শিরোনাম
রাঙ্গামাটির কাপ্তাইয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হামলা: আরও এক আসামি গ্রেপ্তার চট্টগ্রামে খাবারে কেমিক্যাল ব্যবহার, কাচ্চি ডাইনকে লাখ টাকা জরিমানা খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় ভারতীয় চিনি জব্দ, আটক ২ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রার্থীর এজেন্টদের প্রশিক্ষণ দিতে চায় ইউএনডিপি: ইসি সচিব বিদ্যুৎ খাতে অতিরিক্ত ৩৬৭ কোটি টাকা দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক দেশের স্বার্থে যেকোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকার আহ্বান সেনাপ্রধানের ভারত সফরে যাচ্ছেন বিজিবি প্রধান আপিল আবেদনের অনুমতি পেল চ্যানেল ওয়ান ডিসেম্বর অথবা জানুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন–নির্বাচন কমিশনার ১৬ বছর পর কারামুক্ত বিডিআরের ১৬৮ সদস্য

এক বছরে উখিয়া-টেকনাফে ১৯২ জন অপহরণ,আতঙ্কে স্থানীয় বাসিন্দা ও রোহিঙ্গা

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী, ২০২৫
  • ২০ দেখা হয়েছে

কক্সবাজার:- কক্সবাজারের সীমান্ত এলাকা টেকনাফ ও উখিয়ার পাহাড়ি অঞ্চলগুলো এখন অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। পর্যটন, সীমান্ত ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা কারণে সীমান্ত উপজেলা দুটির গুরুত্ব অপরিসীম। তবে ২০১৭ সালে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে এতদাঞ্চলে আশ্রয় নেওয়ার পর থেকে এখানকার স্থানীয়রা এমনিতেই নানা সঙ্কটে রয়েছেন। একদিকে রোহিঙ্গার চাপ, ইয়াবাসহ মাদকে সয়লাব হওয়া সীমান্তবর্তী এলাকাসমূহ ‘মরার উপর খাড়ার ঘা’ হিসেবে দেখা দিয়েছে অপহরণ বাণিজ্য। কে, কখন অপহরণের শিকার হয়, সেই চিন্তায় আতঙ্কে থাকে সবাই। দিন দিন এ ধরনের ঘটনা বাড়লেও কোনো স্থায়ী সমাধান মিলছে না। একের পর এক অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনায় আতঙ্ক এবং ক্ষোভ বাড়ছে স্থানীয়দের মাঝে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা যায়, গত এক বছরে টেকনাফে অন্তত ১৯২ জন অপহরণের শিকার হয়েছেন। অপহৃতদের মধ্যে ৯১ জন স্থানীয় ও বাকিরা রোহিঙ্গা। এর মধ্যে অন্তত ১৫০ জনকে মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেতে হয়েছে। অপহরণকারীরা মুক্তিপণ হিসেবে আদায় করেছে প্রায় আড়াই কোটি টাকা। মাঝেমধ্যে অপহৃত ব্যক্তির লাশ মিলছে পাহাড়, বন-জঙ্গল, ডোবা-নালায়। এমন প্রেক্ষাপটে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে সেনা অভিযান চালানোর দাবি করছেন স্থানীয় বাসিন্দাসহ সচেতন নাগরিক।

সর্বশেষ উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরাকান নামক ছয় বছরের ছোট শিশুর মাটিতে পুঁতে রাখার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। গত ৭ জানুয়ারি শিশুটি খেলার সময় অপহৃত হয়। ৮ জানুয়ারি, অপহরণকারীরা তার পরিবারের কাছে ভিডিওটি পাঠান। অল্পসময়ে ভিডিওটি ভাইরাল হয়ে যায়। সারা দেশে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। শিশুটিকে উদ্ধারের আকুতি জানানোর পাশাপাশি এমন বর্বরতায় ক্ষোভে ফেটে পড়েন ফেসবুক ব্যবহারকারীরা।

সূত্রে জানা যায়, ১৫ সেকেন্ডের এই ভিডিওটি ১০ জানুয়ারি কক্সবাজারের উখিয়ার অজ্ঞাত স্থানে অপহরণকারী চক্রের ধারণ করা। ভিক্টিম শিশুটির নাম মোহাম্মদ আরাকান (৬)। সে থাইংখালী-১৯ নম্বর রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরের সি ১৫ ব্লকের বাসিন্দা আবদুর রহমান ও আনোয়ারা বেগমের ছেলে। ভিডিওটিতে দেখা যায়, বাচ্চাটিকে গলা অবধি মাটি চাপা দিয়ে রাখা হয়েছে। এমতাবস্থায় রোহিঙ্গা ভাষায় শিশুটি তার বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলছিল, ‘আব্বা তরাতরি টিয়া দিবার চেষ্টা গর। মরে গাতত গলায় পিল্লে। টিয়া দে। (বাবা দ্রুত টাকা দেবার চেষ্টা কর, আমাকে গর্তে পুঁতে ফেলেছে, তাদের টাকা দাও)।’

