ডেস্ক রির্পোট:- ব্যাংক খাতে আমানতের পরিমাণ বাড়লেও মানুষের হাতে টাকা রাখার প্রবণতা আবারও বেড়েছে। গত ডিসেম্বর মাসের শেষে ব্যাংকের বাইরে মানুষের হাতে ছিল ২ লাখ ৫৪ হাজার ৮৬০ কোটি টাকা, আগের মাস নভেম্বরে ছিল ২ লাখ ৪৮ হাজার ৪৪১ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত ডিসেম্বরে গ্রাহকরা ব্যাংক থেকে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা তুলে আর ব্যাংকে ফেরত দেননি। ফলে এই টাকা রয়ে গেছে মানুষের হাতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মাসভিত্তিক প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
সাধারণত, ছাপানো টাকার বড় অংশই থাকে মানুষের হাতে ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের ভল্টে। বাকি অংশ থাকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এক মাসে ছাপানো টাকার পরিমাণ বেড়েছে ৩১ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা।
কারণ, গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে ছাপানো টাকার পরিমাণ (রিজার্ভ মানি) ছিল ৩ লাখ ৭২ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা। আগের মাস নভেম্বরে ছিল ৩ লাখ ৪০ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত ডিসেম্বরে মানুষের হাতে নগদ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকের ভল্টে থাকার টাকার পরিমাণ কমে গেছে। ডিসেম্বরে ভল্টে ছিল (কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকে) ১ লাখ ১৭ হাজার ৪৫৫ কোটি টাকা। বাকি ২ লাখ ৫৪ হাজার ৮৬০ কোটি টাকা রয়েছে মানুষের হাতে বা সিন্দুকে।
এদিকে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বলেছেন, মানুষের হাতে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি টাকা রয়েছে। আগে বাজারে টাকা দিলেও পণ্য পাওয়া যেতো না। তবে এখন সেই সমস্যা নেই। পণ্য পাওয়া যায়। বৃহস্পতিবার (২২ ফেব্রুয়ারি) সিরডাপ মিলনায়তনে ‘দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি: উত্তরণ উপায়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এ কথা বলেন প্রতিমন্ত্রী।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, ডিসেম্বরে ২৪ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা ছিল বাণিজ্যিক ব্যাংকের ভল্টে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে ছিল ৯২ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা।
গত নভেম্বরে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ভল্টে ছিল ২৬ হাজার ৬৯ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে ছিল ৬৫ হাজার ৮৫৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ নভেম্বরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের ভল্টে ছিল ৯১ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা। বাকি ২ লাখ ৪৮ হাজার ৪৪১ কোটি টাকা ছিল মানুষের হাতে বা সিন্দুকে। তবে রেকর্ড পরিমাণ টাকা ব্যাংক ব্যবস্থার বাইরে ছিল গত জুন মাসে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জুন শেষে মোট ছাপানো নোটের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এর বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাইরে ছিল ৩ লাখ ১০ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২ লাখ ৯২ থেকে ২ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকা ছিল মানুষের হাতে। সাধারণত কোরবানির ঈদের সময় মানুষের হাতে নগদ টাকা বেশি থাকে।
অর্থনীতিবিদদের ধারণা, চলতি বছরের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের আগে ডিসেম্বরে নগদ টাকার লেনদেন বেড়ে যাওয়া, এছাড়া উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণেও অনেক মানুষ সঞ্চয় ভাঙাচ্ছেন। হুন্ডি তৎপরতা বৃদ্ধিও এর অন্যতম কারণ হতে পারে।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের কারণে ব্যাংক ব্যবস্থার বাইরে টাকার পরিমাণ বেড়েছে। প্রার্থীরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই টাকা খরচ করেছেন, যা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।’ তিনি বলেন, ‘এই টাকা আবার ঘুরে ব্যাংকেই আসবে।’ তিনি মনে করেন, ব্যাংক খাতে অব্যবস্থাপনার কারণেও অনেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন। এখন ব্যাংকগুলো আমানতের সুদ বাড়িয়ে দেওয়ায় এসব টাকা দ্রুতই ব্যাংকে ফিরে আসবে।
এরইমধ্যে ব্যাংক খাতের আমানত বাড়ছে। কেটে যাচ্ছে তারল্য সংকট। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংক খাতে আমানত বেড়েছে ১ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের শেষে ব্যাংক খাতে আমানত দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৫৪ হাজার কোটি টাকা—যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১৪ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, ঋণের সুদ বাড়ার কারণে আমানতের সুদ হার বেড়ে গেছে। আর আমানতের সুদ হার বাড়ার কারণে কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছেন সুদ আয়নির্ভর আমানতকারীরা।
এদিকে আগ্রাসীভাবে ঋণ বিতরণের পাশাপাশি সরকারি ট্রেজারি বিলে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে ব্যাংকগুলো। এছাড়া ঋণের টাকা কাঙ্ক্ষিত হারে ফেরত না আসায় তারল্য সংকটে পড়েছে বেশিরভাগ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত নভেম্বরে ব্যাংক ঋণ ছিল ১৫ লাখ ৬৪ হাজার ৬২১ কোটি টাকা, পরের মাস ডিসেম্বরে বেড়ে হয়েছে ১৫ লাখ ৯২ হাজার ৫৫৫ কোটি টাকা।
অবশ্য মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করতে নতুন সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আপাতত ছাপানো টাকা বাজারে ছাড়বে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বরং আগে ছাড়া টাকার কিছু অংশ পর্যায়ক্রমে তুলে নেবে। এর অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে বেশ কিছু টাকা তুলে নিয়েছে। টাকা ছাড়িয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারকে ঋণের জোগানও বন্ধ করা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব উৎস বা ছাপানো টাকায় যেসব তহবিল গঠন করা হয়েছে, সেগুলোয় নতুন করে অর্থের জোগান বন্ধ করা হয়েছে। একই সঙ্গে এসব টাকায় আপাতত আর নতুন তহবিল গঠন করা হবে না।