ডেস্ক রির্পোট:- ভারত-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকায় পার্বত্যঅঞ্চলের ৪৯১ কিলোমিটার সীমান্তে কোনো ধরনের বেড়া নেই। ওই যায়গাগুলো দুর্গম হওয়ায় বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্রগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে মিয়ানমার ও ভারত থেকে ওইসব রুট দিয়ে অবাধে ঢুকছে ভারী অস্ত্র, মর্টার শেলসহ বিভিন্ন গোলাবারুদ।
দু’টি বড় গাছের সাথে (বড় অস্ত্র), একটি ছোট গাছ (ছোট অস্ত্র) বিনামূল্যে দেয়া হবে। কিন্তু বিচির (গুলি) জন্য আলাদা আদেশ (টাকা) প্রয়োজন। এভাবেই পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এড়াতে ছদ্মবেশী সাঙ্কেতিক ভাষা ব্যবহার করে আগ্নেয়াস্ত্র এবং গুলি কেনাবেচা করে থাকে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ভারত-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকায় পার্বত্যঅঞ্চলের ৪৯১ কিলোমিটার সীমান্তে কোনো ধরনের বেড়া নেই। ওই যায়গাগুলো দুর্গম হওয়ায় বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্রগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে মিয়ানমার ও ভারত থেকে ওইসব রুট দিয়ে অবাধে ঢুকছে ভারী অস্ত্র, মর্টার শেলসহ বিভিন্ন গোলাবারুদ। বর্তমানে সশস্ত্র সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর প্রায় চার হাজার সদস্যর হাতে ভারী অস্ত্র রয়েছে।
সম্প্রতি পার্বত্যাঞ্চল রাঙ্গামাটিতে অনুসন্ধানে গিয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী দলের সদস্যদের সাথে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) সাবেক দুই সদস্য নয়া দিগন্তকে বলেন, পাহাড়ে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা (ইউপিডিএফ) ভারী অস্ত্র এসএমজি ও একে-৪৭ কে বড় গাছ বলে থাকে। রিভলবার বা পিস্তলকে ছোট গাছ বলা হয়। গুলিকে বলা হয় বিচি।
ইউপিডিএফের সাবেক ওই দুই সদস্য নাম প্রকাশ না করে বলেন, তারা এই দলের সাথে ১৫ বছর কাজ করেছেন। তিনি বলেন, একসময় একটি এসএমজির মূল্য ছিল সোয়া তিন লাখ থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা। বর্তমানে চার থেকে পাঁচ লাখ টাকায় বিক্রি হয় এসব অস্ত্র। একে-৪৭ একই মূল্যে বিক্রি হচ্ছে। ক্ষুদ্র অস্ত্র সেকেন্ড হ্যান্ড, যার দাম ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা। বড় চালানের সাথে একটি বা দু’টি ছোট অস্ত্র বিনামূল্যে দেয়া হয়। তবে গুলির মূল্য আলাদাভাবে দিতে হয়। ৩৫০ টাকা দামের একটি এসএমজি বুলেট এখন ১ হাজার ২০০ টাকায় পাওয়া যায়। তিনি আরো বলেন, এম-৬ রাইফেলের বুলেট ২৫০ টাকা থেকে ২৭০ টাকায় পাওয়া যায়। রাইফেলের মূল্য বেশি, ৫ থেকে সাড়ে ৫ লাখ টাকায় বিক্রি হয়।
ওই দুইজন বলেন, ভারত ও মিয়ানমার সীমান্ত এলাকায় সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এসব ভারী অস্ত্র পাচার করা হয়। আগে বেশির ভাগ অস্ত্র মিয়ানমার থেকে আসত। কিন্তু এখন কঠোর নজরদারির কারণে তারা ভারত থেকে এলে এসব অস্ত্র অবাধে বাংলাদেশে প্রবেশ করছেন।
ইউপিডিএফের ওই সদস্যরা জানান, সবজি বা অন্যান্য পণ্যের আড়ালে সিল করা ব্যাগে অস্ত্রগুলো বহন করা হয়। বাংলাদেশে প্রবেশের পর, সশস্ত্র ইউপিডিএফ সদস্যরা চার পাশ ঘিরে ফেলে, যেন অন্য কোনো সশস্ত্রগোষ্ঠী সেখানে প্রবেশ করতে না পারে। এরপর অস্ত্র যাচাই-বাছাইয়ের পর তারা সাথে করে নিয়ে যাওয়া অর্থ লেনদেন করে। সব লেনদেন নগদ, কোনো ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করা হয় না।
অস্ত্রের অর্ডার দেয়া হয় কিভাবে জানতে চাইলে তারা বলেন, হোয়াটসঅ্যাপের মতো এনক্রিপ্ট করা মেসেজিং অ্যাপ ব্যবহার করে একটি কমান্ড চেইনের মাধ্যমে অর্ডার পাঠানো হয়। যদি আমার পাঁচটি বড় অস্ত্র প্রয়োজন হয়, তাহলে আমি একা তাদের সাথে কন্টাক্ট করব না, একটি সিস্টেম আছে এবং প্রত্যেকেরই একটি ভূমিকা আছে। তিনি জানান, স্থানীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ওপর জোরপূর্বক কর (চাঁদা) আদায়ের মাধ্যমে তহবিল আসে। এখানে টুল (চাঁদা) না দিয়ে আপনি কলাও বিক্রি করতে পারবেন না বলে তিনি দাবি করেন।