অপহরণকারীরা আরাকানের মুক্তির জন্য সাত লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। অপহরণকারীদের কথা অনুযায়ী নির্দিষ্ট স্থানে প্রথমে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে আসেন আরাকানের স্বজনেরা। এতেও আরাকানকে না ছাড়ায় ধার দেনা করে আরো ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা দেন তারা। গত ১৪ জানুয়ারি রাত সাড়ে ১১টার দিকে কুতুপালং এলাকার এমএসএফ হল্যান্ড হাসপাতালের সামনে শিশুটিকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় ফেলে দিয়ে চলে যায় অপহরণকারীরা।

এ ঘটনা যেতে না যেতেই উখিয়া রত্নাপালং ইউনিয়নের জসিম (২০) নামে আরেক যুবক অপহরণের শিকার হয়। জসিম উদ্দিন রতœাপালং ৪ নম্বর ওয়ার্ডের মো. আলীর ছেলে বলে জানা যায়। জসিমের মায়ের ভাষ্য মতে, পরিবারের ভরনপোষণ চালাতে কাজের সন্ধানে গত ১০ জানুয়ারি বাড়ি থেকে বের হয়ছিল তার ছেলে। সাথে ছিল একই এলাকার বাহাদুরের ছেলে রিদুয়ান আকাশ নামে আরেক যুবক। এক সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও ছেলের খোঁজ না পেয়ে পরিবার জসিমকে খোঁজাখুজি করলে বাহাদুরের শালী কোটবাজারের বাসিন্দা মোহসেনা আকতারের কাছে শুনতে পায় জসিম অপহরণ হয়েছে। মুক্তিপণ দিয়ে তাকে উদ্ধার করতে হবে। মোহসেনা নামে ওই মহিলার মাধ্যমে বাহাদুর জসিমের পরিবার থেকে ৩০ হাজার টাকা দাবি করে। একদিন পরে তারা টাকা নিয়ে গেলে জবাব দেয় জসিম এখন তাদের হাতে নেই অন্য পাচারকারীরা তাকে নিয়ে গেছে।

এই সূত্রে ধরে কোটবাজারের মোহসেনা নামে ঐ নারীর সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, গত ১১ জানুয়ারী জসিমের সাথে বাহাদুরের ছেলেসহ আরো ৫ জন অপহরণ হয়। জনপ্রতি ৩০ হাজার টাকা করে দিলে অপহরণকারীরা সবাইকে ছেড়ে দেবে বলছিল তার বোনের জামাই বাহাদুরকে। তারা সবার চিন্তা না করে শাপলাপুর এক চৌকিদারের আশ্বাসে তাদের ছেলে রিদুয়ানকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। বাকিরা অপহরণকারীদের কাছে আটক থেকে যায়। রিদুয়ানের দেয়া তথ্যমতে, এসব ঘটনার বর্ণনা দিয়ে অপহরণ চক্র ও মানব পাচারকারীদের শনাক্ত করে ওই মহিলা নিজেই বাদী হয়ে তাদের নাম উল্লেখ করে উখিয়া এবং টেকনাফ থানায় লিখিত অভিযোগও দেন বলে জানান মোহসেনা।

গত ১১ জানুয়ারি, উখিয়া সদর বাজারের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী খোরশেল আলমের একমাত্র পুত্র, ৭ম শ্রেণির ছাত্র ইমতিয়াজ বাবুকে (১২) অপহরণ করে নিয়ে যায়। এ ব্যাপারে খোরশেদ আলম থানায় অভিযোগ করলে, বিভিন্ন স্থানে খোঁজ-খবর নিয়ে ঘটনা চাওর হলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অপহরণকারীরা বাবুকে রোডের মাঝখানে ফেলে চলে যায়।

এদিকে পুলিশ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানান, গত বছরের ৩০ ও ৩১ ডিসেম্বর দুই দিনে টেকনাফে ২৭ জন অপহরণের শিকার হয়েছেন। এরপরে টেকনাফের বাহারছড়ায় মুদির দোকানি জসিম উদ্দিনকে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করে নিয়ে যায় মুখোশধারীরা। ওইদিন সকালেই হ্নীলা ইউনিয়নের জাদিমুড়া এলাকায় বনে কাজ করতে যাওয়া রোহিঙ্গাসহ ১৯ জন শ্রমিক অপহরণের শিকার হন। তাদের পরিবারের কাছে ফোন করে অপহরণকারীরা জনপ্রতি এক লাখ টাকা করে মুক্তিপণ দাবি করে। তবে এ অপহৃতদের মধ্যে ১৮ শ্রমিককে হ্নীলা ইউনিয়নের লেদার রংগীখালী পশ্চিমের দুর্গম পাহাড় থেকে উদ্ধার করেছে র‌্যাব ও পুলিশ। পরে অনেককে মুক্তিপণের বিনিময়ে ছাড়া পেয়েছে বলে জানা যায়।

বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, দুর্গম পাহাড় ঘিরে কয়েকটি স্বশস্ত্র গোষ্ঠী রয়েছে। যাদের সংখ্যা ৩-৪শ’র মতো। যারা পাহাড়ে পাহাড়ে তৈরি করেছে বিশেষ আস্তানা। কিছু সংখ্যক স্থানীয়দের আশ্রয় প্রশ্রয়ে চলছে এমন অপরাধ কর্মযজ্ঞ। বিগত সরকারের সময় এই চক্রটিকে কতিপয় প্রভাবশালীর পৃষ্টপোষকতার অভিযোগ ছিল। কিন্তু জুলাই বিপ্লবোত্তর সময়ে এসেও তা বন্ধ না হওয়ায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেড়েছে বহুগুণ। উখিয়া টেকনাফের সাধারণ জনগণ মনে করেন, সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হলে এবং অপহরণপ্রবণ এলাকায় স্থায়ী সেনাবাহিনীর আবাস গড়ে তুললে এই ভয়াবহ অপরাধ রোধ করা সম্ভব।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, টেকনাফের বাহারছড়া, জাহাজপুরা, লেদা, মুছনি, হ্নীলা, রইক্ষ্যং, জাদিমুড়া ও হোয়াইক্যংয়ে বেশি অপহরণের ঘটনা ঘটে। সবচেয়ে বেশি বাহারছড়ার নোয়াখালীপাড়া, বড় ডেইল, মাথাভাঙা, জাহাজপুড়া, ভাগগুনা, মারিশবনিয়া, হোয়াই্যকংয়ের ঢালা, চৌকিদারপাড়া, দক্ষিণ শীলখালী গ্রামের মানুষ বেশি অপহরণ ভয়ের মধ্যে আছেন। অন্যদিকে উখিয়া উপজেলার পালংখালী, থাইংখালী, বালুখালী, কুতুপালং, টিএন্ডটি, হাজম রাস্তার মাথা, মধুরছড়া, দোছড়ি, হলদিয়াপালং, হাতিমোড়া, জালিয়াপালং, ইনানী, সোনারপাড়াসহ পাহাড়ি এলাকাগুলোতে বেশ কয়েকটি অপহরণ চক্র সক্রিয়।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, আর্থিকভাবে সচ্ছল বা প্রবাসে আত্মীয়-স্বজন রয়েছে এমন পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। অপহরণ চক্রের হাত থেকে নিস্তার পাচ্ছে না স্থানীয় বাসিন্দা, রোহিঙ্গা নাগরিক, এমনকি ভ্রমণে আসা পর্যটকরাও।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, অপহরণের অধিকাংশ ঘটনার রহস্যভেদ করতে পারছে না পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তারা শুধু অপহরণের ঘটনা ঘটলে কিছুটা তৎপরতা দেখায়। ঘটনার পর তদন্তে বা অপরাধীদের গ্রেফতারে কোনো অগ্রগতি থাকে না। এমনকি অপহরণের পর খোঁজ না পাওয়ার মানুষের লাশ মিলছে পাহাড়, বন বাদাড়ে, নালা, নর্দমায়। দিন দিন এ ধরনের ঘটনা বেড়ে চললেও নেই উল্লেখযোগ্য প্রতিকার। এদিকে অপহরণ ও মুক্তিপণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় আতঙ্কে দিন কাটছে স্থানীয় বাসিন্দা ও রোহিঙ্গাদের। অপহরণের পর অনেকে মুক্তিপণ দিয়ে ফিরলেও আবারও একই ঘটনার শিকার হওয়ার আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটছে।

এদিকে টেকনাফের পাহাড়ে সেনা বাহিনীর নেতৃত্বে বিশেষ অভিযানের দাবিতে ইতোমধ্যে অবস্থান কর্মসূচি ও স্মারকলিপি প্রদান করেছেন স্থানীয় জন সাধারণ ও সচেতন মহল। বিভিন্ন পেশাজীবী, রাজনীতিবিদসহ অনেকেই সেই অবস্থান কর্মসূচিতে সংহতি জানিয়েছেন।

উখিয়া টেকনাফের বিভিন্ন পয়েন্টে প্রতিদিন অপহরণ বাণিজ্য থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সম্মুহে, টেকনাফের হোয়াইক্যং, উখিয়া সদরসহ কক্সবাজারের বিভিন্ন পয়েন্টে এলাকাবাসী, সচেতন মহলের মানববন্ধন ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করছে। এসব কর্মসূচি থেকে অপহরণ, গুম, খুন বন্ধ করার জন্যে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বরাবরে স্মারকলিপি প্রদান করা হয়েছে।

উখিয়া-টেকনাফের সাধারণ জনগণ ও সচেতন মহলের আহ্বান, অতি দ্রুত পাহাড়ে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের নির্মূলের জন্য যৌথ অভিযান শুরু করতে হবে। প্রতিটি অপহরণের ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নজরদারি বাড়াতে পুলিশি চৌকি এবং প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর জন্য জরুরি আর্থিক সহায়তা এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিটি এলাকায় নিয়মিত টহল এবং স্থানীয় মানুষের সঙ্গে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। তাছড়া অপহরণ প্রবণ এলাকায় স্থায়ী সেনা ঘাটি স্থাপনের আহবানও জানানো হয়।ইনকিলাব

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com
Website Design By Kidarkar It solutions