তারেক রহমানের ফোনে নির্বাচনের ‘গ্রিন সিগন্যাল’ পেলেন যারা

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় রবিবার, ২৬ অক্টোবর, ২০২৫
  • ৩৮ দেখা হয়েছে

ডেস্ক রির্পোট:- আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এখন এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে। নির্বাচনী ডামাডোল আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু না হলেও, দলের অভ্যন্তরে চলছে এক নিবিড় কর্মযজ্ঞ, যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। লন্ডন থেকে তিনি সরাসরি তত্ত্বাবধান করছেন সম্ভাব্য প্রার্থীদের মনোনয়ন প্রক্রিয়া।

তারেক রহমানের একটি ফোন কলই নির্ধারণ করে দিচ্ছে কারা হতে যাচ্ছেন বিএনপির কাঙ্ক্ষিত প্রার্থী। এই ফোন কলের মধ্য দিয়েই স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে, কে পাচ্ছেন ‘গ্রিন সিগন্যাল’ আর কে ছিটকে যাচ্ছেন নির্বাচনী দৌড় থেকে। দলের অভ্যন্তরীণ সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বিএনপি বর্তমানে মনোনয়ন যাচাই-বাছাইয়ের চূড়ান্ত ধাপে অবস্থান করছে।

দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিজে প্রতিটি আসনে প্রার্থীর জনপ্রিয়তা, গ্রহণযোগ্যতা এবং সাংগঠনিক সক্ষমতা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। শুধু পর্যবেক্ষণ নয়, তিনি ব্যক্তিগতভাবে প্রতিটি আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীদের সঙ্গে একাধিকবার কথা বলেছেন। এবার তিনি চূড়ান্ত প্রার্থীদের ফোন করে নির্বাচনী প্রচারণায় পূর্ণোদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশনা দিচ্ছেন, যা এক প্রকার নিশ্চিত করছে তাদের মনোনয়ন।

দলীয় একাধিক সূত্র বলছে, এবারের মনোনয়ন প্রক্রিয়া অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভিন্নভাবে পরিচালিত হচ্ছে। প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে তারেক রহমানের সরাসরি সম্পৃক্ততা নজিরবিহীন। তিনি কেবল নাম অনুমোদন দিচ্ছেন না, বরং প্রতিটি প্রার্থীর সাংগঠনিক কাজ, মাঠে উপস্থিতি এবং সাধারণ জনগণের প্রতিক্রিয়া নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে যাচাই করছেন। এমনকি অনেক ক্ষেত্রেই স্থানীয় নেতাদের পাশ কাটিয়ে সরাসরি তৃণমূল নেতাদের সঙ্গেও কথা বলেছেন তিনি, যা প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

বিএনপির একজন জ্যেষ্ঠ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আগের মতো এবার শুধু সিনিয়রিটি বা কেন্দ্রীয় সম্পর্ক নয়, মাঠের বাস্তবতা ও জনগণের পছন্দই সর্বাধিক গুরুত্ব পাচ্ছে। তারেক রহমানের কাছে এখন প্রতিটি আসনের পুঙ্খানুপুঙ্খ রিপোর্ট রয়েছে। যাদের সম্পর্কে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া এসেছে এবং যারা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য বলে প্রমাণিত হয়েছেন, তারাই এই কাঙ্ক্ষিত ফোন কল পাচ্ছেন।’ এই নতুন পদ্ধতি দলের সাংগঠনিক কাঠামোতে এক নতুন গতিশীলতা আনবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

প্রার্থী চূড়ান্ত করার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘এই মাসের মধ্যেই দলের পক্ষ থেকে দুই শতাধিক আসনে একক প্রার্থীকে গ্রিন সিগন্যাল দেওয়া হবে। আমরা প্রক্রিয়ার একদম শেষ পর্যায়ে আছি। শিগগিরই সবাইকে জানানো হবে যেন যে যার এলাকায় নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু করতে পারেন।’

ইতোমধ্যেই রাজধানী ঢাকার বেশ কয়েকটি আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীরা তারেক রহমানের ফোন পেয়েছেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। তাদের কেউ কেউ প্রচারণার প্রস্তুতিও শুরু করে দিয়েছেন। দলীয় একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে , ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ আসনগুলোতে তরুণ, পেশাজীবী এবং রাজনৈতিকভাবে পরিচিত মুখদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। এটি দলের নতুন প্রজন্মকে সামনে আনার একটি কৌশল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, যা তরুণ ভোটারদের আকৃষ্ট করতে সহায়ক হতে পারে।

এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা-৩ আসনে গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ঢাকা-৪ আসনে তানভীর আহমেদ রবিন, ঢাকা-৬ আসনে ইশরাক হোসেন, ঢাকা-৮ আসনে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মির্জা আব্বাস, ঢাকা-১০ ব্যারিস্টার নাছির উদ্দিন আহমেদ অসীম, ঢাকা-১২ হাবিব উন খান নবী সোহেল, ঢাকা-১৩ আসনে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক ববি হাজ্জাজ, ঢাকা-১৫ আসনে মামুন হাসান এবং ঢাকা-১৬ আসনে আমিনুল হক মনোনয়নের জন্য গ্রিন সিগন্যাল পেয়েছেন বলে জানা গেছে। এই তালিকা ঢাকার রাজনীতিতে বিএনপির নতুন মেরুকরণের ইঙ্গিত বহন করছে।

তবে এবার ঢাকা থেকে সবচেয়ে আলোচিত নাম ‘মায়ের ডাক’ আন্দোলনের সমন্বয়কারী সানজিদা ইসলাম তুলি। তিনি ইতোমধ্যে ঢাকা-১৪ আসনে নির্বাচনের গ্রিন সিগনাল হিসেবে তারেক রহমানের ফোনকল পেয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গুম হওয়া বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের বোন তুলিকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে নির্দেশনা দিয়েছেন।

এছাড়া ঢাকা-১৭ আসনটি বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি)-এর সভাপতি ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থকে ছাড় দেওয়া হয়েছে বলে একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে। এই আসন বণ্টন জোটের রাজনীতিতে বিএনপির নমনীয়তা এবং বিচক্ষণতার ইঙ্গিত বহন করে বলে মনে করছেন রাজনীতি সংশ্লিষ্টরা।

শুধু ঢাকায় নয়, সারা দেশেই ধীরে ধীরে চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রস্তুত হচ্ছে। বিএনপির হাইকমান্ডের ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো জানিয়েছে, অন্তত ৬০টি আসনে দল ইতোমধ্যেই নির্ভার, অর্থাৎ যেখানে প্রার্থী নিয়ে কোনো মতভেদ বা অনিশ্চয়তা নেই। এসব আসনে দলের শীর্ষস্থানীয় ও পরীক্ষিত নেতাদের প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এই আসনগুলোকে ‘নিরাপদ আসন’ হিসেবে বিবেচনা করছে দল, যেখানে প্রার্থীরা নিজেদের শক্তি প্রমাণে সক্ষম।

এই তালিকায় আছেন দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা। তারা হলেন- ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন (কুমিল্লা-১), মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর (ঠাকুরগাঁও-১), ড. আব্দুল মঈন খান (নরসিংদী-২), ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু (সিরাজগঞ্জ-২), সালাহউদ্দিন আহমদ (কক্সবাজার-১), মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ (ভোলা-৩), বরকতউল্লাহ বুলু (নোয়াখালী-৩), মো. শাহজাহান (নোয়াখালী-৪), শহীদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানি (লক্ষ্মীপুর-৩), মিয়া নুরুউদ্দিন অপু (শরীয়তপুর-৩), আসাদুল হাবিব দুলু (লালমনিরহাট-৩), অনিন্দ্য ইসলাম অমিত (যশোর-৩), রশিদুজ্জামান মিল্লাত (জামালপুর-১), ব্যারিস্টার কায়সার কামাল (নেত্রকোনা-১), মাহমুদ হাসান খান (চুয়াডাঙ্গা-২), ফজলুল হক মিলন (গাজীপুর-৫), আমিরুল ইসলাম খান আলীম (সিরাজগঞ্জ-৫), লুৎফুজ্জামান বাবর (নেত্রকোনা-৪), ব্যারিস্টার মুহম্মদ নওশাদ জমির (পঞ্চগড়-১), সাইফুল ইসলাম ফিরোজ (ঝিনাইদহ-৪)।

এদিকে গত ১৯ অক্টোবর সিলেট বিভাগের চার জেলার মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতাদের সঙ্গে গুলশান কার্যালয়ে মতবিনিময় করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বৈঠকে তিনি মনোনয়ন, নির্বাচনী প্রস্তুতি, প্রচারণা ও মাঠপর্যায়ের সংগঠনগত অবস্থান নিয়ে বিস্তারিত নির্দেশনা দেন। এই বৈঠকে জানানো হয়, শিগগিরই একক প্রার্থীকে সবুজ সংকেত দেওয়া হবে। শুধু সিলেট নয়, এর আগে চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর ও বরিশাল বিভাগের প্রার্থীদের সঙ্গেও একইভাবে মতবিনিময় সভা করা হয়েছে। শিগগিরই পর্যায়ক্রমে ঢাকা বিভাগের সম্ভাব্য প্রার্থীদের ডাকা হবে বলে জানা গেছে।

