বিএনপিকে উপেক্ষা করে স্থানীয় নির্বাচনে এগোচ্ছে সরকার

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫
  • ৩৫ দেখা হয়েছে

ডেস্ক রির্পোট:- বিএনপির ঘোর আপত্তি সত্ত্বেও সংসদের আগে স্থানীয় নির্বাচন আয়োজনে এগোচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। শেখ হাসিনার পতন ঘটানো গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র নেতৃত্বের পাশাপাশি সমর্থন দিচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত হতে পারে– এ আশঙ্কায় বিএনপি বিরোধী হলেও দলটির সূত্রের খবর, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে ছাত্রদের রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে স্থানীয় নির্বাচনে জোর দেওয়া হচ্ছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ থাকবে কিনা– যাচাইয়ে জামায়াত আগে স্থানীয় নির্বাচনের কথা বললেও দলটির নেতাদের ভাষ্য, নির্দলীয় পদ্ধতির স্থানীয় নির্বাচন ঘিরে তৃণমূলের ঐক্য ভেঙে গেলে বিএনপি দুর্বল হয়ে পড়বে। এর পর সংসদ নির্বাচনে সুবিধা হবে আওয়ামী লীগশূন্য মাঠে জামায়াতের।

রাজনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, সংসদ নির্বাচনের আগে দলের জনভিত্তি তৈরিতে ছাত্র নেতৃত্ব প্রথমে স্থানীয় নির্বাচন চায়। এ জন্য তারা দাবি ও চাপ অব্যাহত রাখবে। বিএনপির কারণে নির্বাচন সম্ভব না হলে, স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তরে রাজনৈতিক প্রশাসক বসানো হবে। এ লক্ষ্যেই বিএনপি ও আমলাতন্ত্রের ‘বাধা’ উপেক্ষা করে ছাত্র নেতৃত্বের রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম জাতীয় নাগরিক কমিটির (জানাক) সদ্য সাবেক নেতাকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে প্রশাসকের দায়িত্ব দিয়েছে সরকার। ঢাকা দক্ষিণে বিএনপির কোনো নেতাকে প্রশাসক পদে বসানোর প্রস্তাবে দলটি সাড়া না দেওয়ায় সেখানে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সম্প্রতি তিনটি পদোন্নতি পেয়ে অতিরিক্ত সচিব হওয়া শাহজাহান মিয়াকে। অন্তর্বর্তী সরকারে ছাত্রদের প্রতিনিধিত্ব করা উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা তিনি।

গত মঙ্গলবার আসিফ মাহমুদ বলেছেন, ‘সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে আলোচনা উঠলে আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আসে। এ নিয়ে নীতিগত সিদ্ধান্তও হয়েছে। সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’ একই দিন নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ জানান, আগামী ডিসেম্বরে সংসদ নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা। এর বাইরে অন্য নির্বাচনের প্রস্তুতি নেই। তবে সরকার চাইলে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আয়োজন করবে নির্বাচন কমিশন।

গতকাল বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে জামায়াতের সেক্রেটারি মিয়া গোলাম পরওয়ার জানিয়েছেন, সংসদের আগে স্থানীয় নির্বাচন আয়োজনে তাদের সমর্থন রয়েছে।

কমিশনকে জামায়াত পরামর্শ দিয়েছে, জনগণ চায় স্থানীয় নির্বাচন আগে হোক। জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে সম্মান ও সমর্থন জানায় জামায়াত। তবে এ ভাষ্য নাকচ করে গত সোমবার প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাতে নির্বাচনী রোডম্যাপ প্রকাশের তাগিদ দেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গতকাল তিনি বলেন, আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিএনপি একেবারেই একমত নয়। এটি দেশকে আরও ভঙ্গুর অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ছাড়া কিছুই নয়। যত দ্রুত জাতীয় নির্বাচন হবে, ততই রাজনীতি সহজ হবে; মানুষ স্থিতিশীল অবস্থার মধ্যে আসবে।

বিরোধিতা উপেক্ষা করে এগোচ্ছে ছাত্ররা

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সূত্রপাত করা অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার ইউনিয়ন পরিষদ বাদে স্থানীয় সরকারের অন্যান্য স্তরের জনপ্রতিনিধিদের অপসারণ করেছে। চট্টগ্রাম বাদে বাকি ১১ সিটি করপোরেশন, ৬১ জেলা পরিষদ, ৪৯৪ উপজেলা ও ৩৩১ পৌরসভায় এখন জনপ্রতিনিধি নেই।

