ডেস্ক রির্পোট:- বেক্সিমকো গ্রুপের কর্ণধার ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ খাত বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে মোবাইল ফোন ব্যবহারের সংবাদ প্রকাশের পর নড়েচড়ে বসেছে কারা কর্তৃপক্ষ। কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সালমানসহ ডিভিশন পাওয়া ভিআইপি বন্দিদের কক্ষে তল্লাশি চালিয়েছেন কারা কর্মকর্তারা। এ সময় সালমানসহ কয়েকজন কারা কর্মকর্তার ওপর খেপে যান বলে কারা সূত্রে জানা গেছে। সালমান বলেন, ‘আপনারা আমাদের ডিস্টার্ব করছেন।’
গতকাল মঙ্গলবার একটি জাতিয় দৈনিকে “কারাগারেও তৎপর ‘দরবেশ’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়। সংবাদে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সালমান এফ রহমানের ফোনালাপের তথ্য তুলে ধরা হয়। এ খবর প্রকাশের পর যেসব কারারক্ষী এতোদিন ভিআইপি বন্দিদের দায়িত্ব পালন করতেন তাদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। নতুন কারারক্ষীদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া ভিআইপি বন্দিদের একসঙ্গে গল্প করার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। অবশ্য একসঙ্গে হাঁটতে পারবেন। তবে হাঁটার সময়ে ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ কোনো আলোচনা করতে পারবেন না। এ ধরনের আলোচনা করে ধরা পড়লে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে সতর্ক করা হয়েছে।
কেউ যেন অর্থ দিয়ে মোবাইল ফোন ব্যবহার না করেন, সে নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। পুরো বিষয়টি কারা কর্তৃপক্ষ মনিটর করছে বলে তাদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এক কারা কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যেসব মন্ত্রী-এমপি, বিভিন্ন বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তারা রয়েছেন, প্রত্যেকেই প্রভাবশালী। ফলে তাদের সতর্কতার সঙ্গে ‘ডিল’ করতে হয়। তাদের কেউ কেউ তল্লাশি করতে যাওয়ার পর কারা কর্মকর্তা-রক্ষীদের ওপর নাখোশ হয়েছেন।
তারা ধমকের সুরেও কথা বলেছেন। তিনি বলেন, কারা কর্মকর্তারা এ ধরনের বন্দি নিয়ে উভয় সংকটে পড়েন। একদিকে এই বন্দিরা অবৈধ সুবিধা নিতে চান, না দিলে ক্ষিপ্ত হন। কারারক্ষীদেরও তাদের সমীহ করে চলতে হয়। অন্যদিকে সরকার থেকে নজর রাখা হয় তারা কী করছেন; তাদের কোনো সুযোগ-সুবিধা কেউ দিচ্ছে কি না।
সূত্র জানায়, প্রভাবশালী বন্দিদের মধ্যে যারা নিয়ম-কানুন মানছেন না, তাদের চিহ্নিত করে কঠোর হতে যাচ্ছে কারা কর্তৃপক্ষ। এরই মধ্যে শীর্ষ পর্যায়ের তিনজনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের শাস্তি হিসেবে অন্য একটি কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
জানতে চাইলে আইজি প্রিজনস ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মোহাম্মদ মোতাহের হোসেন বলেন, ‘আমরা কারাগারে নজরদারি বাড়িয়েছি। কোনো বন্দি যাতে বিধিবহির্ভূত সুযোগ নিতে না পারেন, সেগুলো খেয়াল রাখা হচ্ছে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এর আগে ২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেনের পর গ্রেপ্তার হয়েছিলেন সালমান এফ রহমানসহ অনেক প্রভাবশালী। সালমান এফ রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীরকে রাখা হয়েছিল তৎকালীন পুরান ঢাকার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের কর্ণফুলী সেলে। তাদের ডিভিশন দেওয়া হয়েছিল। ওই বছর তাদের কক্ষ থেকে মোবাইল ফোন উদ্ধার করে কারা কর্তৃপক্ষ। এরপর শাস্তি হিসেবে তাদের ডিভিশন বাতিল করা হয়েছিল। অনেককেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে দূরের কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
