ডেস্ক রির্পোট:- জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠনের তৎপরতা চলছে। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া ছাত্র সংগঠন ও বিভিন্ন ফ্রন্টের নেতারা এই নতুন দলের নেতৃত্বে থাকছেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যম সারির নেতা, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, গণমাধ্যমের পরিচিত মুখ এমন ব্যক্তিদের যুক্ত করতে নেপথ্যে যোগাযোগ চলছে। উদ্যোক্তাদের পরিকল্পনা ঠিক থাকলে নতুন বছরের শুরুতেই আত্মপ্রকাশ করতে পারে নতুন দল। দলের কাঠামো, গঠনতন্ত্র নিয়ে কাজ চলছে। এসব কাজের অনেকটাই গুছিয়ে আনা হয়েছে বলে উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন। নতুন দলের প্রতি জনসমর্থন তৈরি এবং সাধারণ মানুষের মাঝে এর গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে উদ্যোক্তারা যোগাযোগের কাজ শুরু করেছেন। তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন ও প্রবীণ রাজনীতিবিদদের সঙ্গে আলোচনা করছেন, পরামর্শ নিচ্ছেন। নতুন এই রাজনৈতিক দল গঠনের তৎপরতায় রাজনীতির মাঠেও কৌতূহল দেখা দিয়েছে। দলটিতে কারা যুক্ত হচ্ছেন। এর নাম কী হবে। কি লক্ষ্য নিয়ে এগোবে নতুন দল এমন নানা প্রশ্ন রয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। এ ছাড়া নতুন দল গঠনের প্রক্রিয়া নিয়েও আছে নানা জিজ্ঞাসা। বিদ্যমান রাজনৈতিক দলের নেতারাও নতুন দল গঠনের প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানাচ্ছেন। তবে অনেকে বলছেন, স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় যাতে নতুন দল রাজনীতির মাঠে আসে। এতে রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা তৈরি হবে। অতীতের মতো ক্ষমতার ছত্রছায়ায় কোনো দল গঠন হলে জনগণের মধ্যে প্রশ্ন দেখা দেবে। এমন কোনো দল সাধারণ মানুষ গ্রহণও করবে না।
নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়ায় মুখ্য ভূমিকায় আছে জাতীয় নাগরিক কমিটি। জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানের পর এই কমিটি আত্মপ্রকাশ করেছিল। নাগরিক কমিটিকে ঘিরেই নতুন দলের কাঠামো গড়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে সর্বোচ্চ সংখ্যক শ্রেণি-পেশার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন উদ্যোক্তারা। সম্ভাব্য নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়ার অগ্রগতি নিয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন মানবজমিনকে বলেন, নতুন দলের গঠনতন্ত্র প্রস্তুত, সামগ্রিক কাঠামো ও রূপরেখা প্রণয়নের কাজ শেষ পর্যায়ে। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে আমাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম চলমান রয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের বিভিন্ন শক্তির সঙ্গেও আমরা নতুন দলের বিষয়ে নানা আলাপ-আলোচনা ও পরামর্শ করছি। সব ধরনের কার্যক্রম শেষ করার পরে নতুন দলের ঘোষণা আসবে। সম্ভাব্য সময়সীমা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যেহেতু অনেক ধারাবাহিক প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পরই নতুন দলের বাস্তব রূপ লাভ করার বিষয়টি সামনে আসবে, সেক্ষেত্রে আরও কিছুটা সময় দরকার। সে সময় এক মাসের আশেপাশে হতে পারে বলেও তিনি ইঙ্গিত দেন। নতুন দলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শীর্ষ সমন্বয়কদের অংশগ্রহণ থাকবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের ব্যাপারে তারাও চিন্তা ভাবনা করছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি স্বতন্ত্রভাবে কাজ করছে। তবে জেলা ও তৃণমূল পর্যায়ে সাংগঠনিক কার্যক্রমে আমাদের উভয়পক্ষের সমন্বয় রয়েছে। সে সমন্বয়ে ও সহযোগিতার বহিঃপ্রকাশ আগামীতে নতুন রাজনৈতিক দলেও থাকতে পারে। নতুন দলে শুধু বৈষম্যবিরোধী নয়, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে যেন একই প্ল্যাটফরমে একই সঙ্গে আসার ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়া হবে।
