শিরোনাম

সারা পৃথিবীতে এক দিনেই ঈদ হয়!

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় রবিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২৪
  • ১২৮ দেখা হয়েছে

সাইফুল ইসলাম:- শিরোনাম দেখে চমকে উঠলেন! এ কী কথা। যেখানে বহু জ্ঞানী-বিদ্বান এক দিনে সারা বিশ্বে ঈদের জন্য রীতিমতো আন্দোলন-সংগ্রাম করছেন, সেখানে সারা পৃথিবীতে এক দিনে কীভাবে ঈদ হচ্ছে?

হ্যাঁ, এটাই সত্যি যে সারা বিশ্বে এক দিনেই ঈদ হচ্ছে। পয়লা শাওয়াল ঈদুল ফিতর তথা রমজানের ঈদ এবং ১০ই জিলহজ্জ ঈদুল আজহা বা কুরবানির ঈদ উদযাপন হচ্ছে। বিষয়টা খোলাসা করা যাক।

আমরা সবাই জানি, পৃথিবীতে দুই ধরনের বর্ষ গণনা বিদ্যমান। একটি হচ্ছে সৌরবর্ষ, আরেকটি চন্দ্রবর্ষ।

পৃথিবীর সূর্যের চারদিকে একবার ঘুরে আসতে সময় লাগে এক বছর বা এক সৌর বছর। এটা হয় পৃথিবীর বার্ষিক গতির কারণে। এটা একটা সময়ের একক এবং একে ৩৬৫ দিয়ে ভাগ করা যায়।

কারণ নিজের চারদিকে পৃথিবী দিনে একবার ঘুরতে পারে, ফলে এটি বছরে ৩৬৫ বার ঘটে। আর এটাকে সৌর বর্ষে ২৮, ২৯, ৩০ ও ৩১ করে বারটি নির্দিষ্ট মাসে ভাগ করা হয়েছে, যার সমষ্টি হলো ৩৬৫ দিন।

অন্যদিকে চাঁদ পৃথিবীর চারদিকে একবার ঘুরতে গড়ে সময় নেয় সাড়ে ২৯ দিন। ফলে চন্দ্র মাস হয় ২৯ বা ৩০ দিনের এবং কোনো মাসই নির্দিষ্ট দিনের নয়। এ কারণে চন্দ্র তথা হিজরি বর্ষ কখনও ৩৫৪ আবার কখনও ৩৫৫ দিনের হয়। সুতরাং দুই সময়ের হিসাবে বছরে তারতম্য হয়ে যাচ্ছে ১০ কিংবা ১১ দিনের।

এবার আসি এক দিনে ঈদের কাহিনিতে। প্রতি বছর রোজার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষদের, বিশেষত আমাদের দেশের মানুষদের কৌতুহল ও জল্পনা থাকে এবার রোজা কয়টি হবে।

বিশেষ একটা আগ্রহ থাকে সৌদি আরবের সঙ্গে ঈদ হবে কিনা? অথবা সৌদি আরবের সঙ্গে আমাদের মাত্র তিন ঘণ্টার ব্যবধান, তাও আমরা তাদের থেকে তিন ঘণ্টা এগিয়ে থেকেও এক দিন পরে ঈদ করি কেন? হিসাবে চাঁদ তো আমাদেরই আগে দেখার কথা। সে অনুযায়ী ঈদ আগে তো হয়-ই না, উপরন্তু এক দিন পরে কেন হয়?

এখানে বলতে হয়- সৌদি আরব থেকে আমরা তিন ঘণ্টা এগিয়ে থাকি সৌর বর্ষের হিসাবে। কিন্তু ইসলামি ক্যালেন্ডার হিজরি বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চলে। আর হিজরি বর্ষপঞ্জি চন্দ্র মাস কেন্দ্রিক আবর্তিত।

সাধারণত আমরা সৌরবর্ষ আর চন্দ্রবর্ষের হিসাবকে গুলিয়ে ফেলার কারণে বিভ্রান্তিতে পতিত হই। সৌরবর্ষের হিসাবে আমরা সৌদি আরব থেকে ৩ ঘণ্টা এগিয়ে থাকলেও চন্দ্রবর্ষের হিসাবে আমরা পিছিয়ে আছি ২১ ঘণ্টার মতো।

পৃথিবী নিজের অক্ষের চারদিকে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে ঘুরে প্রতিনিয়ত। অন্যদিকে সূর্য পূর্ব দিকে উদিত হয়ে পশ্চিমে অস্ত যায়, চাঁদও একই কাজ করে। কিন্তু দুটির গতি এক নয়।