জানতে চাইলে কারা বিশেষজ্ঞ ও সাবেক ডিআইজি প্রিজনস মেজর (অব.) শামসুল হায়দার ছিদ্দিকী বলেন, প্রভাবশালী বন্দিদের নিয়ন্ত্রণ করাটা কঠিন। কারাগারে অনিয়ম করলে সাধারণ বন্দিদের শাস্তি দেওয়া যায়, কিন্তু মন্ত্রী-এমপিসহ প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সে ধরনের শাস্তি দেওয়া হয় না। তবে তাদের অন্য কারাগারে বদলি, ডিভিশন বাতিল, পরিবারের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ বন্ধের মতো শাস্তি দেওয়া যায়। কারা কর্তৃপক্ষ তার ঝুঁকি বিবেচনায় শাস্তির ব্যবস্থা করে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রভাবশালী বন্দিরা দেশের আইন-কানুন সম্পর্কে জানেন। এর পরও তারা কারাবিধিবহির্ভূত সুবিধা চান। অনেকে ভয়ে বা আর্থিক সুবিধা নিয়ে তাদের সুবিধা দিয়ে থাকে। তবে সুবিধা নিয়ে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করলে সেটি ভয়ংকর অবস্থার সুযোগ থাকে।’
২০০৭ সালে শামসুল হায়দার ছিদ্দিকী ঢাকা বিভাগের ডিআইজি প্রিজনসের দায়িত্বে ছিলেন। তখন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াও কারান্তরিন ছিলেন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অনেক জাঁদরেল নেতা একসঙ্গে বন্দি ছিলেন। তখন তারা কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা অতি প্রভাবশালীদের একজনের সঙ্গে আরেকজনের দেখা করার সুযোগ দিইনি। তাদের কক্ষের আলাদা গেট ছিল। এর পরও যারা কারাগারের নিয়ম ভেঙেছেন তাদের ডিভিশন বাতিল, স্বজনদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ বন্ধ করে দেওয়ার মতো শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। জেলা কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়ার নজিরও আছে।’
তিনি জানান, কারা কর্তৃপক্ষের উচিত হবে ভিআইপি বন্দিরা যখন একসঙ্গে হাঁটেন তখন একজন কারারক্ষীকে উপস্থিত রাখা। তারা কী আলোচনা করছেন সেটার নোট রাখবেন তিনি। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক আলোচনা করলে সেটি আইজি প্রিজনসের কাছে পাঠাতে হবে।
কারা সূত্র জানায়, বর্তমানে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ৬৮ ভিআইপি বন্দি রয়েছেন। তাদের মধ্যে সাবেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী রয়েছেন আনিসুল হক, আবদুর রাজ্জাক, রাশেদ খান মেনন, সাধন চন্দ্র মজুমদার, ফরহাদ হোসেন, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, ফারুক খান, র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী, ইমরান আহমেদ, টিপু মুনশি, হাসানুল হক ইনু, কামাল আহমেদ মজুমদার, শামসুল হক টুকু, এ বি তাজুল ইসলাম, জুনাইদ আহমেদ পলক।
এছাড়া আছেন সাবেক এমপি হাজি সেলিম, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক এমপি কাজী জাফর উল্যাহ, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলাম, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, শহিদুল হক, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা (এনএসআই) সংস্থার সাবেক পরিচালক কমোডর মনিরুল ইসলাম, সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান, চট্টগ্রাম বন্দরের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল, সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুস সোবহান গোলাপ, ঢাকা জেলার সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহ হিল কাফী,
সাবেক সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন, নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার, ডিএমপির সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া, সাবেক বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির, পুলিশের সাবেক ডিসি মশিউর রহমান, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন প্রমুখ।