পড়া প্রস্তাবে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ উঠে এসেছে। বিশিষ্টজনদের পাশাপাশি সাধারণ নাগরিকদের কাছ থেকে আসা প্রস্তাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের পাশাপাশি ওই সরকারের মেয়াদ ছয় মাস করার দাবি জানানো হয়েছে। গণভোটের বিধান রাখারও প্রস্তাব এসেছে। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরির প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। সংসদ ও বিচার বিভাগকে শক্তিশালী করতে প্রয়োজনীয় সংশোধনীরও দাবি করা হয়েছে।

সংরক্ষিত নারী আসন এক শতে উন্নীত করে সরাসরি নির্বাচন অনুষ্ঠান, সংসদে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা চালু, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকেও জাতির পিতার স্বীকৃতি প্রদান, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট ব্যবস্থা প্রবর্তনসহ বিভিন্ন সুপারিশ করা হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ও জাতীয় চার মূলনীতির স্বীকৃতিসংক্রান্ত সংবিধানের প্রস্তাবসহ মীমাংসিত বিষয়গুলো বহাল রাখার পক্ষেও মত এসেছে। সংসদ ও বিচার বিভাগকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে দু-তিনটি ক্ষেত্র ছাড়া সংসদ সদস্যদের নিজস্ব মত প্রকাশের ওপর গুরুত্ব দেওয়ার এবং সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম না রাখার পক্ষেও প্রস্তাব এসেছে।

এ ছাড়া সংসদের মেয়াদ কমিয়ে চার বছর করা, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং উচ্চকক্ষে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতের প্রস্তাবও জমা হয়েছে। কেউ কেউ সংবিধান সংশোধন করে একই ব্যক্তি যাতে টানা দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন না হন, সেই ব্যবস্থা আরোপের পক্ষেও মত দিয়েছেন। কমিশনকে আদালতের বিচারকদের চাকরিবিধি ও শৃঙ্খলা সংক্রান্ত সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ বাতিলের এবং সংবিধান পুনর্লিখনের বিরোধিতা করে সংশোধন ও সংযোজনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। মতবিনিময় ছাড়াও বিভিন্নভাবে প্রস্তাব গ্রহণ এবং তা যাচাই-বাছাই চলছে বলে জানিয়েছেন সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ।

তিনি বলেন, প্রস্তাবগুলো যাচাই-বাছাই শেষে কমিশনের মতামতসহ তা সুপারিশ আকারে সরকারের কাছে জমা দেওয়া হবে। সরকারের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শেষে সুপারিশ চূড়ান্ত করার পাশাপাশি সুপারিশ বাস্তবায়নের পদ্ধতি ঠিক করা হবে।

নির্বাচনব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তনের তোড়জাড় :

ড. বদিউল আলম মজুমদারের নেতৃত্বাধীন নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন জাতীয় নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্য বন্ধে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রার্থী মনোনয়নে তৃণমূল পর্যায়ে ভোটের ব্যবস্থা চালু করার প্রস্তাব রাখার কথা ভাবছে। এ ছাড়া দলে কমপক্ষে তিন বছর সদস্য না থাকলে প্রার্থী হওয়া যাবে না—এই বিধান আবার ফিরে আসতে পারে। সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনে সরাসরি ভোটের আয়োজন এবং পর্যায়ক্রমে দেশের সব এলাকায় নারী আসন নির্ধারণ করা হতে পারে।

ওই সব আসনে কোনো পুরুষ প্রার্থী থাকবেন না। জোটবদ্ধ নির্বাচনের ক্ষেত্রে জোটভুক্ত দলগুলোর প্রার্থীদের নিজ নিজ দলের প্রতীক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হতে পারে। সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া এবং নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনে সরাসরি ভোটের প্রস্তাবও গুরুত্ব পাচ্ছে। কমিশনের সদস্যরা এসব প্রস্তাব যৌক্তিক মনে করছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০০৮ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে এ টি এম শামসুল হুদার নির্বাচন কমিশন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রধান আইন দ্য রিপ্রেজেন্টেশন অব দ্য পিপল অর্ডার (আরপিও) বা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে বেশ কিছু বিধান যুক্ত করেছিল। কিন্তু নবম জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগ সেগুলো বাতিল করে। সংস্কার কমিশন সেই বাতিল বিধানগুলো আবার ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব দেবে বলে দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও সংসদীয় পদ্ধতি চালু করার পক্ষে কমিশন। এই পদ্ধতিতে মেয়র-চেয়ারম্যান পদে না হয়ে সরাসরি ভোট হবে কাউন্সিলর ও সদস্য পদে। কাউন্সিলর-সদস্যরাই মেয়র-চেয়ারম্যান নির্বাচিত করবেন।

