ডেস্ক রির্পোট:- দেশের সবচেয়ে বড় হ্রদ কাপ্তাইকে ঘিরে একের পর এক গড়ে উঠছে রিসোর্ট (অবকাশকেন্দ্র)। এসব রিসোর্ট নির্মাণে রাঙ্গামাটির জেলা প্রশাসন, জেলা পরিষদ, পরিবেশ অধিদপ্তর ও ফায়ার সার্ভিসের কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে না কোনো অনুমোদন।
শুধু কাপ্তাই হ্রদ নয়, রাঙ্গামাটির কাপ্তাই উপজেলায় কর্ণফুলী নদীর পাশে গড়ে ওঠা রিসোর্টগুলোও নিয়মনীতি মানছে না। এভাবে ‘খেয়ালখুশি’মতো রিসোর্ট নির্মাণের কারণে হ্রদের পরিবেশ ক্ষতির মুখে পড়েছে। তৈরি হয়েছে পাহাড়ধসের ঝুঁকি। অগ্নিনিরাপত্তা না থাকায় ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা।
রাঙ্গামাটি সদর ও এর আশপাশের উপজেলায় কী পরিমাণ রিসোর্ট গড়ে উঠেছে, তার সুনির্দিষ্ট তালিকা জেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস, জেলা পরিষদ কারও কাছে নেই। তবে রিসোর্টের মালিক ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, গত ৫ থেকে ১০ বছরে অন্তত ২০টি রিসোর্ট গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে কাপ্তাই হ্রদের পাশে রয়েছে অন্তত ১৫টি রিসোর্ট। আর কাপ্তাইয়ের কর্ণফুলী নদীর পাশে রয়েছে পাঁচটি।
জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ দেওয়া হলে কাপ্তাই হ্রদের সৃষ্টি হয়। ১৯৫৬ সালে শুরু হয়ে ১৯৬২ সালে শেষ হয় বাঁধের নির্মাণকাজ। বর্তমানে হ্রদের আয়তন ৬৮ হাজার ৮০০ হেক্টর। বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্রের পাশাপাশি এই হ্রদ এখন মৎস্য ও পর্যটনশিল্পের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
কাপ্তাই হ্রদের দখল নিয়ে ২০২২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোয় ‘হুমকিতে জীববৈচিত্র্য, সবাই মিলে কাপ্তাই হ্রদ দখল’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদন প্রকাশের প্রায় তিন বছর হতে চললেও অবস্থার তেমন পরিবর্তন হয়নি। দখলদারদেরও উচ্ছেদ করা হয়নি।
রিসোর্টের মালিক ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, গত ৫ থেকে ১০ বছরে অন্তত ২০টি রিসোর্ট গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে কাপ্তাই হ্রদের পাশে রয়েছে অন্তত ১৫টি রিসোর্ট। আর কাপ্তাইয়ের কর্ণফুলী নদীর পাশে রয়েছে পাঁচটি।
অনুমোদন ছাড়াই অপরিকল্পিত স্থাপনা
পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন, ১৯৮৯–এর ২২ ধারা অনুযায়ী, পাহাড়ে স্থানীয় পর্যটন পার্বত্য জেলা পরিষদের অধিভুক্ত। গত ২৪ মার্চ পার্বত্য জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খোন্দকার মোহাম্মদ রিজাউল করিম স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে বলা হয়েছে, ইদানীং লক্ষ করা যাচ্ছে, রাঙামাটি পার্বত্য জেলার সাজেকসহ বিভিন্ন এলাকায় যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া অপরিকল্পিতভাবে বাণিজ্যিক ভবন ও পর্যটন স্থাপনা নির্মিত হচ্ছে। পরিষদের অনুমোদন ছাড়া পর্যটনসংশ্লিষ্ট কোনো বাণিজ্যিক ভবন ও স্থাপনা নির্মাণ না করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কাজল তালুকদার দাবি করেছেন, আগে কী হয়েছে তাঁর জানা নেই। এখন থেকে পর্যটন স্থাপনা করতে জেলা পরিষদের কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হবে।