এ কারণে খালি চোখে চাঁদ দেখতে হলে চাঁদ ও সূর্যের মাঝে ১০.৫ ডিগ্রি কোণ থাকতে হবে। আর এই কোণ উৎন্ন হতে হলে চাঁদকে সূর্য থেকে যতটুকু দূরত্বে যেতে হবে, ততটুকু দূরত্বে যাওয়ার জন্য ১৭ থেকে ২৪ ঘণ্টা সময়ের প্রয়োজন হয়।

এ কারণে বাংলাদেশ আর সৌদি আরবের মধ্যে সৌরবর্ষের সময়ের ব্যবধান ৩ ঘণ্টা হলেও চন্দ্রবর্ষের সময়ের ব্যবধান ২৪-৩ তথা ২১ ঘণ্টা বা এক দিনের কাছাকাছি।

সুতরাং, উভয় দেশে পয়লা শাওয়াল ঈদ হয় ঠিকই কিন্তু সময়ের ব্যবধান থাকে ২১ ঘণ্টা। যদিও আমরা সৌরবর্ষের ব্যবধান ৩ ঘণ্টার ব্যবধানে ঘুরপাক খাই। দুই বর্ষের হিসাবে যে ব্যবধান আছে, সেটা তো বছরের দিন সংখ্যা দিয়েই স্পষ্ট।

এবার আসি কিছু ধর্মীয়, ঐতিহাসিক ও জ্যোতির্বিজ্ঞানীয় প্রশ্নের সমাধানে। প্রতি বছর আমরা দেখি অনেক বিদ্বান রমজান মাসে একই দিনে (পড়ুন- একই সৌর দিনে) ঈদ উদযাপনের বিতর্ক তোলেন।

জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতিষশাস্ত্রের ক্যালকুলেশন, ধর্মের বিভিন্ন মাযহাবের ইমামদের অবস্থান এবং ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর যুক্তি দিয়ে এক সৌর দিনে ঈদের দাবি তোলেন। এগুলো কোনোভাবেই গ্রহণীয় যুক্তি হতে পারে না।

প্রথমে আসি জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক হিসাবে। এ হিসাব অনুযায়ী ১৪৪৫ হিজরি (২০২৪ ইংরেজি) বছরের শাওয়ালের চাঁদ জন্ম নেয় ৮ এপ্রিল গ্রিনিচ সময় ১৮:২০-এ।

তখন সৌদি আরবের সময় রাত ৯:২০ এবং বাংলাদেশ সময় রাত ১২:২০। অর্থাৎ সৌদি আরবে ৯ এপ্রিল শুরু হওয়ার মাত্র ২ ঘণ্টা ৪০ মিনিট বাকি এবং বাংলাদেশে ৯ এপ্রিল এর ২০ মিনিট পার হয়ে গেছে।

এর অর্থ হচ্ছে- আরবি তথা চন্দ্র মাসের হিসাব অনুযায়ী চাঁদের জন্ম হওয়ার আগেই সৌদি আরবে আরবি পরের তারিখের প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা এবং বাংলাদেশে ৬ ঘণ্টা ২০ মিনিট পার হয়ে গেছে। কারণ আরবি তারিখ শুরু হয় সূর্যাস্ত থেকে এবং ইংরেজি তারিখ শুরু হয় রাত ১২টা থেকে।

যেখানে সাধারণত ১০-১৫ মিনিটের তারতম্যে তারিখ পরিবর্তন হয়ে যায়, সেখানে সাড়ে তিন ঘণ্টা ও সাড়ে ৬ ঘণ্টা তো বহু সময়। তার ওপর খালি চোখে চাঁদ দেখতে উপরে দেওয়া হিসাব অনুযায়ী আরও ১৭ ঘণ্টা বা তার বেশী সময় লাগবে।

সুতরাং, বুঝাই যাচ্ছে জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক হিসাব অনুযায়ী চাঁদের জন্ম ধরে রোজা ও ঈদ পালন যৌক্তিক নয়।

সর্বোপরি, এ হিসাব অনুসরণ করে এক বছর আগে ঈদের তারিখ নির্ধারণ করাও সুন্দর নয়।
ইসলাম এসব ক্যালকুলেশনকে উৎসাহিত করে না। এ জন্যই আল্লাহর হেকমত বড় ইবাদতের রাত তথা শবে কদরকে লুকিয়ে রাখা।

বড় উৎসবের ক্ষেত্রে কবে হবে কবে হবে- এমন একটা ভাব থাকা নাটকীয় মজা এবং চাঁদ দেখার সুন্নত পালনের সওয়াবও এতে আছে।

এখন প্রশ্ন থেকে যায়- ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-সহ অনেক ইমাম তো এক দিনে রোজার পক্ষে ফতোয়া দিয়েছেন। তাহলে আমরা তাদের অনুসারী হয়ে ভিন্ন দিনে কীভাবে করছি!

