ডেস্ক রির্পোট:- ছেলের ছাগল-কাণ্ডে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য (শুল্ক ও আবগারি) ও ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালের অব্যাহতি পাওয়া প্রেসিডেন্ট ড. মতিউর রহমানের প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ লাকির বাড়ি নরসিংদীতে। জেলার রায়পুরা উপজেলা চেয়ারম্যান তিনি। লাকি ও তাঁর ছেলে আহমেদ তৌফিকুর রহমান অর্ণবের নামে বিপুল সম্পত্তি রয়েছে নরসিংদী, গাজীপুর ও ঢাকায়। এমনকি নির্বাচনী হলফনামায় ৮৫ কোটি টাকার সম্পদ থাকার কথা উল্লেখ করেছেন লাকি।
নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার মরজাল ইউনিয়নের মরজাল গ্রামে লায়লা কানিজ লাকির বাবার বাড়ি। এলাকায় অনেকের সম্পত্তি দখল করে নিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। এ নিয়ে জেলা প্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশনেও (দুদক) অভিযোগ দিয়েছিলেন ভুক্তভোগীরা। এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা হয়নি।
শিক্ষকতা ছেড়ে রাজনীতিতে
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, লায়লা কানিজ লাকি একসময় ঢাকার সরকারি তিতুমীর কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ছিলেন। শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে রাজনীতিতে যোগ দিয়ে প্রথমে রায়পুরা উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য হন। স্থানীয় সংসদ সদস্য রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ২০২৩ সালে রায়পুরা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুস ছাদেকের মৃত্যুতে উপনির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন লাকি। জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও দুর্যোগবিষয়ক সম্পাদকের পদ বাগিয়ে নেন।
সর্বশেষ নরসিংদী জেলা পরিষদ নির্বাচনে নৌকার মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। চলতি বছর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সংরক্ষিত নারী আসন (নরসিংদী-গাজীপুর আসন) পেতে দলীয় কার্যালয়ে মনোনয়ন ফরম জমা দেন। ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তৃতীয় ধাপে গত ২৯ মে টেলিফোন প্রতীক নিয়ে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কথা ছিল। ওই উপজেলায় ভোট গ্রহণের আগে ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী মো. সুমন মিয়ার মৃত্যুতে নির্বাচন স্থগিত করা হয়। ২৬ জুন পুনঃ তফসিল ঘোষণার কথা রয়েছে।
মতিউরের স্ত্রী লায়লার নামেই ৮৫ কোটির সম্পদ
গ্রামের বাড়ি মরজালে কয়েক একর জমির ওপর গড়ে তোলা হয়েছে ওয়ান্ডার পার্ক ও ইকো রিসোর্ট। নিজ বাড়িতে গড়েছেন দৃষ্টিনন্দন ‘লাকি কটেজ’। বাড়ির পাশে সড়কের নামও রাখা হয় ‘লায়লা কানিজ লাকি সড়ক’।
এ ছাড়া গাজীপুরের পুবাইলে ‘আপন ভুবন’ নামে বিনোদন পার্ক ও পিকনিক স্পট রয়েছে লাকির মালিকানায়। লাকি ও তাঁর ছেলে আহমেদ তৌফিকুর রহমান অর্ণবের নামে শূন্য দশমিক ৪৫১৬২৫ একর জমি রয়েছে সেখানে।
পুবাইলের গ্লোবাল শুজ লিমিটেড কোম্পানির অংশীদার হিসেবে নাম রয়েছে লাকির। ওই কোম্পানির নামে জোত ১২৫-এ ৩৪৩৪৫ শতক, জোত ৭০-এ ২৮০০ শতক, জোত ৯০-এ শূন্য দশমিক ০৩৩০ শতক জমি রয়েছে।
এ ছাড়া ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ডি ব্লকের ৭/এ রোডের ৩৮৪ নম্বর বাড়িতে লাকির নামে রয়েছে ফ্ল্যাট। সাভারের বিলামালিয়া মৌজায় খতিয়ান ১৩৬৯৬-এ ১৪ দশমিক ০৩ শতাংশ জমিও রয়েছে।
সর্বশেষ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনী হলফনামার তথ্যমতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে লায়লা কানিজ লাকির আয় দেখানো হয়েছে ৩৪ লাখ ৫৫ হাজার ৩১৪ টাকা। মোট সম্পদ দেখানো হয় ৮৫ কোটি টাকার।
জমি দখলের অভিযোগ
লাকিদের হাতে জমি হারানো মরজালের বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘ভুয়া দলিলে লাকি আমাদের ২০৫ শতক জমি জোরপূর্বক দখল করে রেখেছেন। তাঁর দখলের কারণে বাকিটা অন্যত্র বিক্রিও করতে পারছি না। এ নিয়ে ২০১৮ সালে বিভাগীয় কমিশনার, দুদক, জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত অভিযোগ দিই। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো সুরাহা হয়নি।’
দখলের শিকার আরেক ভুক্তভোগী নজরুল ইসলাম বলেন, ‘প্রথমে দুই শতক জমি ১০ লাখ টাকা চুক্তিতে কিনে নেন লাকি। আমি বাড়িতে না থাকায় পরে ৪ লাখ টাকা দিয়ে বাকি দুই শতকও সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে দখলে নেন।’ এ ঘটনায় তিন বছর আগে বিভাগীয় কমিশনার, দুদক, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অভিযোগ দিয়েছেন বলে জানান নজরুল।
সুজাৎ আলী মাস্টার নামে আরেক ভুক্তভোগী বলেন, ‘চার বছর আগে লাকি এবং তাঁর লোক নুরুজ্জামান ও রুহুল আমিন আমার স মিল, গাছপালা, ঘর ভেঙে জোরপূর্বক ৪২ শতক জমি দখলে নেন। এ বিষয়ে এসপি, ডিসি বরাবর লিখিত অভিযোগ দিই। তদন্ত করতে কেউ এলেই তাঁদের টাকা দিয়ে নিজেদের পক্ষে নিয়ে নেন লাকি। এতে কাজ না হলে কোর্টে মামলা করি, যা চলছে।’
মরজাল ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান সাজিদা সুলতানা নাসিমা বলেন, ‘লাকি রায়পুরার ত্রাস। তাঁদের অবৈধ টাকার কারণে রাজু এমপির মতো লোক তাঁর ভক্ত হয়ে গেছেন। আমি নিজেই অনেক সাফারার সবাই জানে।’
অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে লায়লা কানিজ লাকির মোবাইল ফোন নম্বরে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁর সাড়া পাওয়া যায়নি।
আর লাকির বিষয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য (এমপি) রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর বক্তব্য জানতে যোগাযোগ করা হলে তাঁর মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। এমপির ঘনিষ্ঠজনেরা জানিয়েছেন, রাজু অসুস্থ থাকায় চিকিৎসার জন্য বিদেশে রয়েছেন।
কর্মস্থলে অনুপস্থিত লায়লা
রায়পুরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান লায়লা কানিজ লাকি ঈদের ছুটি শেষে তিন কর্মদিবস অনুপস্থিত। গতকালও উপজেলা পরিষদে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। তিনি কোথায় আছেন তা কেউ বলতে পারছেন না।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইকবাল হোসেন বলেন, ‘গত তিন কর্মদিবস উনাকে দেখতে পাইনি।’আজকের পত্রিকা