নাগরিকরা সেবা পাচ্ছেন না– এ যুক্তিতে আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চাইছে ছাত্র নেতৃত্বের সংগঠন ‘জানাক’। সংগঠনের জ্যেষ্ঠ এক নেতা সমকালকে বলেছেন, বিএনপি স্থানীয় নির্বাচন হতে না দিলে ছাত্ররাও সংসদ নির্বাচন হতে দেবে না, যদিও তা প্রকাশ্যে বলছেন না সংগঠনের নেতারা। নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন বলেন, ‘নির্বাচনী সংস্কার ঠিকঠাক কাজ করছে কিনা, তা যাচাইয়ের জন্য হলেও স্থানীয় নির্বাচন আগে হওয়া উচিত। আবার চাইলেই কয়েক দিনের মধ্যে স্থানীয় নির্বাচন করা সম্ভব নয়। তাই অন্তর্বর্তী সময়ে স্থানীয় সরকারে আমলা নয়, জনগণের মধ্য থেকে প্রশাসক নিয়োগ দিতে হবে, যারা জনগণকে সেবা দেবেন।’ জানাক নেতারা প্রশাসক হবেন কিনা, তাহলে নিরপেক্ষতা থাকবে কিনা– প্রশ্নে তিনি বলেন, মোহাম্মদ এজাজ জানাক থেকে পদত্যাগ করে প্রশাসকের দায়িত্ব পেয়েছেন।

পরিবেশ নিয়ে কাজ করা এজাজকে উত্তরের প্রশাসক নিয়োগে গত ২৩ জানুয়ারি জনপ্রশাসনে আধা সরকারিপত্র দেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ। এটি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সমালোচনা হয়। জানাক সূত্রের ভাষ্য, নিয়োগ আটকাতে চিঠি ফাঁস করেছিলেন বিএনপিপন্থি আমলারা। উত্তরের প্রশাসক পদে জানাক নেতা এজাজের নিয়োগ ছিল ‘টেস্ট কেস’। এতে সফল হওয়ায় অন্যান্য স্থানীয় সরকারে প্রশাসক পদে ‘নিজস্ব লোক’ বসানো হবে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এবং গাজীপুরে ওয়ার্ড কাউন্সিলরের দায়িত্ব দিয়ে প্রশাসক নিয়োগে যাচাই-বাছাই ও তালিকার কাজ চলছে। স্থানীয় বিএনপি নেতাদেরও টানা হচ্ছে।

দল গঠনে সহায়ক

চলতি মাসে ছাত্রদের রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করবে বলে ঘোষণা রয়েছে। সূত্রের ভাষ্য, নিজস্ব ঘরানার প্রশাসকরা স্বচ্ছ এবং দুর্নীতিমুক্ত সরকারি সেবা ও ভাতা দিতে পারলে তাদের রাজনৈতিক দলের জনভিত্তি তৈরি হবে। বিরোধ এড়াতে বিএনপি, জামায়াত নেতাদেরও সরকারের মাধ্যমে প্রশাসক পদে বসাতে রাজি নাগরিক কমিটি।

নাগরিক কমিটির নেতাদের সংগঠন ফ্যাসিবাদবিরোধী তৃণমূল মঞ্চ গত ২৪ ডিসেম্বর উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদকে চিঠিতে স্থানীয় সরকারে প্রশাসক নিয়োগে সার্চ কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেয়। মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক আলাউদ্দীন মোহাম্মদ বলেন, ‘স্থানীয় সরকারের সংস্কারে কমিশন এখনও সুপারিশ দেয়নি। সংস্কারের মতো নির্বাচন হতেও কয়েক মাস লাগবে। দল গঠনে সুবিধা নিতে নয়, জনসাধারণকে সেবা দিতেই স্থানীয় সরকারে প্রশাসক বা নির্বাচন প্রয়োজন।’

