ডেস্ক রির্পোট:- গণ-অভ্যুত্থানে বিপ্লবের পর দেশের প্রায় ৪৬০টি থানায় হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া ১১৪টি ফাঁড়িতে একই ঘটনা ঘটায় দুর্বৃত্তরা। লুটপাটের সময় সরকারি গুরুত্বপূর্ণ নথির পাশাপাশি লুট করা হয় সরকারি অস্ত্র। এসব অস্ত্র লুট করে কেউ কেউ নিজের কাছে রেখেছে আবার কেউ সেগুলো বিক্রি করে দিয়েছে। হাতবদল হয়ে এখন সেগুলো ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকা চরমপন্থি, উগ্রপন্থি, দাগি আসামি, সন্ত্রাসী, জেল পলাতক আসামি, কিশোর গ্যাংসহ বিভিন্ন অপরাধীদের হাতে। অথচ লুট হওয়ার পাঁচ মাস পরেও পুলিশ এসব অস্ত্র পুরোপুরি উদ্ধার করতে পারেনি। পুলিশ এখনো সুনির্দিষ্টভাবে বলতেও পারছে না ঠিক কাদের হাতে অস্ত্রগুলো আছে। তাদের অবস্থান পরিচয়ও জানতে পারছে না। যৌথ অভিযান চালিয়েও সফলতা আসেনি। তাই এসব অস্ত্র এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতিমধ্যে এসব অস্ত্র দিয়ে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, অপরাধ ও অস্ত্র বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, পুলিশের উদ্ধার না হওয়া অস্ত্রগুলো বড় ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করেছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য মতে ৫ই আগস্টের পর দেশের বিভিন্ন থানা ও ফাঁড়ি থেকে মোট ৫ হাজার ৭৫০টি বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র লুট হয়েছিল। এরমধ্যে উদ্ধার করা হয়েছে ৪ হাজার ৩৫১টি অস্ত্র। এ ছাড়া একই সময়ে গোলাবারুদ লুট হয়েছিল ৬ লাখ ৫১ হাজার ৬০৯টি। উদ্ধার হয়েছে ৩ লাখ ৮৯ হাজার ৪৩৯টি। এই হিসাবে এখন অস্ত্র উদ্ধার হয়নি ১ হাজার ৫৯৯টি। আর গোলাবারুদ উদ্ধার হয়নি ২ লাখ ৬২ হাজার ১৭০টি। পুলিশ সদর দপ্তর জানিয়েছে, লুট হওয়া অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে, এসএমজি, এলএমজি, বিভিন্ন ধরনের রাইফেল, পিস্তল, শটগান, গ্যাসগান। এ ছাড়াও রয়েছে কাঁদানে গ্যাস লঞ্চার, কাঁদানে গ্যাসের শেল, কাঁদানে গ্যাসের স্প্রে, সাউন্ড গ্রেনেড, বিভিন্ন বোরের গুলি।
র্যাব সদরর দপ্তরের সূত্রমতে, ৫ই আগস্টের পর থেকে র্যাব ২৬শে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪৮৪টি অস্ত্র উদ্ধার করেছে। এরমধ্যে র্যাবের লুট হওয়া ১৬৮টি অস্ত্রের মধ্যে ৯০টি, পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্রের মধ্যে ২২৮টি উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া ১৬৬টা অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া গোলাবারুদের ক্ষেত্রে র্যাবের ৭ হাজার ৩০৩ রাউন্ড, পুলিশের ১১ হাজার ৯৪১ রাউন্ড উদ্ধার করা হয়েছে। আর অবৈধ গোলাবারুদ ১ হাজার ২৮০ রাউন্ড উদ্ধার করা হয়েছে। অস্ত্র উদ্ধার সংক্রান্ত মামলায় ৯৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছি।
এদিকে, গণভবনের দায়িত্বে থাকা এসএসএফ সদস্যদের বিশেষায়িত অস্ত্র ও বিভিন্ন সরঞ্জামাদি এখনো উদ্ধার হয়নি। শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পরপরই বিক্ষুব্ধ জনতা গণভবনে ঢুকে লুট করে। এসবের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ট্যাক্টিক্যাল গিয়ার, অস্ত্র, গোলাবারুদ, সাজসরঞ্জাম, বেতার যোগাযোগ ও অপারেশনাল সরঞ্জামাদির মজুত ছিল। এ ছাড়া জাতীয় সংসদ ভবনেও এসএসএফের অস্ত্র গোলাবারুদ মজুত ছিল। ৫ই আগস্ট জনতা গণভবন ও জাতীয় সংসদ ভবনে প্রবেশ করার পর ঐসব অস্ত্র লুট হয়ে যায়। লুট হওয়া অস্ত্রের মধ্যে অত্যাধুনিক অ্যাসল্ট রাইফেল, স্নাইপার রাইফেল, ফ্ল্যাশব্যাং গ্রেনেড, অ্যান্টি-ড্রোন সিস্টেম, বেতার যোগাযোগের ডিভাইস ও বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদসহ ৩২টি ভারী অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি।
