ডেস্ক রির্পোট:- বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় অফিসে বসে নেপথ্যে থেকে মাঠ পুলিশকে দিয়ে হাজার হাজার ছাত্র-জনতাকে গুলি করে হত্যা-আহত করার নেপথ্যে জড়িত পুলিশ কর্মকর্তারা এখনও নিয়ন্ত্রণ করছে পুরো পুলিশ বাহিনী। গত ১৫ বছর ধরে বৈষম্যে শিকার মেধাবী পুলিশ কর্মকর্তাদের রেখে বিগত আওয়ামী সময়ের সুবিধাবাধী পুলিশ কর্মকর্তাদের ওসি, এসপি ও ডিআইজিসহ পুলিশের নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে বদলি-পদায়নে এদের ভূমিকা এখনও মুখ্য। নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে ছাত্র-জনতাকে গুলি করে পিটিয়ে খুন-আহত করার পর শতাধিক পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। ঊর্ধ্বতনদের বেশ কয়েকজন দেশ থেকে পালিয়েও গেছেন। অন্তর্বতী সরকার গঠনের পর পুলিশ বাহিনীতে ব্যাপক রদবদল হলেও পুলিশ সদর দফতরে কর্মরত এসব আওয়ামী সুবিধাভোগী কর্মকর্তার গায়ে কোনো আঁচ লাগেনি। এভাবে কর্মকর্তাদের দীর্ঘদিন শুধু পুলিশ সদর দপ্তরে কর্মরত থাকার বিষয়টি নিয়মের লঙ্ঘন ও পুলিশের শৃঙ্খলার পরিপন্থী বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন বোতলেই ঢুকছে পুরনো মদ। এক সময় ছাত্রলীগ ক্যাডার পরিচয় দেয়া এসব কর্মকর্তা ৫ আগস্টের পর অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেদের ‘বঞ্চিত’ বলে জাহির করারও চেষ্টা করেন। অথচ আন্দোলনে গুলি চালিয়ে লাশ ফেলার মাস্টারমাইন্ড হিসেবে কাজ করেছেন এসব পুলিশ কর্মকর্তাদের অনেকেই। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নিয়োগ বাণিজ্যে সিন্ডিকেটের সরাসরি নেতৃত্ব দেয়া এবং ব্যক্তিগতভাবে প্রচুর ঘুষ গ্রহণ করে মেধাবী ও যোগ্য প্রার্থীদের নিয়োগবঞ্চিত করা পুলিশ কর্মকর্তাও রয়েছেন এ গ্রæপে। এর বাইরেও পুলিশ সদর দপ্তরে আইসিটি শাখায় কর্মকালীন কেনাকাটা এবং সফটওয়্যার নির্মাণে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি করেছেন এমন অভিযোগে অভিযুক্ত কর্মকর্তাও রয়েছে। পুলিশ সদর দফতরের একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা ইনকিলাবকে জানিয়েছেন, ৪ থেকে সর্বোচ্চ ১৪ বছর ধরে সদর দপ্তরে কর্মরত আছেন এমন কর্মকর্তার সংখ্যা অন্তত ৫০ জন। বিগত ১৫ বছর ধরে পুলিশ বাহিনীতে যে ব্যাপক দুনীতি হয়েছে, এসব দুনীতির অংশীদারও ছিলেন পুলিশ সদরদফতরে কর্মরত অনেক কর্মকর্তাই। তাদের কেউ কেউ প্রভাবশালীদের কাছাকাছি থাকার সুবাদে বদলিও ঠেকিয়েছেন বছরের পর বছর। সরকার বদলের পর এরাই এখন বঞ্চিত সেজে প্রভাব বিস্তার করছেন পুরো পুলিশ বাহিনীতে। অনেকেই বিএনপির প্রভাবশালী একজন নেতার নাম ভাঙ্গিয়ে আখেড় গোছানোর চেষ্টা করছেন। যা পুরো পুলিশ বাহিনীর সংস্কারে মারাত্মক ক্ষতি করবে।
