ডেস্ক রির্পেট:-গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশে কোনো বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটেনি বলে দাবি করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এই দুই মাসে সারা দেশে কমপক্ষে ৪৯ জনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আইনজীবী ও রাজনীতিবিদরা বলছেন, বিচারিক প্রক্রিয়া ছাড়া যেকোনো হত্যাই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং এসবের দায় সরকারকে নিতে হবে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে সারা দেশে গণপিটুনিতে প্রাণ গেছে ৪৯ জনের। তবে মাত্র তিনটি ঘটনায় ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ পুলিশ সদর দপ্তরের দাবি, তারা বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের দীঘিনালার ঘটনার পর গত মঙ্গলবার পাহাড়ে আরো একজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে৷ খাগড়াছড়িতে ধর্ষণের অভিযোগে আবুল হাসনাত মোহাম্মদ সোহেল রানা নামের ওই শিক্ষকে পিটিয়ে হত্যার পর পাহাড়ি-বাঙালি সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় সেখানে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়৷ তারপরও সংঘর্ষ এবং বাড়িতে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটেছে৷
এর আগে ১৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় চোর সন্দেহে মো. মামুন নামে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এর জের ধরে খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষে ৪ আদিবাসী নিহত হন। অনেক ঘরবাড়িতে হামলা এবং অগ্নিসংযোগ করা হয়। আগুনে পুড়ে যায় অনেক বাড়ি-ঘর৷
মানবাধিকার কর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের হানিমুন পিরিয়ড শেষ হয়ে গেছে। দুই মাসেও তারা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে পারছেন না— এটা মেনে নেয়া যায় না৷’
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘কোনো কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তির নানা ধরনের দায়িত্বহীন কথাও পরিস্থিতি খারাপ করছে৷’
বিশ্বিবদ্যালয়সহ নানা স্থানে বিচারবহির্ভূত হত্যা
গত ১৮ সেপ্টেম্বের দেশের দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিটিয়ে মারা হয় দুজনকে৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তোফাজ্জল হোসেন নামের এক যুবককে চোর অপবাদে দিয়ে রীতিমতো পরিকল্পনা করে পিটিয়ে হত্যা করা হয়৷ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা শামীম আহমেদ ওরফে শামীম মোল্লাকে৷
এর আগে ৮ সেপ্টেম্বর রাজশাহীতে পিটিয়ে হত্যা করা হয় পঙ্গু সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আব্দুল্লাহ আল মাসুদকে। এদিকে চট্টগ্রামে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে নাচ-গান করে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যার এক মাস পর সেই হত্যাকাণ্ডের ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে৷
আসক বলছে, জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর— চলতি বছরের এই নয় মাসে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ৮১ জনকে গণপিটুনিতে বা পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে৷ এর মধ্যে আগস্টে ২১ জনকে হত্যা করা হয়েছে, আর ২৮ জনকে সেপ্টেম্বরে হত্যা করা হয়েছে। অর্থাৎ, এই দুই মাসে ৪৯ জনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে৷ আগের সাত মাসে এমন ঘটনা অনেক কম৷ ওই সাত মাসে মাত্র ৩১ জনের মৃত্যু হয় গণপিটুনিতে৷
১০ বছর আগে হাত-পায়ের রগ কাটা হয়েছিল, এবার সেই ছাত্রলীগ নেতাকে পিটিয়ে হত্যা১০ বছর আগে হাত-পায়ের রগ কাটা হয়েছিল, এবার সেই ছাত্রলীগ নেতাকে পিটিয়ে হত্যা
গণপিটুনির বাইরে পুলিশ ও যৌথ বাহিনীর হেফাজতেও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে৷ গাইবান্ধা ও ময়মনসিংহে এ পর্যন্ত তিনজনের মৃত্যু হয়েছে পুলিশ ও যৌথ বাহিনীর হেফাজতে৷
তবে নবনিযুক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামানের দাবি— ৫ আগস্টের পর থেকে দেশে বিচারবহির্ভূত কোনো হত্যার ঘটনা ঘটেনি৷
কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘বিচারিক প্রক্রিয়া ছাড়া— সেটা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী হোক আর গুপপিটুনিতে হোক— সবই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। এই যে মব জাস্টিসের নামে হত্যার ঘটনা ঘটছে, এর দায় তো সরকারকে নিতে হবে৷ এসবও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড৷ জনগণের জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্ব তো সরকারের৷’