গত রবিবার নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য ও স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. তোফায়েল আহমেদ সাংবাদিককের এই চিন্তা-ভাবনার কথা জানান। ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারে যে বিষয়গুলো সংবিধানসংশ্লিষ্ট সেগুলো সংবিধান সংস্কার কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করেই সুপারিশ প্রস্তুত করা হচ্ছে। আমরা ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যেই আমাদের প্রতিবেদন জমা দিতে পারব বলে আশা করছি।’

পুলিশ সংস্কারের প্রতিবেদন তৈরি শুরুর পথে : সাবেক সচিব সফর রাজ হোসেনের নেতৃত্বাধীন পুলিশ সংস্কার কমিশন পুলিশ সদর দপ্তর, সিআইডি, ইউএনডিপি, মার্কিন দূতাবাস, স্টেট ডিপার্টমেন্টের গ্লোবাল ক্রিমিনাল জাস্টিস এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কার্টার সেন্টারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সংলাপ করেছে। তাদের কাছ থেকে পাওয়া মতামত লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।

গত ৩১ অক্টোবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে ‌‘কেমন পুলিশ চাই’ শিরোনামে জনমত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। সেখানে ১৭টি প্রশ্ন দেওয়া হয়েছিল। গত ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত অনলাইনের মাধ্যমে দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মতামত নেওয়া হয়। শেষ দিন পর্যন্ত অন্তত ২০ হাজার মানুষ মতামত দিয়েছেন বলে জানা গেছে।

সংস্কার কমিশনের সদস্য এ কে এম নাসিরউদ্দিন এলান বলেন, ‘দেশের মানুষ কী ধরনের সংস্কার চাচ্ছে, তার আলোকেই প্রতিবেদন লেখা হবে। আমাদের সুপারিশ বিষয়ে সরকার ব্যবস্থা নেবে।’

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পুলিশের নিয়োগ, পদায়ন ও বদলি—এই তিনটি বিষয়ে দুর্নীতি কিভাবে রোধ করা যায়, সে পরামর্শও থাকবে কমিশনের সুপারিশে। পুলিশ সদর দপ্তরের প্রস্তাব, দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ ও সাধারণ মানুষের মতামতের ভিত্তিতেই তৈরি হবে প্রতিবেদন। পুলিশকে আর যাতে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা না যায়, পুলিশের দ্বারা গুম করা, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনকে দ্রুত জবাবদিহির আওতায় আনার বিষয়েও সুপারিশ করবে কমিশন।

পুলিশের কাজকর্মের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে সবার জন্য উন্মুক্ত, স্থায়ী ‘অভিযোগ কমিশন’ স্থাপনের বিষয়েও মতামত দিয়েছেন অনেকে। সাইবার ক্রাইমসহ বিভিন্ন নিত্যনতুন অপরাধ শনাক্তকরণ ও দমনে বাংলাদেশ পুলিশকে বিভিন্ন উন্নত প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তার দিকেও গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে।

অধস্তন পর্যায়ে পুলিশ সদস্যদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা যুক্তিসংগতভাবে বাড়ানো, ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে পুলিশের দুর্নীতি বন্ধের কার্যকর প্রশাসনিক ও বিধিগত ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়েও সংস্কার কমিশন সুপারিশ করবে।

