খাগড়াছড়ি:-যে ঘরে সরকারি চাকরির অভাব নেই। বাবা চাকরি করেন একসঙ্গে ৩টি সরকারি প্রতিষ্ঠানে। অন্যদিকে বাবার ক্ষমতাবলেও প্রকল্পভিত্তিক সরকারি চাকরি করেন তারই তিন ছেলে-মেয়ে। নাম তাঁর মো. দানেশ আলী আজাদী (৫৫)। তিনি খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি উপজেলার উল্টাছড়ি ইউপির মধ্যনগর এলাকার বাসিন্দা। বয়স ৫৫ হলেও বুদ্ধির জোরে সরকারের অর্থ নিজের পকেটে ভরাট করার জন্য নানা কায়দায় সরকারি চাকরি করেন একসঙ্গে তিন তিনটি প্রতিষ্ঠানে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মধ্যনগর সিনিয়র আলিম মাদ্রাসার এবতেদায়ী বিভাগের সুপারিন্টেনডেন্ট হিসেবে এমপিওভুক্ত শিক্ষক তিনি। গ্রহণ করছেন সরকারি রাজস্ব খাতের অর্থ। আবার গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী’র (ভিডিপি) একজন সরকারি সদস্যও তিনি। সেখানেও তিনি পাচ্ছেন সরকারি অর্থ।
এতেই যেন শেষ নয়! চাকরি করছেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনেও। ইসলামিক ফাউন্ডেশন পানছড়ি উপজেলার সাধারণ কেয়ারটেকার হিসেবে সরকারি অর্থ ভোগ করছেন তিনি।
এখানেই সমস্ত অধ্যায়ের শেষ নয়। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকার কারণে নিজ ঘরেই সরকারি অর্থ লোপাটের জায়গা করে দিয়েছেন তিনি। ফাউন্ডেশনের গণশিক্ষা, নূরাণী কোরআন শিক্ষা কেন্দ্রগুলিতে চাকরি করছেন তারই তিন ছেলে-মেয়ে। মেয়ে রেবেকা পারভীন স্বপ্না চাকরি করেন ফাউন্ডেশনের আওতাধীন গণশিক্ষা কেন্দ্রে। কেন্দ্রের কোনো সাইন বোর্ড না থাকলেও স্বামীর বাড়িতে থেকে অল্প কিছু ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ান।
বড় ছেলে মো. রেজাউল করিম ও গণশিক্ষা কেন্দ্রের শিক্ষক। নিয়োগ পান আজ থেকে তিন বছর পূর্বে। পেশায় সে একজন সিএনজি চালক। তাঁর কেন্দ্রের কোনো অস্তিত্বই নেই। তাঁর সহকর্মী শিক্ষকরাও জানেন না যে সে একজন শিক্ষক। বছরের পর বছর ধরে বিনা পরিশ্রমে মাসিক ৫ হাজার টাকা বেতন গ্রহণ করতেন তিনি।
তারপর মেজো ছেলে মো. রাকিবুল ইসলাম একই ফাউন্ডেশনের নূরাণী কোরআন শিক্ষা কেন্দ্রের শিক্ষক। অভিযোগ আসে মসজিদের মক্তবের ছাত্র-ছাত্রীদের ফাউন্ডেশনের পরিচয়ে পড়ান।
মধ্যনগর বাইতুন নুর জামে মসজিদের মুয়াজ্জেম আব্দুল হক জানান, মসজিদে সকালে যে মক্তব পড়ানোর কথা সেটা রাকিব পড়ায়। তবে এটা তো ইসলামামিক ফাউন্ডেশনের আলাদা প্রকল্প। তাকে পড়াতে হলে আলাদা করে পড়াতে হবে। মসজিদের মক্তবের সাথে সম্পৃক্ত করা যাবে না।
দানেশ আলী দানবের মতোই কাজ করে যাচ্ছেন। অপেক্ষায় থাকেন কবে আবার কোথায় থেকে সরকারি অর্থ লোপাটের সুযোগ আসবে। আর সে সুযোগের পথ ধরেই শিক্ষিত বেকারদের চাকরির সুযোগটুকুও নিজের করে নিয়ে যাচ্ছেন দানেশ আলী।
মধ্যনগর সিনিয়র আলিম মাদ্রাসার সুপারিন্টেনডেন্ট মো.তমিজ উদ্দিন জানান, দানেশ আলী অত্র মাদ্রাসার এবতেদায়ী বিভাগের সুপারিন্টেনডেন্ট হিসেবে এমপিওভুক্ত শিক্ষক। তিনি সরকারি কোষাগার ও মাদ্রাসার পক্ষ হতে আলাদা আলাদা ভাবে বেতন পেয়ে থাকেন। তবে তিনি ঠিকমতো ক্লাস করান না। যেখানে উনার প্রতিদিন ৬-৭ টি ক্লাস করানোর কথা সেখানে তিনি ২-৩ টি ক্লাস করিয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কাজ দেখিয়ে চলে যান।
গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী’র (ভিডিপি) চাকরির সুবাধে দানেশ আলীর দলের পিসি মো.আকবরের নিকট জানতে চাইলে তিনি বলেন, সে চাকরি নেয়ার পর থেকে একটি দিনও ডিউটি করে নাই। অন্যদের দিয়ে ডিউটি করিয়ে তাদের কিছু টাকা দিতো। তাঁর ডিউটি না করার বিষয়ে আমি অফিসেও জানিয়েছি। তাঁরা এখনো ব্যবস্থা নেয়নি।
পানছড়ি উপজেলা আনসার ও ভিডিপি কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) কাজী আকাশ জানান, সরকারি রাজস্ব খাতের আওতাভুক্ত কেউ পরপর আরেকটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে পারে না। দানেশ আলীর ব্যাপারে আমাদের কাছে তাঁর দলের পিসি কোনো অভিযোগ করেনি। অভিযোগ পেলে আরো আগে ব্যবস্থা নেয়া হতো। আমরা এখন তাঁর সবকিছু তদন্ত করবো। যদি তাঁর মাদ্রাসার চাকরি এমপিওভুক্ত হয়ে থাকে তবে তাকে একটি চয়েসের অপশন দিবো। হয় ভিডিপির চাকরি করবে, না হয় মাদ্রাসার চাকরি করবে।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন পানছড়ি উপজেলার ফিল্ড সুপারভাইজার মো. ইউসুফ বাহার জানান, সরকারি রাজস্বভোগকৃত ব্যক্তি পরপর কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে পারে না। প্রতিবেদকের কাছ থেকে সবকিছু জেনেছি। এবং আমি এখানে গতমাসে যোগদান দেয়ার পরপরই প্রতিষ্ঠানগুলির তদারকি শুরু করি। দানেশ আলীর বড় ছেলে রেজাউলের কেন্দ্রের হদিস না থাকায় সেটি বন্ধ ঘোষণা করি। পাশাপাশি আমি বিষয়টি তদন্ত করে জেলা কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করে এর ব্যবস্থা নিশ্চিত করবো।
দানেশ আলী মাদ্রাসায় চাকরির ক্ষেত্রে এমপিওভুক্ত হওয়ায় সরকারি কোষাগার থেকে ৩,৫০০ টাকা এবং মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটি থেকে ৪,৫০০ টাকা মিলিয়ে মোট ৮ হাজার টাকা পান। গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী (ভিডিপি) থেকে পান ৩,০০০ টাকা। এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে পান ৭,৫০০ টাকা।
দানেশ আলীর কাছে তাঁর ওপর অভিযোগ সম্পর্কিত তথ্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, মাদ্রাসায় আমার চাকরি এমপিওভুক্ত না। যেটা পাই সেটা রাজস্বও না, এটা সম্মানী। পরপর তিনটি প্রতিষ্ঠানে চাকরির ব্যাপারে তিনি কিছুই বলতে চাননি। এদিকে তিন ছেলে-মেয়ের ইসলামিক ফাউন্ডেশনে চাকরির কথা বললে তিনি জানান, তাঁরা আলাদা থাকে। তাই তারা আলাদা ভাবে চাকরি পেয়েছে। আর বড় ছেলে রেজাউল করিম পড়ায় না দেখে এক মাস আগে তার কেন্দ্র বন্ধ ঘোষণা করেছে উপজেলা ফিল্ড সুপারভাইজার।
দানেশ আলীর বক্তব্যটিও মিথ্যে। অনুসন্ধানে পাওয়া যায় তাঁর সরকারি আওতাভুক্ত ইনডেক্স নাম্বারও রয়েছে। যার মাধ্যমে তিনি সরকারি কোষাগার থেকে বেতন পেয়ে থাকেন। অন্যদিকে তাঁর ছেলে তিনবছর ধরে বেতন ভোগ করে এসেছে। এবং প্রকল্পের শেষ পর্যায়ে এসে বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
খাগড়াছড়ি জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট জসিম উদ্দিন মজুমদার বলেন, একজন ব্যক্তি একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানেই চাকরি করতে পারে। একসাথে তিনটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার কোনো সুযোগই নেই। যদি দানেশ আলীর ক্ষেত্রে এমনটা হয়ে থাকে তবে এর সাথে জড়িত সকলকে আইনের আওতায় আসতে হবে। একই সাথে এই তিনটি খাতের প্রশাসনকে এর ব্যবস্থা সু-নিশ্চিত করার আহ্বান করছি।পাহাার২৪