পুলিশের সূত্রগুলো বলছে, লুট হওয়া অস্ত্র দিয়ে অক্টোবর-নভেম্বর মাসে মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে গোলাগুলি করে একাধিক হত্যাকাণ্ডসহ নানা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটানো হয়েছে। গত ৩০শে নভেম্বর ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে থেকে উদ্ধার করা হয় ময়মনসিংহের কোতোয়ালি থানা এলাকার মৃত মোতালেবের মেয়ে শাহিদা ইসলামের লাশ। তিনি ঢাকার ওয়ারীতে মা ও ভাইয়ের সঙ্গে ভাড়া বাসায় থাকতেন। পুলিশ জানতে পারে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় পুলিশ তার প্রেমিক তৌহিদ শেখ তন্ময়কে গ্রেপ্তার করে জানতে পারে শাহিদাকে যে অস্ত্র দিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে সেটি পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র।
কারাসূত্র বলছে, ২ হাজার ২০০ জন বিভিন্ন পর্যায়ের আসামি জেল থেকে পালিয়ে গেছে। এরমধ্যে ১ হাজার ৫০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে এখনো ৭০০ আসামি পলাতক রয়েছেন। পলাতক আসামিদের মধ্যে জঙ্গি, ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মতো ৭০ জন রয়েছে। এ ছাড়া কারাগার থেকে এখন পর্যন্ত আলোচিত ১৭৪ জন মুক্তি পেয়েছেন। এদের মধ্যে ১১ জন শীর্ষ সন্ত্রাসী রয়েছেন। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন জেল থেকে যারা পালিয়েছেন, তাদের অনেকেই আবার অপরাধে জড়াচ্ছেন। এদের মধ্যে অনেকেই অস্ত্র কিনছেন। বিশেষ করে শীর্ষ সন্ত্রাসী, জঙ্গি ও চরমপন্থিরা পুলিশের এসব কিনে নিচ্ছেন। তাই সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা ঝুঁকি চরম পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে।
৫ই আগস্টের পর লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারের বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম বলেন, এসব অস্ত্র তো অপরাধীদের কাছে চলেই গেছে। সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এসব অস্ত্র উদ্ধারে এখনো নতুন কোনো পদ্ধতি উদ্ঘাটন করতে পারিনি যেটা দিয়ে অস্ত্র উদ্ধার করে ফেলতে পারবো। আমি মনে করি আমরা যদি মানুষের আস্থাটা আরেকটু অর্জন করতে পারি এবং তাদের কাছে যেতে পারি তবে তারাই আমাদের বলবে কোথায় কোথায় অস্ত্র আছে। এ ছাড়া মানুষের সহযোগিতা ছাড়া অস্ত্র উদ্ধার সম্ভব নয়। কারণ অস্ত্র কোথায় আছে সেটি কারও না কারও নলেজে আছে। আমরা মানুষের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করছি। যাতে মানুষ আমাদেরও কাছে নেয়। তিনি বলেন, ১৫ বছর তো মানুষকে শুধু কষ্টই দেয়া হয়েছে। তাই ওই পজিশনে যেতে হবে। না হলে মানুষ সহযোগিতা করবে না। এটাই আমার বড় চ্যালেঞ্জ। এখনো অনেক জায়গায় অত্যাচার-অবিচার করেছে এমন কর্মকর্তারাও রয়েছে। এসব জায়গায় আমরা উন্নতি করতে চাচ্ছি। এসব কারণেই পুলিশ সুপার কুষ্টিয়ায় ছিলেন তাকে গ্রেপ্তার করেছি। গণঅভ্যুত্থানের পর গণজামিনের সময় যেসব শীর্ষ সন্ত্রাসী মুক্তি পেয়েছিল তাদের অবস্থান ও নজরদারির বিষয়ে আইজিপি বলেন, তারা জামিন পেয়েছিল অনেক আগেই। আওয়ামী লীগ চলে যাওয়ার পর তারা বের হয়েছে। ইচ্ছা করলে তারা আগেই বের হতে পারতো। তারা মনে করেছে আগে বের হলে তাদের মেরে ফেলবে। আমরা তাদেরকে নজরদারিতে রেখেছি।