‘গায়েবি-ভুয়া মামলা’ দিয়ে বিরোধী দল-মত দমন করাসহ আইনের অপব্যবহার রোধে ফৌজদারি কার্যবিধি-১৮৯৮-এর সংশ্লিষ্ট ধারাটির সংস্কারের বিষয়েও কমিশনে আলোচনা চলছে বলে জানা গেছে। ভুয়া ফৌজদারি মামলা করার ক্ষেত্রে পুলিশের ভয়ভীতি দেখিয়ে আর্থিক লেনদেন বা দেনদরবার প্রতিরোধে মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার-পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে অভিযোগ দায়েরের ব্যবস্থা রাখার বিষয়েও মতামত দিয়েছেন সাধারণ নাগরিকরা।

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন ১৩ প্রশ্নের জবাব খুঁজেছে : জনপ্রশাসন সংস্কারে ১৩টি বিষয়ে নিজেদের ওয়েবসাইটে নাগরিকদের মতামত জানতে চেয়েছিল সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আবদুল মুয়ীদ চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। এ বিষয়ে নাগরিকদের অনলাইন ও সরাসরি অভিমত জানানোর সময়সীমা ছিল গত ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত।

এসব মতামত নিয়ে কাজ করছেন ১১ সদস্যের কমিটি ছাড়াও সাচিবিক দায়িত্বে থাকা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। কমিটির সদস্যরা কয়েক দফায় বৈঠক করে নিজেদের কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে বিভিন্ন গ্রুপে কাজ করছেন।

কমিশনের প্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী বলেন, ‘জনপ্রশাসন কেমন হওয়া উচিত, জনবান্ধব হতে কী ধরনের বাধা আছে, সরকারি চাকুরেদের ব্যবহারে আপনি সন্তুষ্ট কি না—এ ধরনের ১৩টি প্রশ্ন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছিল। প্রতিদিন লাখো মানুষ সেখানে নক করছেন, মতামতও দিয়েছেন।

এর বাইরে আমরা সরাসরি কিছু কাজ করছি। দেশের মাঠ প্রশাসনের সেবার ধরন জানতে কমিটির সদস্যদের বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ করা হয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ চলছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।’

দুদককে ঢেলে সাজানোর জোরালো প্রস্তুতি :

দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) আরো কার্যকর, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সংস্থা হিসেবে গড়ে তুলতে একে ‘আপাদমস্তক’ ঢেলে সাজানোর জোরালো প্রস্তুতি নিচ্ছে ড. ইফতেখারুজ্জামানের নেতৃত্বাধীন দুদক সংস্কার কমিশন। এরই মধ্যে এই কমিশন রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত কমিশন (দুদক চেয়ারম্যান ও দুই কমিশনার) গঠন, আমলাতন্ত্র থেকে দুদককে রক্ষা, আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং দুদকের সঙ্গে অন্যান্য সংস্থার সমন্বয়সহ নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

পাশাপাশি সংস্থাটির নিজস্ব কর্মকর্তাদের দুর্নীতির যথাযথ বিচারের বিষয়েও সংস্কার কমিশন গুরুত্বারোপ করেছে। এ ছাড়া দুদককে সাংবিধানিক মর্যাদা দেওয়া এবং কর্মকর্তাদের কাজের প্রণোদনাসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনাধীন। সংশ্লিষ্ট সব মতামত পর্যালোচনা শেষে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদন হস্তান্তর করবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে।

দুদক সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘দুদক কিভাবে কার্যকর হবে, তার দিকনির্দেশনা, সুপারিশমালা ও পরামর্শ দেওয়া সংস্কার কমিশনের কাজ। আমরা সে অনুসারে কাজ করে যাচ্ছি।’

বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন আংশিক প্রতিবেদন দেবে : ৯০ দিনের মধ্যে কমিশনের প্রতিবেদন দেওয়া সম্ভব কি না জানতে চাইলে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রধান আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান বলেন, ‘সরকার যেটা চাচ্ছে, প্রজ্ঞাপনে যে ধরনের কথা আছে, ইট ইজ হিউম্যানলি ইমপসিবল (এটি মানবিকভাবে অসম্ভব)। ৯০ কার্যদিবস নয় কিন্তু, ৯০ দিন। এর মধ্যে ৪৫ দিন চলে গেছে। ৯০ দিনের মধ্যে এটা (চূড়ান্ত প্রতিবেদন) হবে না।