হাদিস ও আসারের দলিলের দিকে না গিয়ে সহজে বলি (কারণ- সব পক্ষেরই হাদিস, আসারের দলিল আছে)।

এখানে একটা বিষয় বুঝতে হবে। ইমামরা একদিন বলতে আরবি মাসের একদিন তথা শাওয়ালের এক তারিখ এবং জিলহজ্জের ১০ তারিখকেই বুঝিয়েছেন। যাতে করে ভিন্ন আরবি তারিখে মুসলিমরা উৎসব না করেন। এখনও সেভাবেই হচ্ছে।

তাদের সময়ে হিজরি বর্ষপঞ্জিই অনুসরণ করা হতো। তারা কখনও ভাবেননি যে- একটা সময় মুসলিমরা তাদের হিজরিবর্ষ ভুলে গিয়ে ইংরেজিবর্ষ অনুযায়ী চলবে এবং ইংরেজি নির্দিষ্ট তারিখেই বিশ্বব্যাপী ঈদের জন্য দাবি তুলবে।

এমনকি নির্দিষ্ট ইংরেজি তারিখে সবার ঈদ পালন মুসলিম ঐক্যের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরবে মানুষ- এমন ধারণার জন্মও তখন হয়নি।

ঐক্যের কথা বলতে গেলে- মসজিদুল আকসার সম্মান ও লাখো ফিলিস্তিনির রক্ত যাদের এক করতে পারে না, কেবল এক ইংরেজি তারিখে ঈদ উদযাপন তাদের কতটুকু ঐক্যের মধ্যে আনতে পারবে?

সর্বোপরি, ইমামরা যখন ফতোয়া দিয়েছেন, তখন মুসলিম বিশ্ব এক দেশ ছিল। এক খলিফার/শাসকের অধীনে ছিল। ছিল জাযিরাতুল আরবের ভেতরে। আর এক দেশ হলে সবাই একই সময়ে বা কাছকাছি সময়ে ঈদ করবে- এটা তো স্বাভাবিক কথা।

অনেকে আবার উপমহাদেশে ১৯২০ এর দশক পর্যন্ত সৌদি ও অন্যান্য মুসলিম অঞ্চলের সাথে ঈদ পালনের ইতিহাস তুলে ধরেন। তাদেরও বুঝতে হবে যে, নামে হলেও তখনও মুসলিমরা এক খলিফার অধীনে ছিল। তারপর ভিন্ন ভিন্ন দেশ হয় মুসলিমদের এবং ঈদ পালনেও ভিন্ন ইংরেজি তারিখ চলে আসে।

পরিশেষে বলতে চাই- এক ইংরেজি তারিখে ঈদ পালন আসলে সম্ভবও না। কারণ আমরা যদি সৌদি আরবের সঙ্গে এক দিনে ঈদ উদযাপনও করি, তাহলেও আমেরিকার কিছু অঞ্চল এবং ইউরোপের কিছু দেশের কিছু অঞ্চলে বসবাসরত মুসলিমদের সময়ের বিরাট তারতম্যের কারণে আমাদের পরের দিনই ঈদ করতে হবে।

প্রসঙ্গত, আমাদের দেশে যারা সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে ঈদ উদযাপন করেন, চন্দ্র ও সৌরবর্ষের তারিখের বিরাট পার্থক্যের কারণে তাদের ঈদ মূলত পয়লা শাওয়াল না হয়ে ২৯ বা ৩০ রমজানে হয়ে যায়।

অন্যদিকে কুরবানি হয়ে যায় ৯ জিলহজ্জে। বাকি সবার ঈদ পয়লা শাওয়াল ও ১০ জিলহজ্জ হয়। চন্দ্র ও সৌরবর্ষের হিসাব এবং হিজরি তারিখকে ভালোভাবে অনুসরণ করলে এমনটি হওয়ার ঈদের নির্দিষ্ট দিন দিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়ার অবকাশ থাকতো না।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com
Website Design By Kidarkar It solutions