ডেস্ক রির্পোট:- ভেজাল আর নকলে সয়লাব দেশ। জীবন বাঁচাতে রোগীকে দেওয়া হচ্ছে ওষুধ। আর সেই ওষুধেই মৃত্যু হচ্ছে রোগীর। ফর্সা হতে ক্রিম ব্যবহার করে উল্টো মেছতা পড়ছে ত্বকে। ঝলসে যাচ্ছে চামড়া। প্রসিদ্ধ ব্র্যান্ডের মোড়ক নকল করে বিক্রি হচ্ছে ভেজাল পণ্য। নকল বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের কারণে হরহামেশা ঘটছে অগ্নিদুর্ঘটনা। খাবারে মেশানো হচ্ছে বিষাক্ত রং ও রাসায়নিক। নিষ্পাপ শিশুর খাদ্যেও মেশানো হচ্ছে ভেজাল। এতে স্বাস্থ্যগত ও আর্থিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন মানুষ। ঘটছে অপমৃত্যু। বাড়ছে অসুস্থ মানুষের সংখ্যা। দিনের পর দিন প্রকাশ্যে এমন অনিয়ম চললেও সরকারের তদারকি সংস্থাগুলো যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। মাঝেমধ্যে ভেজালবিরোধী অভিযান চালানো হলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। উল্টো মানুষের জীবন নিয়ে খেলা করা এসব প্রতারকরা কিছুদিনের মধ্যে আবারও একই কাজে ফিরছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, খাদ্যপণ্য, জ্বালানি তেল, ভোজ্য তেল, পশুখাদ্য, ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম, শিশুখাদ্য, বেকারি পণ্য, খাবার পানি, প্রসাধনী থেকে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ- সব কিছুতেই মেশানো হচ্ছে ভেজাল। নামি দামি ব্র্যান্ডের নাম ব্যবহার করে বাজারে ছাড়া হচ্ছে নকল পণ্য। ভেজাল জ্বালানি তেলের কারণে নষ্ট হচ্ছে কোটি টাকার গাড়ি। কিটক্যাট, লাভ ক্যান্ডি, রোলানা, সাফারি, ফাইভ স্টার, ক্যাডবেরি, বাবলিসহ বিশ্বখ্যাত নানা ব্র্যান্ডের চকলেট তৈরি হচ্ছে কেরানীগঞ্জের জিনজিরা এলাকার টিনশেড ঘরে। শিশুদের পছন্দের এসব চকলেট হুবহু নকল করে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সারা দেশে। তৈরি হচ্ছে জনসন অ্যান্ড জনসন, পন্ডস, কডমোসহ বিভিন্ন বিদেশি ব্র্যান্ডের কসমেটিক্স, বিদেশি পাউডার ড্রিঙ্কস, জুস, চিপস, ডায়াপারসহ বিভিন্ন পণ্যের নকল।
এ ছাড়া পোলট্রি ফার্মের ডিমে পাওয়া গেছে ট্যানারি বর্জ্যরে বিষাক্ত ক্রোমিয়াম। আটায় মেশানো হচ্ছে চক পাউডার বা ক্যালসিয়াম কার্বনেট। আম গাছে মুকুল ধরা থেকে শুরু করে আম পাকা পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে ব্যবহার করা হচ্ছে রাসায়নিক। মিষ্টিজাতীয় খাবারে ব্যবহার করা হচ্ছে বিষাক্ত রং, সোডা, স্যাকারিন ও মোম। কাপড়ের বিষাক্ত রং, ইট ও কাঠের গুঁড়া মেশানো হচ্ছে খাবারের মসলায়। ফলমূল দ্রুত পাকিয়ে রঙিন বানাতে কার্বাইড, ইথোফেন আর পচন রোধে ফরমালিন প্রয়োগ করা হচ্ছে। এসব পণ্য কিনে প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছেন ক্রেতারা। সাম্প্রতিক সময়ে ক্যান্সার, লিভার-কিডনি বিকল হওয়া, হৃদরোগ, ডায়াবেটিসসহ নানা রোগের প্রকোপ বৃদ্ধির পেছনে ভেজাল খাদ্যকে অন্যতম কারণ বলে মনে করা হয়। পরিবেশ বাঁচাও অন্দোলনের (পবা) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু ভেজাল খাদ্য গ্রহণের কারণে প্রতি বছর দেশে ৩ লাখ লোক ক্যান্সারে, ২ লাখ লোক কিডনি