ওই কর্মকর্তারা আরও জানিয়েছেন, সরকারি চাকরিবিধি ও পুলিশ প্রবিধানে প্রতি তিন বছর পর বদলির নিয়ম থাকলেও পুলিশ বাহিনীর অনেক কর্মকর্তা ঘুরেফিরে সদর দপ্তরেই থাকছেন। তাদের মধ্যে কয়েকজন এক যুগের বেশি সময় ধরে আছেন। অভিযোগ রয়েছে, বিগত সরকারের আস্থাভাজন ও ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুবাদে এসব কর্মকর্তা এত দিন ধরে সদর দপ্তরে শিকড় গেড়ে আছেন। সদর দপ্তরে থাকা এসব কর্মকর্তার মধ্যে আছেন অতিরিক্ত আইজিপি, ডিআইজি, অতিরিক্ত ডিআইজি, পুলিশ সুপার ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কর্মকর্তা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশ সদর দফতরের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, গত দেড় দশকে পুলিশের কাজ নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। ধীরে ধীরে এগুলো নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। মাঠের পুলিশিং ঠিক করে পুলিশ সদর দপ্তরেও হাত দেয়া হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অনেক সময় বাহিনীর স্বার্থে বিশেষায়িত কাজের জন্য অভিজ্ঞদের একই জায়গায় রাখা হয়। তবে সেটা খুব বেশি না। এভাবে কর্মকর্তাদের দীর্ঘদিন শুধু সদর দপ্তরে কর্মরত থাকার বিষয়টি নিয়মের লঙ্ঘন ও পুলিশের শৃঙ্খলার পরিপন্থী হলেও সব বিষয়ে পুলিশ প্রধান অবগত রয়েছেন। পুলিশ প্রধান বাহিনী পুন;গঠন ও আইন-শৃংখলা উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করছেন বলে ওই কর্মকর্তা মন্তব্য করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের একজন শিক্ষক বলেন, পুলিশে মৌলিক সংস্কার এখন সময়ের দাবি। কোনো দলের লাঠিয়াল হিসেবে নিজেদের সঁপে দেয়া উচিত হবে না এই বাহিনীর কর্মকর্তাদের। পুলিশ রাষ্ট্র ও জনগণের জন্য, এটা উপলব্ধি করতে হবে। উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে আইনি প্রক্রিয়াগুলো যদি অনুসরণ করা যায় তাহলে জনগণের মধ্যে পুলিশ নিয়ে স্বস্তি ফিরবে। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, পুলিশ বাহিনীর সদর দপ্তরে তিনটি মূল বিভাগ অ্যাডমিন ও অপারেশন, অর্থ ও উন্নয়ন এবং মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা (এইচআরএম)। এই তিন বিভাগের অধীনে অন্তত ৫৩টি শাখা ও উপশাখা রয়েছে। আইজিপি এসব শাখা প্রধানদের দিয়ে প্রায় সোয়া দুই লাখ সদস্যের পুলিশ বাহিনীকে পরিচালনা করেন। এসব শাখা-উপশাখায় ৭ জন অতিরিক্ত আইজিপি, ১২ জন ডিআইজি, ৩৮ জন অতিরিক্ত ডিআইজি, পুলিশ সুপার পদমর্যাদার ৫৩ জন এআইজি এবং অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, সহকারী পুলিশ সুপারসহ প্রায় ২০০ কর্মকর্তার পদায়ন থাকে। বর্তমানে তাদের অন্তত অর্ধশত রয়েছেন সর্বনি¤œ ৪ থেকে সর্বোচ্চ ১৩ বছর ধরে।