তবে আমরা আংশিক প্রতিবেদন দিতে পারব। সরকার যেভাবে চাচ্ছে সেভাবে সম্পূর্ণ প্রতিবেদন দিতে পারব না। তবে এটুকু বলতে পারি, এটি একটি (বিচার বিভাগ সংস্কার) চলমান প্রক্রিয়া। এটি সব সময়ই চলা উচিত। কারণ সংস্কার তো আর এক দিনে হয় না। সময় সময় সংস্কারকাজ চালিয়ে যেতে হয়। সংস্কারপ্রক্রিয়া শুরু হলে একেকটি সমস্যা আসবে, সেটি মোকাবেলা করতে হবে। এটি চলতে দেওয়া উচিত।’

তিনি আরো বলেন, ‘মাননীয় প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আমাদের মতবিনিময় হয়েছে। সময় নিয়েই মতবিনিময় করেছি। আইন উপদেষ্টার সঙ্গেও আমরা মতবিনিময় করেছি। ভবিষ্যতে আরো দু-একজন সঙ্গে মতবিনিময় করব। সবার মতামত নিয়েই কমিশনের প্রস্তাব চূড়ান্ত করা হবে।’

আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাস্থ্য খাত সংস্কারের কাজ শুরু হয়নি : স্বাস্থ্য খাত সংস্কারে বিশেষজ্ঞ প্যানেল ও কমিশন গঠন করা হলেও এখনো এই কমিশন আনুষ্ঠানিক কাজ শুরু করেনি। কমিশনের প্রধান জাতীয় অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খান বলেন, ‘মৌখিকভাবে কাজ কিছু হয়েছে। তবে এখনো অফিশিয়ালি কোনো কার্যক্রম শুরু হয়নি। আশা করছি, শিগগিরই অফিশিয়ালভাবে কাজ শুরু করতে পারব।’

স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিটির আরেক সদস্য ও আইসিডিডিআরবির মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের বিজ্ঞানী ডা. আহমেদ এহসানুর রহমান বলেন, ‘কমিটিতে যারা আছি, সবাই একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। প্রাথমিকভাবে আমাদের মধ্যে কিছু কথাও হয়েছে। কিভাবে আগাব, আমাদের যাত্রাটা কেমন হবে—এসব বিষয়ে কথা হচ্ছে। আলোচনা হচ্ছে কিভাবে ন্যূনতম সময়ে সর্বোচ্চ অংশীজনের তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে একটা সুপারিশপত্র তৈরি করতে পারি।’

শ্রম সংস্কার কমিশন গঠন নিয়ে আপত্তি :

বিলসের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতানউদ্দিন আহমেদকে প্রধান করে গঠিত শ্রম সংস্কার কমিশনে সব সদস্যের অংশগ্রহণ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সাবেক সভাপতি ও শ্রম সংস্কার কমিশনের সদস্য ম. কামরান টি রহমান কয়েক দিন আগে বলেন, কমিটি গঠনে বৈষম্য হয়েছে।

এখানে শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি আটজন রাখা হলেও মালিকপক্ষের প্রতিনিধি রাখা হয়েছে মাত্র একজন। ফলে এই কমিটিতে মালিকপক্ষের অংশগ্রহণ মন্ত্রিপরিষদসচিবকে কমিটিতে মালিকপক্ষের অংশীজন বাড়ানোর বিষয় নিয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) কনভেনশন অনুসমর্থন করেছে। ফলে শ্রম আইন সংক্রান্ত যেকোনো সংস্কারে সংস্থাটির ১৪৪ ধারা পরিপালনীয়। সে ক্ষেত্রে ১০ সদস্যের শ্রম সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে, যা মালিক-শ্রমিক সমান সমান প্রতিনিধি সমর্থন করে। তাই পুনর্বিবেচনার জন্য মন্ত্রিপরিষদসচিবকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।কালের কণ্ঠ

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com
Website Design By Kidarkar It solutions