এলিট ফোর্স র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল মুনীম ফেরদৌস বলেন, যৌথবাহিনীর মাধ্যমে অস্ত্র উদ্ধারের যে সরকারি আদেশ ছিল সেটি এখনো বলবৎ আছে। বৈধ অস্ত্র জমা দেয়ার যে নির্দেশ ছিল সেগুলো উদ্ধারের চেষ্টা করছি। মাদকের সঙ্গে অস্ত্রের একটা সম্পৃক্ততা আছে। মাদক থাকলে অস্ত্র থাকারও সম্ভাবনা থাকে। তাই আমরা যখনই মাদক উদ্ধারের অভিযানে যাচ্ছি তখনই অস্ত্রের খোঁজ করছি। আমরা সফলতাও পেয়েছি। আমরা অবৈধ অস্ত্রের পাশাপাশি লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার করেছি। এ ছাড়া যৌথবাহিনীর ব্যানারে যেখানে যেখানে তথ্য আছে মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প, মিরপুরসহ বিভিন্ন স্থানে ব্লক রেইডের মাধ্যমে অভিযান চালিয়ে অস্ত্র উদ্ধার করেছি। তিনি বলেন, অস্ত্র উদ্ধারে আমাদের ফোকাস আছে এবং সেগুলো যেন কোনো ভাবে সন্ত্রাসীদের হাতে ছড়িয়ে যেতে না পারে সেদিকে নজরদারি আছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) মুনীরুজ্জামান বলেন, যখনই সরকারি অস্ত্র বা অন্য কোনো সরঞ্জাম হারিয়ে যায় তখন আর সেটি ফেরত পাওয়া যায় না। সেগুলো ভুল হাতে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে এবং নিরাপত্তার জন্য বড় শঙ্কা তৈরি করে। ওই সময় যেসব অস্ত্র লুট হয়েছে তার মধ্যে পুলিশের অস্ত্র ছাড়াও এসএসএফ’র কিছু বিশেষায়িত অস্ত্র ছিল সেগুলোও তারা এখনো খুঁজে পায়নি। কাজেই এগুলো আমাদের নিরাপত্তার জন্য বড় ঝুঁকি থাকবে। আর যতদিন পর্যন্ত সেগুলো উদ্ধার করা না যাবে সেই ঝুঁকি থেকে যাবে। অস্ত্র উদ্ধারে যে অভিযান চালানো হয়েছিল সেটিতে পুরোপুরি অস্ত্র উদ্ধার করতে পারেনি। তাই আরও জোরদার অভিযান চালাতে হবে। গোয়েন্দা সংস্থার সাহায্য আরও নিতে হবে যাতে অস্ত্র উদ্ধারে যেসব তথ্য দরকার সেগুলো দিয়ে যেন তারা মাঠ পর্যায়ে গিয়ে অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করার চেষ্টা করে। এ ছাড়া অস্ত্র উদ্ধারের জন্য নতুন কোনো পদ্ধতি বের করতে হবে। ক্রিয়েটিভ এবং ইনোভেটিভ আইডিয়া ব্যবহার করতে হবে। গোয়েন্দা সংস্থাকে ব্যবহার করতে হবে। তাহলে উদ্ধারের প্রচেষ্টা আরও জোরদার হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও অপরাধ বিশ্লেষক ড. তৌহিদুল হক বলেন, লুট হওয়া অস্ত্র যদি উদ্ধার করা না হয় তবে নিরাপত্তার ঝুঁকি থেকেই যায়। যদিও কতোগুলো অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে তার হিসাবও আমাদের হাতে পরিপূর্ণভাবে নাই। পুলিশ যেটা বলছে তার মধ্যেও আনুমানিক সংখ্যা আছে। যখন অগ্নিসংযোগ, হামলা চালিয়ে কোনো কিছু লুট হলে পরিপূর্ণ হিসাব করা কঠিন হয়ে পড়ে। তবে এর চেয়ে বড় বিষয় হলো যতগুলোর হিসাব দিচ্ছে পুলিশ সেগুলো উদ্ধার করা। ৫ মাসে যতগুলো উদ্ধার হয়েছে সেগুলো যে খুব প্রত্যাশিত সেটিও বলার সুযোগ নাই। তাই নিরাপত্তার স্বার্থে লুট হওয়া অস্ত্রগুলো পুলিশ ও যৌথবাহিনী আলাদা আলাদাভাবে কারা লুট করেছে তাদের পরিচয় বের করা হবে এমন ঘোষণাই আমরা শুনেছিলাম। কিন্তু ৫ মাস পরেও এই অবস্থায় উদ্বেগ কোনো ভাবে কমানো যাচ্ছে না। কারণ এই অস্ত্রগুলো যখনই কোনো অপরাধপ্রবণ ব্যক্তি বা সন্ত্রাসীদের কাছে থাকবে তারা সুযোগ পেলেই অস্ত্রগুলো ব্যবহার করবে।মানবজমিন