এদিকে বাংলাদেশ হোটেল ও রেস্তোরাঁ আইন এবং বিধিমালা অনুযায়ী, রিসোর্ট, রেস্টহাউস, গেস্টহাউস, মোটেল, হোটেল, রেস্তোরাঁ করতে হলে জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে লাইসেন্স নিতে হবে।
রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসনের দায়িত্বশীল এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, রাঙ্গামাটিতে সাম্প্রতিক সময়ে যেসব রিসোর্ট গড়ে উঠেছে, এর একটিও লাইসেন্স নেয়নি। কেননা বিধিমালা অনুযায়ী লাইসেন্স নিতে গেলে যে ধরনের কাগজপত্র বা অন্যান্য সংস্থার অনুমতিপত্র দিতে হবে, তা তাঁরা দিতে পারবেন না।
তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না কেন জানতে চাইলে ওই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, পর্যটনশিল্পকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে তাঁদের তৎপরতা অব্যাহত আছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রিসোর্টের তিন উদ্যোক্তা বলেন, নানা পরিস্থিতির কারণে পাহাড়ে ব্যবসা করা অনেক কঠিন। আবার লাইসেন্স বা সনদের অনুমতি নিতে চাইলে সেখানে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এ কারণে এসব ছাড়পত্র নিতে আগ্রহ কম।
কাপ্তাই হ্রদ ও কর্ণফুলী নদীর পাশে গড়ে ওঠা রিসোর্টগুলোতে থাকা ব্যয়বহুল। একেকটি রিসোর্টের প্রতিটি কক্ষে থাকতে হলে প্রতিদিন সর্বনিম্ন ২ থেকে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত গুনতে হয়।
পরিবেশের ছাড়পত্র ছাড়াই চলছে রিসোর্ট
রাঙ্গামাটির কাপ্তাইয়ে কর্ণফুলী নদীর তীরে রয়েছে প্যানোরমা জুম রেস্তোরাঁ, নিসর্গ পড হাউস, বনশ্রী পর্যটন কমপ্লেক্স, চন্দ্রলোক ক্যাম্পেইন সাইড রিসোর্ট ও জন হালদারের রিসোর্ট। শেষের দুটি এখনো চালু হয়নি। আর কাপ্তাই হ্রদের পাশে নির্মিত রিসোর্টগুলো হচ্ছে বার্গী লেক ভ্যালি, বেড়াইন্ন্যে রিসোর্ট, বরগাং রিসোর্ট, ইজর রিসোর্ট, রাইন্ন্যা টুগুন ইকো রিসোর্ট, গাং সাবরাং, জুমকিং ইকো রিসোর্ট, রেঙ লেক বিচ রিসোর্ট, পলওয়েল পার্ক অ্যান্ড কটেজ, রাঙা দ্বীপ রিসোর্ট, ওয়াইল্ড উড আইসল্যান্ড রিসোর্ট, হিলভিউ রিসোর্ট, মায়াবী আইসল্যান্ড রিসোর্ট, নীলাঞ্জনা বোট ক্লাব ও রিসোর্ট, বাগান বিলাস ইকো রিসোর্ট।
এই ২০টি রিসোর্টের মধ্যে পলওয়েল পার্ক অ্যান্ড কটেজ, প্যানোরমা জুম রেস্তোরাঁ ও নিসর্গ পড হাউস পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিয়েছে বলে জানান অধিদপ্তরের রাঙামাটি কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. মুমিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, ছাড়পত্র নেওয়ার জন্য বাকি রিসোর্টগুলোকে নোটিশ দেওয়া হবে।
বেশির ভাগ রিসোর্ট পরিবেশগত ছাড়পত্র তো নিচ্ছে না, উল্টো পাহাড় কেটে ও নদী দখল করে রিসোর্ট নির্মাণের অভিযোগ পেয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর। এই অভিযোগে অন্তত তিনটি নির্মাণাধীন রিসোর্টকে নোটিশ দিয়েছে অধিদপ্তর। এগুলো হচ্ছে কাপ্তাইয়ের শিলছড়ি এলাকায় অবস্থিত চন্দ্রলোক ক্যাম্পেইন সাইড রিসোর্ট, কাপ্তাই কায়েক ক্লাব ও জন হালদারের রিসোর্ট। পাহাড় কাটার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন চন্দ্রলোক ক্যাম্পেইন সাইড রিসোর্টের মো. আরিফ হাসান।
