ডেস্ক রির্পোট:- খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ক্যান্সার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ১০ কোটি টাকা মূল্যের ‘লিনিয়ার এক্সিলেটর’ মেশিন ১২ বছর ধরে বাক্সবন্দি অবস্থায় পড়ে আছে। জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ক্যান্সার চিকিৎসায় ব্যবহৃত অন্যতম জরুরি রেডিওথেরাপি মেশিন রয়েছে ছয়টি। এর চারটিই নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। দুটি মেশিন দিয়ে খুঁড়িয়ে চলছে স্বাস্থ্যসেবা। সেবা পেতে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগী ও স্বজনদের।
এ চিত্র শুধু দুটি হাসপাতালের নয়, দেশের অধিকাংশ সরকারি হাসপাতালে বছরের পর বছর যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে পড়ে রয়েছে। অনেক জায়গায় বাক্সবন্দি অবস্থায় যন্ত্র মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। অনেক হাসপাতালে আইসিইউ স্থাপন করা হয়েছে, এমআরআই মেশিন বসানো হলেও তা আর চালু করা হয়নি। খোলা বারান্দায় পড়ে বৃষ্টিতে ভিজে নষ্ট হচ্ছে। মেশিন কিনে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিলেও এসব মেশিন পরিচালনার জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়নি জনবল। ফলে সরকারি হাসপাতালে দামি মেশিন থাকলেও, বাড়তি খরচ করে ছুটতে হয় ক্লিনিক কিংবা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। এর মধ্যেও থেকে নেই কেনাকাটা। সিন্ডিকেটের ঘেরাটোপে জিম্মি স্বাস্থ্য খাত। স্বাস্থ্যের কেনাকাটা কবজায় নিতে আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে সেই ‘মিঠু চক্র’।
ঠিকাদার মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু এ চক্রের হোতা। সারা দেশে ছড়িয়ে আছে এ চক্রের জাল। ২০২০ সালে মিঠুর বিরুদ্ধে অবৈধ অর্থ উপার্জন ও বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মাস্ক-পিপিই কেনায় দুর্নীতির অনুসন্ধানে দুদক তলব করলে দেশ ছাড়েন ঠিকাদার মিঠু। নাম প্রকাশ না করা শর্তে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, গত অক্টোবরে দেশে ফিরেছিলেন মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু। ওই সময় তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রভাবশালী একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠক করেন। ঠিক ওই সময়ই যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন তার প্রায় ৫০০ কোটি টাকার সম্পদ জব্দ করে। খবরটি জানার পর দেশের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও দুদক নড়েচড়ে বসে।
মিঠুর সম্পদ জব্দ ও বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দেয় দুদক। কৌশলে আবার দেশ ছাড়েন মিঠু। দ্বিতীয় দফা দেশ ছাড়ার আগে মিঠু তার অনেক সম্পদ বিক্রির চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। তবে মিঠু দেশে না থাকলেও তার চক্রের লোকজন আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে স্বাস্থ্য খাতের কেনাকাটায়। মিঠু চক্রের জালিয়াতির কৌশলে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। নিজেদের প্রতিষ্ঠানের বাইরে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের হয়ে দরপত্র দাখিল করছে চক্রটি। স্বাস্থ্য খাতের দরপত্রে ঘুরেফিরে মিঠু চক্রের প্রতিষ্ঠানই অংশ নিচ্ছে এবং কাজ পাচ্ছে।