রোগে, দেড় লাখ লোক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। এ ছাড়া গর্ভবতী মা ১৫ লাখ বিকলাঙ্গ শিশুর জন্মদান করছেন একই কারণে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, খাদ্যপণ্য, জ্বালানি তেল, ভোজ্য তেল, পশুখাদ্য, ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম, শিশুখাদ্য, বেকারি পণ্য, খাবার পানি, প্রসাধনী থেকে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ- সবকিছুতেই মেশানো হচ্ছে ভেজাল। নামিদামি ব্র্যান্ডের নাম ব্যবহার করে বাজারে ছাড়া হচ্ছে নকল পণ্য। ভেজাল জ্বালানি তেলের কারণে নষ্ট হচ্ছে কোটি টাকার গাড়ি।
ওষুধে ভেজাল এখন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। কয়েক মাস আগে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত এক রোগীকে অ্যালবুমিন ইনজেকশন দেওয়ার পর সেই রোগী মারা যায়। এরপর আরও কয়েকজন রোগীকে ওই ইনজেকশন দেওয়ার পর জটিলতা দেখা দেয়। পরে আইসিইউতে চিকিৎসা দিয়ে তাদের সুস্থ করা হয়। ভেজাল ওষুধের কারণে রোগী মৃত্যুর ঘটনায় পরবর্তীতে সিলেট ওসমানি মেডিকেলের চিকিৎসকরা অ্যালবুমিনের মতো জরুরি ওষুধটি ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নেন। গত বছরের ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) ককলিয়ার ইমপ্লান্টের জন্য অ্যানেসথেসিয়া দেওয়ার পর তিন শিশুর মৃত্যু হয়। ল্যাব টেস্টের রিপোর্টে হ্যালোথেনে ভেজালের তথ্য মেলে। গত তিন-চার মাসে রাজধানী ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও টাঙ্গাইলে অ্যানেসথেসিয়া প্রয়োগের পর শিশুমৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। পরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সারা দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে হ্যালোথেনের পরিবর্তে আইসোফ্লুরেন/সেভোফ্লুরেন ব্যবহার করাসহ বিভিন্ন নির্দেশনা দেয়। কাফকা, রিলায়েন্স ও এমবি ফার্মাসিউটিক্যালস অনেক দিন ধরে ওষুধ উৎপাদন বন্ধ রাখলেও এসব কোম্পানির নাম ব্যবহার করে ঠিকই বাজারে বিক্রি হচ্ছে ওষুধ। এদিকে বিপজ্জনক মাত্রায় পারদ ও হাইড্রোকুইনোন পাওয়ায় ২০২২ সালে ১৭টি রং ফর্সাকারী ক্রিম বিক্রি নিষিদ্ধ করে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)। নিষেধাজ্ঞায় কাজ না হওয়ায় পরের বছর ওই ক্রিমগুলোর সঙ্গে নতুন নাম যোগ করে ১৮টি ক্রিম ও একটি লোশন নিষিদ্ধ করে বিএসটিআই। তবে গত দুই দিন রাজধানীর বিভিন্ন সেলুন ঘুরে ক্রিমগুলো ব্যবহার করতে দেখা গেছে। নিষিদ্ধ ও ভেজাল যৌন উত্তেজক ওষুধ বিক্রি হচ্ছে রাস্তায়। ফিল্টার পানির নামে বিক্রি হচ্ছে দূষিত পানি।