সূত্র জানিয়েছেন, ১২তম ব্যাচের কর্মকর্তা অতিরিক্ত আইজিপি আবু হাসান মুহম্মদ তারিক। তিনি বর্তমানে পুলিশ সদর দফতরের অতিরিক্ত আইজিপি প্রশাসনের দায়িত্বে রয়েছেন। পদোন্নতি বা অন্য কোন কারনে দু’একবার পুলিশ সদর দফতরের বাইরে কিছু দিনের জন্য বদলি হলেও গত ১৪ বছর ধরে নানা পদে কর্মরত রয়েছেন তিনি। পুলিশ বাহিনীর বহুল আলোচিত সমালোচিত কোর কমিটির একজন সদস্যও ছিলেন তিনি। যে কোর কমিটি আওয়ামীলীগ সরকারের সময় সারাদেশের পুলিশের নিয়োগ, কেনাকাটা ও বদলির নিয়ন্ত্রণ করতো। তার পরেই রয়েছেন ডিআইজি আমিনুল ইসলাম। তিনি বর্তমানে পুলিশ সদর দফতরের ডিআইজি ট্রেনিং হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। ডিআইজি (উন্নয়ন) রুহুল আমিন ২০১৩ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত দিনাজপুরের পুলিশ সুপার ছিলেন। এরপর ডিএমপিতে বদলি হন। ডিএমপিতে থাকা অবস্থায় পদোন্নতি পেয়ে পুলিশ সদর দপ্তরে অতিরিক্ত ডিআইজি (ওয়েলফেয়ার) ছিলেন। চার বছরের বেশি সময় ধরে পুলিশ সদর দপ্তরে কর্মরত থাকা রুহুল আমিন এর আগে ডিআইজি (লজিস্টিকস) ছিলেন। ডিআইজি আব্দুল্লাহ হেল বাকি ও আব্দুল জলিলও দীর্ঘদিন পুলিশ সদর দপ্তরে আছেন।
সূত্র বলছে, সদর দপ্তরে কর্মরত অতিরিক্ত ডিআইজিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে আছেন আলোচিত কর্মকর্তা গাজী মো. মোজাম্মেল হক। তিনি সদর দপ্তরে আছেন প্রায় এক যুগ। পূর্বাচলে ‘আনন্দ পুলিশ হাউজিং সোসাইটি’ নামে একটি আবাসন প্রকল্প করে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। যা দুদক তদন্ত করছে। পুলিশ হাউজিং এক, দুই ও তিনে কোটি কোটি টাকা তসরুপের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। অন্য অতিরিক্ত ডিআইজিদের মধ্যে ডিঅ্যান্ডপিএস-২ শাখার এহসান সাত্তার, ওভারসিজ অ্যান্ড ইউএন অপারেশন শাখার নাসিয়ান ওয়াজেদ, এমটি অ্যান্ড ওয়ার্কশপ শাখার মো. আবু হাসান, লিগ্যাল অ্যাফেয়ার্স শাখার মো. জিয়াউর রহমান, অতিরিক্ত ডিআইজি শাহজাদা আসাদুজ্জামান, আতিকুর রহমান, নাসিরুল হক, পিএম-২ শাখার মো. জহিরুল ইসলাম পুলিশ সদর দপ্তরে আছেন ৫ থেকে ১০ বছর। পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের মধ্যে এআইজি (এস্টেট) সাইফুল্লাহ বিন আনোয়ার, এআইজি (ইক্যুইপমেন্ট) মুহাম্মদ উল্লাহ, এআইজি (ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা) মিলন মাহমুদ, এআইজি মো. মঞ্জুরে আলম প্রামাণিক, এআইজি আলী হায়দার চৌধুরী। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কর্মকর্তা ফেরদৌসী রহমান, মো. মোস্তাফিজুর রহমান, সাদিয়া আফরিনও দীর্ঘদিন ধরে পুলিশ সদর দপ্তরে কর্মরত।
পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বলেন, কাজের গুরুত্ব বিবেচনা করে কর্মকর্তাদের কখনো কখনো দীর্ঘ সময় একই পদে রাখা হয়। কারো বিরুদ্ধে কোন সুনিদিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহন করা হয় ও হচ্ছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।ইনকিলাব