পরিবেশগত ছাড়পত্রের শর্ত অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ডে কোনোভাবে পরিবেশ (বায়ু, মাটি, পানি ও শব্দ) দূষণ করা যাবে না। সিঙ্গেল ইউজড প্লাস্টিক (যেমন প্লেট, গ্লাস, কাপ, খাবারের প্যাকেট, প্লাস্টিক ব্যাগ ইত্যাদি) ব্যবহার করা যাবে না।
তবে ৯ জুলাই রাঙ্গামাটির আসামবস্তি সড়কের পাঁচটি রিসোর্ট ঘুরে দেখেন এই প্রতিবেদক। এর মধ্যে বরগাং রিসোর্টের ময়লা–আবর্জনা ফেলা হচ্ছে একটি খাদে। এখানে প্লাস্টিক বর্জ্যও ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকতে দেখা যায়। বেড়াইন্ন্যে রিসোর্টের এক পাশে গর্ত করে ময়লা–আবর্জনা ও প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলে রাখা হয়।
পরিবেশগত ছাড়পত্রের বিষয়ে রাঙ্গামাটি পৌরসভার রাঙা দ্বীপ রিসোর্টের অন্যতম উদ্যোক্তা আলোক ব্রত চাকমা বলেন, পরিবেশগত ছাড়পত্র নেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও কেউ এটা নিয়েছেন বলে তাঁদের জানা নেই। তাঁরা পরিবেশদূষণ করছেন না। তাঁদের রিসোর্টগুলোতে যে বর্জ্য হয়, তা নির্দিষ্ট স্থানে রেখে পুড়িয়ে ফেলেন।
খেয়ালখুশিমতো রিসোর্ট নির্মাণ করা হচ্ছে। যেভাবে পাহাড়ে অপরিকল্পিতভাবে একের পর এক রিসোর্ট গড়ে উঠেছে, তাতে পাহাড়ধস ও অগ্নিকাণ্ডের মতো বিভিন্ন ধরনের দুর্ঘটনার শঙ্কা রয়েছে। পাহাড়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও বৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে।
রাঙ্গামাটি ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, রাঙ্গামাটিতে সাম্প্রতিক সময়ে গড়ে ওঠা রিসোর্টগুলোর মধ্যে সাতটি অগ্নিনিরাপত্তা সনদ নিয়েছে। এগুলো হচ্ছে বার্গী লেক ভ্যালি, বেড়াইন্ন্যে, ইজর, রাইন্ন্যা টুগুন, রাঙা দ্বীপ, নীলাঞ্জনা ও বরগাং।
অগ্নিনিরাপত্তা ছাড়পত্রের অন্যতম শর্ত হচ্ছে নিয়মিত অগ্নি মহড়া করতে হবে। প্রতিটি কটেজ বা রুমের জন্য আলাদাভাবে পাঁচ কেজি ধারণক্ষমতাসম্পন্ন একটি ফায়ার এক্সটিংগুইশার সংরক্ষণ করতে হবে। তবে ৯ জুলাই আসামবস্তি সড়কের পাঁচটি রিসোর্টে গেলে, প্রতিটি কটেজের সামনে ফায়ার এক্সটিংগুইশার দেখা যায়নি।
রিসোর্ট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন, রাঙ্গামাটির সভাপতি তনয় দেওয়ান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের রিসোর্টগুলো যেখানে নির্মিত হয়েছে, সেখানে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি যাওয়ার সুযোগ নেই। তাহলে টাকা খরচ করে কেন সনদ নেবেন?
পাহাড়ে ট্যুরিজমের নামে পরিবেশবিধ্বংসী কাজ চলছে বলে মন্তব্য করেছেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) স্থাপত্য ও পরিকল্পনা অনুষদের ডিন নগর–পরিকল্পনাবিদ মুহাম্মদ রাশিদুল হাসান। তিনি বলেন, খেয়ালখুশিমতো রিসোর্ট নির্মাণ করা হচ্ছে। যেভাবে পাহাড়ে অপরিকল্পিতভাবে একের পর এক রিসোর্ট গড়ে উঠেছে, তাতে পাহাড়ধস ও অগ্নিকাণ্ডের মতো বিভিন্ন ধরনের দুর্ঘটনার শঙ্কা রয়েছে। পাহাড়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও বৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। প্রথম আলো