ইউপিডিএফের অভিযোগ, ১০০ থেকে ২০০ সশস্ত্র যোদ্ধা রয়েছে যারা চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করে।
চোরাচালানের রুট : আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং সাবেক সশস্ত্রগোষ্ঠীর দুই সদস্য অস্ত্র চোরাচালানের জন্য রাঙ্গামাটিতে চারটি প্রধান অস্ত্র রুট চিহ্নিত করেছেন। তার মধ্যে মিয়ানমারের আরাকান আর্মির কাছ থেকে বেশির ভাগ অস্ত্র ভারতের মিজোরাম হয়ে থানচি, লুলংছড়ি, ছোটপোতিঘাট, ঘিলাতলী বা বসন্তোপাড়া হয়ে প্রবেশ করে। আরেকটি রুট বান্দরবানে অস্ত্র পাঠায় যা, রাঙ্গামাটিতে প্রবেশ করে রাইখালী বাজার, বড়ইছড়ি, কাউখালী ও বিলাইছড়ি হয়ে। তৃতীয় একটি পথ মিয়ানমার থেকে মিজোরাম, তারপর রাঙ্গাপাড়া ও বাঘাইছড়ির সাথে সংযুক্ত করে এবং চতুর্থটি সাজেক লংকর পয়েন্টে যায়।
২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের জুন মাসের মধ্যে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ৯০টি আগ্নেয়াস্ত্র এবং ৬২৪ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করে ৯৬ জনকে গ্রেফতার করে। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতরের (আইএসপিআর) তথ্য অনুযায়ী গত মঙ্গলবার বাঘাইছড়ি উপজেলায় এক অভিযানে সেনাসদস্যরা ইউপিডিএফের একটি আস্তানা থেকে একটি একে-৪৭ রাইফেলসহ বেশ কিছু অস্ত্র জব্দ করেছে। আইএসপিআর জানায়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং ভবিষ্যতে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান চালিয়ে যাবে।
ভারতে জব্দ : ভারতীয় পুলিশ এ বছর ইউপিডিএফ ও মিয়ানমারভিত্তিক গোষ্ঠীগুলির সাথে যুক্ত একাধিক অস্ত্রের চালান জব্দ করেছে। গত ১৫ জানুয়ারি, মিজোরামে পাঁচজন অপারেটিভ-ইউপিডিএফের দুইজন এবং চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (সিএনএফ) তিনজন- এম-১৬ রাইফেল, একে-৪৭, গ্রেনেড, ১০ হাজারের বেশি গুলি এবং একটি ৪০ মিমি গ্রেনেড লঞ্চারসহ আটক করা হয়েছে। ২১ জানুয়ারি, ত্রিপুরায় মিলন চাকমা এবং সমাজ প্রিয় চাকমাকে ৯-এমএম পিস্তল এবং গুলিসহ গ্রেফতার করা হয়। দুই দিন পর রাজু চাকমাকে অরুণাচল-নাগাল্যান্ড সীমান্তের কাছে একটি একে-৪৭ এবং ৪৫টি গুলিসহ গ্রেফতার করা হয়। ১২ ফেব্রুয়ারি, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ মিজোরামে জেএসএসের (মেইন) তিন সদস্যের কাছ থেকে দু’টি একে-৪৭, পাঁচটি এম-৪ কার্বাইন এবং হাজার হাজার গুলি জব্দ করা হয় বলে জানিয়েছে টাইমস অব ইন্ডিয়া।
ইউপিডিএফ মুখপাত্র অঙ্গ্য মারমা এসব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি করেন। এই অঞ্চলগুলিতে জেএসএস (মেইন) এবং সংস্কারবাদী গোষ্ঠীগুলির আধিপত্য রয়েছে, ইউপিডিএফ নয়। তিনি আরো বলেন, আমরা কোনো সশস্ত্রগোষ্ঠী নই। আমরা বিক্ষোভ ও নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাস করি। তিনি আরো দাবি করেন, ইউপিডিএফ ক্যাম্প থেকে অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনা পাহাড়ে অস্থিরতাকে মিথ্যাভাবে চিত্রিত করার জন্য সাজানো হয়েছে। ভারত বা মিয়ানমার থেকে চোরাচালান সম্পর্কে জানতে চাইলে জেএসএস রাঙ্গামাটি জেলা সম্পাদক নগেন্দ্র চাকমা বলেন, আমি এমন কোনো ঘটনার কথা শুনিনি। তাই আমি বলব না যে এমন কিছু ঘটছে।
নজরদারি বৃদ্ধি পেয়েছে : ভারত বা মিয়ানমার থেকে এসএমজি এবং একে-৪৭সহ আগ্নেয়াস্ত্র কিভাবে পাচার হচ্ছে সে সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে, রাঙ্গামাটির পুলিশ সুপার এস এম ফরহাদ হোসেন বলেন, রাঙ্গামাটি একটি অত্যন্ত কৌশলগত অবস্থানের সীমান্তবর্তী জেলা, কারণ এটি বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারের ত্রি-সংযোগস্থলে অবস্থিত। জেলার বিশাল আকারের কারণে, এটি দেশ দু’টির সাথে কয়েক শ’ কিলোমিটার সীমান্ত ভাগ করে নিয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হলো এই সীমান্ত কেবল কঠিন পাহাড়ি ভূখণ্ডজুড়েই বিস্তৃত নয় বরং নদী এবং হ্রদও রয়েছে, যার ফলে এটি পর্যবেক্ষণ করা অত্যন্ত জটিল।
এসপি ফরহাদ বলেন, এই বাধা সত্ত্বেও অত্যন্ত নিষ্ঠা এবং দায়িত্বশীলতার সাথে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) অক্লান্ত পরিশ্রম করছে।