কেমন হবে এবারের মনোনয়ন প্রক্রিয়া জানতে চাইলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বাংলানিউজকে বলেন, ‘যারা এলাকায় সর্বোচ্চ গ্রহণযোগ্য এবং জনপ্রিয় প্রার্থী হিসেবে পরিচিত, তারাই এবার বিএনপির মনোনয়ন পাবেন। একই আসনে অনেক প্রার্থী মনোনয়ন প্রত্যাশা করতে পারেন, সেগুলো বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিজে খোঁজ-খবর নিয়েছেন এলাকার মানুষের কাছে কার গ্রহণযোগ্যতা এবং জনপ্রিয়তা বেশি। তৃণমূল থেকে শুরু করে অনেকের সঙ্গেই তিনি কথা বলেছেন। শিগগিরই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানানো হবে।’

জানা গেছে, বিএনপির হাইকমান্ড থেকে স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যাকে গ্রিন সিগনাল দেওয়া হবে, সবাইকে তার পক্ষেই কাজ করতে হবে। কোনো বিভক্তি বা স্থানীয় কোন্দল সহ্য করা হবে না। এমনকি অভ্যন্তরীণ বিরোধে যুক্ত হলে সাংগঠনিক পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলেও জানানো হয়েছে। এই কঠোর বার্তা দলের ভেতরে ঐক্য সুসংহত করার একটি প্রচেষ্টা, যা আগামী নির্বাচনে বিএনপির সফলতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন রাজনীতি সংশ্লিষ্টরা। অতীতে স্থানীয় কোন্দল অনেক সময় দলের নির্বাচনী সম্ভাবনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, তাই এবার হাইকমান্ড এ বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিয়েছে বলে জানা যায়। এই পদক্ষেপগুলো দলের কর্মীদের মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে এবং ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে উৎসাহিত করবে বলে মনে করা হচ্ছে।

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও কৌশলগত বিবেচনা
বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিএনপির এই মনোনয়ন প্রক্রিয়া অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মত দিচ্ছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা মনে করছেন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে শক্তিশালী ও জনপ্রিয় প্রার্থী বাছাই বিএনপির জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। তারেক রহমানের এই সরাসরি সম্পৃক্ততা একদিকে যেমন দলের ওপর তার নিয়ন্ত্রণকে সুদৃঢ় করছে, তেমনি অন্যদিকে প্রার্থীর গুণগত মান নিশ্চিত করতেও সহায়ক হচ্ছে।

এছাড়া বিভিন্ন জোট ও শরিক দলের সঙ্গে আসন ভাগাভাগির বিষয়টিও মনোনয়ন প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বিএনপি তার দীর্ঘদিনের মিত্রদের পাশাপাশি নতুন কিছু দলকে নিয়েও জোট গঠন করতে পারে, যেখানে আসন বণ্টনের ক্ষেত্রে ত্যাগ ও প্রাপ্তির একটি ভারসাম্য বজায় রাখা হবে। এ প্রসঙ্গে ২৪ অক্টোবর স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘নির্বাচনকে সামনে রেখে জোট গঠনে আলাপ-আলোচনা চলছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে। শেষ পর্যন্ত জোট কোন জায়গায় গিয়ে দাঁড়ায়, সেটা দেখার জন্য আরও অপেক্ষা করতে হবে। রাজনীতির মাঠে কোনো কিছুই আগে থেকে বলে দেওয়া যায় না।’

এদিকে তারেক রহমানের সরাসরি তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এই মনোনয়ন প্রক্রিয়া একদিকে যেমন দলের ভেতরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে, তেমনই অন্যদিকে প্রার্থীর গুণগত মান উন্নত করতে এবং তরুণ ও যোগ্য নেতৃত্বকে সামনে আনতে সহায়ক হচ্ছে বলে মনে করেন বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতারা। এটি দলের নির্বাচনী প্রস্তুতিকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এবং নেতাকর্মীদের মধ্যে নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি করছে বলে মনে করেন তারা।বাংলানিউজ

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com
Website Design By Kidarkar It solutions