খাগড়াছড়ি:- হত্যাকাণ্ড, সহিংসতা ও নিষেধাজ্ঞায় মুখ থুবড়ে পড়েছে খাগড়াছড়ির পর্যটন শিল্প। সারাবছর পর্যটককে মুখরিত থাকলেও চিরচেনা সেই দৃশ্য এখন আর নেই। শারদীয় দুর্গাপূজা ও সাপ্তাহিক ছুটি মিলিয়ে চার দিনের ছুটি থাকলেও হোটেল-মোটেলগুলোতে বুকিং নেই। পর্যটক না থাকায় রুমগুলো ‘ফাঁকা’ পড়ে আছে। অলস সময় কাটাচ্ছেন পর্যটকবাহী গাড়ির চালকরা।
গত আড়াই সপ্তাহে পর্যটক সংশ্লিষ্ট খাতে অন্তত ১০ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে।
কোন উৎসব ছাড়াও সারা বছর খাগড়াছড়ির পর্যটক কেন্দ্র হাজারো পর্যটকের পথভাবে মুখর থাকতো। খাগড়াছড়ির প্রধান পর্যটন কেন্দ্র আলুটিলা, রিসাং ঝরনা, জেলা পরিষদ পার্কসহ কোনো কেন্দ্রেই কোনো পর্যটক নেই। আলুটিলা সবসময় পর্যটককে ঠাসা থাকলেও এখন সেখানে ‘সুনসান নিরবতা’।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়িতে মামুম নাতে এক বাঙালি ব্যবসায়ীকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যাকে কেন্দ্র করে পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে সংঘর্ষ ও সহিংসতার ঘটনার পর গত ১৯ সেপ্টেম্বরের পর থেকে খাগড়াছড়িতে পর্যটক আসেনি। এর পর গত ১ অক্টোবর শিক্ষার্থীরা এক শিক্ষককে গণপিটুনি দিয়ে হত্যার ঘটনায় খাগড়াছড়িতে সহিংসতার ঘটনা ঘটে।
সহিংসতায় প্রাণ গেছে ৫ জনের। এরই মধ্যে প্রশাসন আগামী ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত খাগড়াছড়িতে পর্যটকদের ভ্রমণের উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
ফলে শারদীয় দুর্গাপূজা ও সাপ্তাহিক ছুটি মিলিয়ে চারদিনের ছুটি থাকলেও হোটেল-মোটেলগুলোতে বুকিং নেই। পর্যটক না থাকায় রুমগুলো ‘ফাঁকা’ পড়ে আছে। অলস সময় কাটাচ্ছেন পর্যটকবাহী গাড়ির চালকরা।পর্যটন কেন্দ্রের আশপাশের অনেক রেস্টুরেন্ট ও দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। বেতন দিতে পারছে না শ্রমিকদের। এ সংকটের অবসান চান পর্যটক নির্ভর মানুষগুলো।
জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর সেপ্টেম্বরের শুরু থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় পাহাড়ে পর্যটক সমাগমও বাড়ছিল। এরই মধ্যে ১৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়িতে মোটরসাইকেল চুরির অভিযোগে মামুন হত্যাকাণ্ডে ঘটনাকে কেন্দ্র করে খাগড়াছড়িতে ‘পাহাড়ি-বাঙালি’ সংঘর্ষের পর পর্যটন শিল্পে ছন্দপতন ঘটে।
খাগড়াছড়ি পর্যটন মোটেলের ইউনিট ব্যবস্থাপক উত্তম কুমার মজুমদার বলছিলেন, পর্যটক নেই,আয়ও নেই। কর্মীদের বেতন দিতে পারছি না। আগাম বুকিং বাতিল করেছে অনেকে। এতে লোকসানের মুখে পড়েছে পর্যটন সংশ্লিষ্টরা।
আলুটিলা কফি হাউস অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের ব্যবস্থাপক মো. মামুন জানান. নিষেধাজ্ঞার কারণে কোনো পর্যটক নেই। প্রতিদিনই আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে।
খাগড়াছড়ি আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্রের টিকেট কাউন্টারের দায়িত্বে থাকা কোকোনাথ ত্রিপুরা জানান,স্বাভাবিক সময়ে আলুটিলায় ২/৩ দর্শনার্থী আসে। ছুটির দিনে বেড়ে ৬/৭এক হাজারের বেশি দর্শনার্থ আসতো। অথচ এখন কেউ নেই।
খাগড়াছড়ির পরিবহণ ব্যবসায়ী নুরুল আলম জানান, ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে পর্যটক না আসায় পর্যটক নির্ভর পরিবহণ ব্যবসায়ীদের চরম দু-দিন যাচ্ছে। গাড়ির কিস্তি পরিশোধ দুরে পরিবারের খাবারও ঠিক মতো জোগাড় করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তিনি দ্রুত সময়ের মধ্যে খাগড়াছড়িতে পর্যটক ভ্রমণের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবি জানান।
খাগড়াছড়ি হোটেল মালিক ব্যবসায়ী সমিতির সহ-সভাপতি স্বপন দেবনাথ বলেন, খাগড়াছড়ি ও সাজেকে প্রায় দেড় শতাধিক হোটেল-রেষ্টুরেন্ট রয়েছে। কিন্তু পাহাড়ে সহিংসতার পর ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে কোনো পর্যটক আসেনি। পূজার ছুটিতে এ সময় পর্যটন স্পটগুলো পর্যটককে মুখর থাকার কথা ছিল।অথচ আমাদের হোটেলসহ অন্যান্য আবাসিক হোটেলে কোনো কক্ষ বরাদ্দ হয়নি।
খাগড়াছড়ি হোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এস অনন্ত বিকাশ ত্রিপুরা পর্যটক ভ্রমণের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে বলেন,খাগড়াছড়ি পর্যটন শিল্প অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ খাত। এখানে পর্যটনের সঙ্গে পরিবহণ শ্রমিক, কৃষিখাতও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পর্যটক সমাগম বাড়লে পাহাড়ে উৎপাদিত ফলসহ কৃষি পণ্যের চাহিদাও বাড়ে। অথচ এখন বিপরীত চিত্র। আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এইভাবে চলতে থাকলে কর্মচারী বিদায় দিয়ে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হবে। গত দুই সপ্তাহে পর্যটক সংশ্লিষ্ট খাতে অন্তত ১০ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে।
খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক মো: সহিদুজ্জামান বলেন, সকল মহলের সাথে সমন্বয় করছি। নতুন করে যাতে কোনো সহিংসতা না হয়।সেজন্য উপজেলাগুলোতেও সম্প্রীতি সভা করেছি। মানুষের মনে যে ভীতি ও আতঙ্ক রয়েছে তা দূর করার চেষ্টা করছি। পর্যটকরা যাতে নির্বিঘ্নে ভ্রমণ করতে পারে তেমন একটা পরিবেশ আমরা তৈরির চেষ্টা করছি।
সহিংসতায় খাগড়াছড়িতে মানুষের মধ্যে ভয় ও আতঙ্ক বেড়েছে। ইতিমধ্যে প্রশাসন আগামী ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত খাগড়াছড়িসহ তিন পার্বত্য জেলায় পর্যটকদের ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। ফলে দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
তবে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা শীঘ্রই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আশ্বাস দিয়েছেন।
শীঘ্রই চলমান অস্থিরতা কেটে যাবে। পর্যটকরা যাতে নির্বিঘ্নে ভ্রমণ করতে পারবে।পার্বত্যনিউজ