একই সুর জামায়াতের

আগে স্থানীয় নির্বাচন চাওয়া জামায়াতের যুক্তি– সংস্কার কাজ করছে কিনা, তা যাচাই এবং জনভোগান্তি দূরীকরণে স্থানীয় নির্বাচন প্রয়োজন। দলটির নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, আগে কয়েকটি স্থানীয় নির্বাচন না হলে অন্তর্বর্তী সরকার এবং বর্তমান প্রশাসনের অধীনে যে সংসদ নির্বাচন নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হবে– তা কীভাবে বোঝা যাবে? জনসাধারণ কীভাবে আশ্বস্ত হবে? স্থানীয় সরকারের সব নির্বাচন সম্ভব না হলেও অন্তত কিছু হতে হবে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা ও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড প্রমাণে। তবে জামায়াতের একাধিক নেতার ভাষ্য, ভোটের মাঠ যাচাই ছাড়াও নানা কারণে স্থানীয় নির্বাচন আগে দরকার। তাদের মূল্যায়ন, প্রতিটি আসনে এমপি পদে বিএনপির একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী রয়েছেন। আগামী নির্বাচনে নিজের অবস্থান শক্ত করতে তাদের সবাই স্থানীয় নির্বাচনে নিজস্ব প্রার্থী দেবেন। নির্দলীয় পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে বলে বিএনপি তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। এতে দলটির তৃণমূলে বিশৃঙ্খলা হবে। বিএনপি নেতারা ভোটে খারাপ ফল করলে সংসদ নির্বাচনে তার প্রভাব অবশ্যই পড়বে।

জামায়াত সমর্থিত চেয়ারম্যান, মেম্বার, কাউন্সিলর, মেয়র প্রার্থীরা ইতোমধ্যে নির্বাচনের প্রচারে আছেন। ২০১৪ সালের নির্দলীয় পদ্ধতিতে বগুড়ায় উপজেলা নির্বাচনের উদাহরণ দিয়ে এক জামায়াত নেতা বলেন, সেবার ১২ উপজেলার পাঁচটিতে বিএনপি, পাঁচটিতে জামায়াত ও দুটিতে আওয়ামী লীগ নেতারা চেয়ারম্যান পদে জয়ী হয়েছিলেন। বগুড়া বিএনপির দুর্গ হওয়ার পরও দলীয় কোন্দলে হেরে যায়। ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে রাজনীতির মাঠে সরব বিএনপি নেতাকর্মী। বহু বছর পর অনুকূল পরিবেশ পাওয়ায় এবার আরও বেশি প্রার্থী হবে তাদের।

বিএনপি কেন চাচ্ছে না

অন্য নেতাদের মতো বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত হয়, এমন কিছু করা যাবে না। এ জন্যই সংসদের পর স্থানীয় নির্বাচন চায় বিএনপি। তবে দলটির নেতাদের ভাষ্য, সংসদের আগে স্থানীয় নির্বাচনে অগ্রাধিকার, প্রশাসক নিয়োগ– সবই ছাত্রদের দল গঠনে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার লক্ষণ। সরকারি সুবিধার আশায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা নতুন রাজনৈতিক দলে ভিড়তে পারেন; অতীতেও তাই হয়েছে।

৫ আগস্টের পর বিএনপি মহাসচিব দলটির ১৯ নেতাকে মেয়র পদে পুনর্বহালে চিঠি দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ নেতাদের সরাতে ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রতিনিধিদের অপসারণের দাবি তুলেছিলেন। সরকার, জামায়াত ও ছাত্ররা আগে স্থানীয় নির্বাচনের কথা তোলার পর সে অবস্থান থেকে সরে এসেছে বিএনপি। সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, যারা আনুপাতিক পদ্ধতিতে ভোট, আগে স্থানীয় নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে, তাদের উদ্দেশ্য জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত করা। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন সংসদ নির্বাচন আয়োজনে বাধ্য; স্থানীয় নির্বাচন নয়। আর তাদের স্থানীয় নির্বাচনের জন্য যদি ভোটার তালিকা ও প্রস্তুতি থাকে, তাহলে আগেভাগে সংসদ নির্বাচন করুক। ইউপি নির্বাচন হতেই কয়েক মাস লাগবে। এভাবে সব স্থানীয় নির্বাচনে কয়েক বছর লাগবে। ততদিন সংসদ নির্বাচন হবে না? গণতন্ত্র, স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় যত দ্রুত সম্ভব জাতীয় নির্বাচন প্রয়োজন।
স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা সংস্কারে গঠিত কমিশনের প্রধান ড. তোফায়েল আহমেদ আগে জানিয়েছিলেন, জনসাধারণ আগে স্থানীয় নির্বাচন চাইছে। সরকারি উদ্যোগে নির্বাচন সংস্কার কমিশনের জরিপের বরাতে ড. বদিউল আলম মজুমদার জানিয়েছেন, ৪৬ হাজার উত্তরদাতার ৯০ শতাংশই আগে স্থানীয় নির্বাচনের পক্ষে।সমকাল

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com
Website Design By Kidarkar It solutions