তিনি আরো বলেন, ‘হত্যা ছাড়াও আরো অনেক ধরনের মব জাস্টিসের ঘটনা ঘটছে৷ রাষ্ট্রের যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা দরকার, সেটা হয়নি৷ স্থিতিশীলতা আসেনি৷ এখন যারা রাষ্ট্র পরিচালনায় আছেন, তাদের কঠিনভাবে দক্ষতার সঙ্গে যে ব্যবস্থা নেয়া উচিত ছিল, তারা সেটা নেননি৷ হয়ত তাদের সেই দক্ষতা নাই৷ এরপর পুলিশ বাহিনীকে ডিমরালাইজ করা হয়েছে৷ তাদের মনোবল ভেঙে দেয়া হয়েছে৷ এইসব কারণেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে৷’
ঢাবি ও জাবিতে দুজনকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যাঢাবি ও জাবিতে দুজনকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা
তার ভাষ্য, ‘এখন বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড মব জাস্টিস হচ্ছে৷ এই ধরনের ঘটনা আরো ঘটবে, যদি এই পরিস্থিতিকে স্ট্রংলি হ্যান্ডেল করা না হয়। আইন-শৃঙ্খলাসহ সব ক্ষেত্রেই যে অস্থির পরিস্থিতি চলছে, বিচারাঙ্গনেও অস্থিরতা আছে— এগুলো স্বাভাবিক করতে হবে৷’
মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন, ‘এখন পর্যন্ত যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, সেগুলোর ব্যাপারে ব্যতিক্রম ছাড়া কোনো পদক্ষেপ আমরা নিতে দেখিনি৷ ফলে মব জাস্টিস উৎসাহিত হচ্ছে৷ যদি কাঠোর ব্যবস্থা নেয়া হতো, তাহলে এগুলো ঘটতো না৷’
তিনি বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে এক শিক্ষককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে৷ আগেও একই ঘটনা সেখানে ঘটেছে৷ ফলে ওই এলাকায় এক অস্থির পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে৷ এর পেছনে কোনো গোষ্ঠীর হাত থাকতে পারে৷ কিন্তু সরকারকে তো সেটা বের করতে হবে৷ আসলে বিচারহীনতার সংস্কৃতি অব্যাহত আছে৷ ফলে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে৷’
এসব ঘটনায় সরকারের ‘অনেকটা নমনীয় ভূমিকা’ থাকায় পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না বলে মনে করেন সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স। তিনি বলেন, ‘আমরা বলেছিলাম, রাজনৈতিক দলসহ সবার সঙ্গে কথা বলে একটা নীতিমালা করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করতে। কিন্তু ছাত্রদের পরামর্শে সব করা হচ্ছে। ছাত্রসহ আরো কিছু লোকের ওপরে সবকিছু ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এখন পরিস্থিতি এমন হয়েছে, একটা মবের মধ্য দিয়ে যেন সব কিছু আদায় করা যাবে, সেরকম প্রবণতা তৈরি হয়েছে— এটা একটা ভয়াবহ প্রবণতা৷’
আর বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, ‘যারা ফ্যাসিবাদের বিরোধিতা করেছেন, তারা যদি মব জাস্টিস করেন, সেটা দুঃখজনক৷ আর প্রতিহিংসাপরায়ন না হয়ে আমাদের আইনের শাসনের দিকে যেতে হবে। সেটা করতে না পারলে আমরা সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারব না।’
অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান দেশের বাইরে থাকায় বিষয়টি নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি৷ তবে ‘মব জাস্টিস’ বন্ধ করতে পুলিশ সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে বলে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর দাবি করেছেন।
ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘পুলিশ সদর দপ্তরে আইজিপি মহোদয় পুলিশ কর্মকর্তাদের বৈঠকে মব জাস্টিস বন্ধ করতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করতে বলেছেন৷ দেশের থানাসহ সব পুলিশ ইউনিটকেও নির্দেশ দেয়া হয়েছে৷ আর এই ধরনের ঘটনা কোথাও ঘটলে পুলিশকে দ্রুত খবর দিতে জনসাধারণকে বার বার অনুরোধ করা হচ্ছে৷ পুলিশ সর্বনিম্ন সময়ের মধ্যে রেসপন্স করবে৷’’
এই পুলিশ কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণপিটুনির ঘটনায় ছয় জনকে গ্রেপ্তার করেছি৷ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় দুইজন এবং চট্টগ্রামে নাচ-গান করে একজনকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ বাকি ঘটনায় আমাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত আছে৷ আর এখনতো অধিকাংশ ঘটনার ভিডিও ফুটেজ পাওয়া যায়৷ তাই, আশা করি বাকিদের গ্রেপ্তার সহজ হবে৷’আজকের পত্রিকা