চট্টগ্রাম—– চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে গত সাত বছর ধরে নষ্ট পড়ে আছে প্রায় ১০ কোটি টাকায় কেনা একটি এমআরআই (ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং) মেশিন। ২০২০ সালের শেষের দিকে একবার যন্ত্রটি বিকল হয়েছিল। পরে মেরামত করে চালু করা হয়। কিন্তু ২০২১ সালের মে মাসে একেবারে অকার্যকর হয়ে যায়। চমেক হাসপাতালে দৈনিক গড়ে ১৮ থেকে ২০টি এমআরআই করা হতো। খরচ পড়ত ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা। এখন বেসরকারি ল্যাবে এটি করাতে খরচ হচ্ছে ৭ থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। তাছাড়া, চমেক হাসপাতালে নষ্ট পড়ে আছে হৃদ রোগীদের রক্তনালিতে ব্লক শনাক্তকারী ও স্টেন্ট লাগানোর জন্য ব্যবহৃত একটি ক্যাথল্যাব মেশিন। জেনারেল হাসপাতালে ২০১৫ সালে ৯ কোটি ৯৫ লাখ ৫০ হাজার টাকায় আনা হয় একটি এমআরআই মেশিন। সেটি ২০১৯ সালে নষ্ট হয়ে যায়। এখন পর্যন্ত সেটি নষ্ট পড়ে আছে। তাছাড়া এ হাসপাতালে নষ্ট পড়ে আছে, তিনটি এক্সরে মেশিন, পাঁচটি ইসিজি মেশিন, একটি চক্ষু পরীক্ষার মেশিন এবং আইসিইউ বিভাগে নষ্ট আছে ভেন্টিলেটর মেশিন, সিরিঞ্জ মেশিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি খাত একটি স্বাস্থ্য অন্যটি শিক্ষা। আর এ দুই খাতেই আমরা সবচেয়ে বেশি অনিয়ম দুর্নীতি দেখতে পাই।
স্বাস্থ্য খাতের অবস্থা বেশি খারাপ, অন্তত গণমাধ্যমের খবরের মাধ্যমে আমরা দেখতে পারি সেবা প্রদানে বেহাল দশা। এমনকি নামিদামি হাসপাতালগুলোতেও একই অবস্থা। সেখানেও অনিয়ম অনিশ্চয়তা। প্রয়োজনে ডাক্তার পাওয়া যায় না। অথচ গলা কাটা মূল্য পরিশোধ করতে হচ্ছে। আর এ খাতে আমরা পুকুর চুরি থেকে সাগর চুরি দেখতে পাচ্ছি। তিনি আরও বলেন, এভাবে দুর্নীতি ছড়িয়েছে একদম নিচের কর্মী থেকে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত। সবচেয়ে বেশি আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে স্বাস্থ্য খাতে ও শিক্ষা খাতে। অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কিনছে যা ব্যবহারই করা যাচ্ছে না। এসব কেনাকাটায় চলে লুটপাট।
একদিকে স্বজনপ্রীতি চলছে আরেক দিকে দক্ষ জনবল নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না। এখানেও ঘাটতি রয়েছে। সেবা প্রদান থেকে শুরু প্রতিটি ধাপে যদি এত দুর্বলতা থাকে তাহলে সেই খাত কি এগোতে পারবে? তার এগোনোর আর জায়গা নাই বলে মন্তব্য করেন তিনি। সাবেক বিএনপি নেতা মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান বলেছেন, ‘স্বাস্থ্য খাতে লাগামহীন দুর্নীতি হচ্ছে। এর বেশির ভাগই সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণে। রাজনীতি এক ব্যক্তি কেন্দ্রিক হয়ে যাওয়ার কারণে এখন সবাই ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে। যারাই দুর্নীতি করুক না কেন, তারা সবাই একটি নাম ব্যবহার করে। সবাই বলে আমি সরকার প্রধানের লোক। কথিত এসব লোককে চ্যালেঞ্জ করার মতো সৎসাহসী কোনো কর্মকর্তা, সচিব, মন্ত্রী কেউই নেই। প্রধানমন্ত্রী যেখানে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ দিচ্ছেন স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে, সেখানে দেখবেন ওনার সেই প্রচেষ্টাটাকে একটা শ্রেণি ধ্বংস করে ফেলছে। যখন কোনো কিছু নিয়ে লেখালেখি হয় তখন তিনি জানতে পারেন। এবং এখন এটার সমাধান হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তারা সবাই মেরুদন্ডহীন হয়ে গেছে। সব সেক্টরেই মিঠুর মতো ঠিকদারদের জয়জয়কার। এখন যারা দুর্নীতি করে তারা সেটা নিজের জোরে করে না, খুঁটির জোরে করে। আর তাদের খুঁটি কোথাও না কোথাও আছে।’বাংলাদেশ প্রতিদিন