শুধু ঢাকাই নয়, সারা দেশের অলিগলিতে গড়ে উঠেছে নকল ও ভেজাল পণ্য উৎপাদনের কারখানা। গত ২৩ মার্চ কামরাঙ্গীরচরে ভেজাল সেমাই তৈরির বেশ কয়েকটি কারখানায় অভিযান চালিয়ে ভেজাল সেমাই উদ্ধারসহ পাঁচজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এর আগে ১২ মার্চ কাপড়ের রং আর চিনি মিশিয়ে নকল ট্যাং, নকল চানাচুর, ডিটারজেন্টসহ বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনের সময় আবিদ ফুড অ্যান্ড কেমিক্যালস নামে একটি প্রতিষ্ঠানের ফ্যাক্টরিতে অভিযান চালিয়ে মালিককে হাতেনাতে আটক করে বিএসটিআই। গত ২৯ মার্চ ঢাকার কেরানীগঞ্জ, শ্যামপুর ও সূত্রাপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে ভেজাল শিশুখাদ্য উৎপাদন, অনুমোদনহীন নকল বৈদ্যুতিক তার, সুইচসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম তৈরি এবং অবৈধভাবে চাল মজুত করায় ৯ প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করে র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। গত ১ এপ্রিল কিশোরগঞ্জে ভুসির মোড়ক খুলে ধানের তুষ মিশিয়ে পুনরায় মোড়কজাত করে বাজারজাতের অভিযোগের অভিযোগে এক প্রতিষ্ঠানের মালিককে জরিমানা করে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। গত ২৮ মার্চ পাবনা সদর উপজেলার মালিগাছা বাজার এলাকায় অভিযান চালিয়ে নকল স্যালাইনসহ কারখানার মালিককে আটক করে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতর ও র্যাব।
দেশে ২০০৯-১০ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত ভোক্তা অধিদফতর পরিচালিত অভিযান এবং গ্রাহকদের অভিযোগ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অপরাধের শীর্ষে রয়েছে অনুমতি না নিয়ে অবৈধভাবে পণ্য উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণ। এসব কাজে অপরাধ করা হয়েছে ৩৮ হাজার ২৮৯টি, আর এসব অপরাধের জন্য জরিমানা করা হয়েছে ৩২ কোটি ৩ লাখ ৭ হাজার ৪৪০ টাকা। অপরাধের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে পণ্যের মোড়ক ব্যবহার না করা। তৃতীয় স্থানে রয়েছে মেয়াদ উত্তীর্ণ পণ্য বিক্রি, যার মধ্যে অন্যতম ওষুধ। অভিযানে দেখা গেছে, একই প্রতিষ্ঠান একাধিকবার একই ধরনের অপরাধ করেছে।
১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে খাদ্যে ভেজাল দেওয়া এবং ভেজাল খাদ্য বিক্রির সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। এ ছাড়া ১৪ বছরের কারাদণ্ডেরও বিধান রয়েছে এ আইনে। ২০১৫ সালে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ গঠন করা হয়েছে। বিভিন্ন সংস্থা মাঝেমধ্যে ভেজালবিরোধী অভিযান চালালেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। এ ব্যাপারে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, উচ্চতর পর্যায়ে যোগসাজশের দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, আর্থিক অপরাধ, কর ফাঁকি, অর্থ পাচারসহ বহুমুখী লুণ্ঠন ও তার মাধ্যমে বৈধ আয়ের সঙ্গে অসামঞ্জস্য সম্পদ আহরণকে যখন বিচারহীনতার মাধ্যমে স্বাভাবিকতায় রূপান্তর করা হয়, তখন এ ধরনের নৈতিক অবক্ষয় সমাজের সর্বস্তরে যে ব্যাপক বিস্তার লাভ করে, এসব তারই লক্ষণ। উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অপরাধ ও আইন লঙ্ঘনের কার্যকর জবাবদিহিতার ধারাবাহিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে ব্যর্থ হলে ভবিষ্যৎ আরও ভয়াবহ অরাজকতাপূর্ণ ও অন্ধকারাচ্ছন্ন হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হবে।বাংলাদেশ প্রতিদিন