বৈষম্যবিরোধী প্ল্যাটফরম থেকে যারা নতুন রাজনৈতিক দলে যাবেন তাদের সঙ্গে প্ল্যাটফরমের সঙ্গে আর সম্পৃক্ত থাকবে না বলে জানিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক আব্দুল কাদের। তিনি বলেন, আগস্টের শুরুতেই আমরা আন্দোলনের কর্মসূচি ঠিক করার সময় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কখনো রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে কাজ করবে না। এই ব্যানারের কার্যক্রম সব সময়ও অরাজনৈতিক থাকবে। সামনে কোনো নতুন দল আত্মপ্রকাশ করলে, এই ব্যানার থেকে সরে গিয়ে সেখানে যুক্ত হতে পারেন। এটা যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে এই ব্যানারে থেকে নতুন রাজনৈতিক দলে যাওয়ার সুযোগ নেই। সম্ভাব্য নতুন রাজনৈতিক দলে সরকারে থাকা উপদেষ্টাদের দুই/একজনকেও দেখা যেতে পারে বলে সূত্র জানিয়েছে। নতুন দল গঠন হলে তারা উপদেষ্টার পদ ছেড়ে দলের দায়িত্ব নিতে পারেন। তবে এ বিষয়টি এখনও চূড়ান্ত নয়। সামনে নতুন দল গঠিত হলেও জাতীয় নাগরিক কমিটি কিংবা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন-কোনোটির বিলুপ্তি বা সংগঠনিক কার্যক্রম ব্যাহত হবে না বলেও জানিয়েছে সূত্রটি।
গত ১৬ই ডিসেম্বর জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানানো শেষে জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসিরুদ্দীন পাটওয়ারী জানিয়েছিলেন, আগামী এক-দুই মাসের মধ্যে রাজনৈতিক দল ঘোষণা করা হবে। তিনি বলেন, আমরা জাতীয় নাগরিক কমিটি এখনো রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করিনি। আমরা একটি রাজনৈতিক উদ্যোগ, যে উদ্যোগগুলো ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে অনেকগুলো শক্তি মাঠে এসেছিল, যারা আওয়ামী ফ্যাসিবাদকে পরাজিত করেছিল এবং যারা বাংলাদেশকে নতুনভাবে সাজাতে চায়। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি থেকে মুক্ত করে বাংলাদেশকে একটি সুন্দর জায়গায় নিয়ে যেতে চায়। আগামীর বাংলাদেশকে সুন্দরভাবে স্বপ্নভূমি দক্ষিণ এশিয়া এবং বিশ্বমঞ্চে উপস্থাপন করতে চায়। সে জায়গা থেকে জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশে একটি সুন্দর দল উপহার দেবে।
নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে বিভিন্ন দল। বিএনপি’র পক্ষ থেকে বলা হয়েছে ক্ষমতার ছত্রছায়ায় দল গঠন হলে সেটা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। বিএনপি’র সমমনা দলগুলোও এমন বক্তব্য দিয়েছে।
উল্লেখ্য, গত ৮ই সেপ্টেম্বর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে আত্মপ্রকাশ ঘটে জাতীয় নাগরিক কমিটির। রাষ্ট্রের সংস্কার ও পুনর্গঠনের লক্ষ্যে আন্দোলনে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞে জড়িতদের বিচারের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কর্মসূচি গ্রহণ, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা ও জবাবদিহির পরিসর তৈরি, বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক উদ্যোগের সঙ্গে আলোচনা, ফ্যাসিবাদী কাঠামো ও শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ অব্যাহত রাখাসহ ৮ দফা নিয়ে গঠিত হয় প্ল্যাটফরমটির। ৫৫ সদস্য নিয়ে যাত্রা শুরু হওয়া এই প্ল্যাটফরমের আহ্বায়ক হন নাসিরুদ্দীন পাটওয়ারী এবং সদস্য সচিব হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক সমাজকল্যাণ সম্পাদক আখতার হোসেন। মুখপাত্র করা হয় সামান্তা শারমিনকে। পরে প্ল্যাটফরমটিকে আরও গতিশীল করার লক্ষ্যে সাংগঠনিক কাঠামো পুনর্গঠন করা হয়। সেই কমিটিতে ৮ জনকে যুগ্ম আহ্বায়ক, ৮ জনকে যুগ্ম সদস্য সচিব, ৫ জনকে সহ-মুখপাত্র, ৪ জনকে যুগ্ম মুখ্য সংগঠক এবং ১৪ জনকে সংগঠক করা হয়। এ ছাড়া সর্বশেষ গত ১৮ই ডিসেম্বর রাতে আরও ৪০ জন সদস্যকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে যুক্ত করা হয়। এর ফলে বর্তমানে এই প্ল্যাটফরমটির সদস্য সংখ্যা ১৪৭-এ দাঁড়িয়েছে। তৃণমূল পর্যায়ে সংগঠনটিকে ছড়িয়ে দিতে কাজ করেছে প্ল্যাটফরমটি। গত ৩ মাসে তাদের আত্মপ্রকাশ করার পর থেকে বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় শতাধিক কমিটি গঠন করে সংগঠনটি বিস্তৃতি লাভ করেছে।
গত ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকায় বিজয় র্যালির আয়োজন করে জাতীয় নাগরিক কমিটি। ওইদিন বিকালে প্ল্যাটফরমটির কার্যালয় বাংলামোটর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অভিমুখে বড় মিছিল নিয়ে কর্মসূচি পালন করে প্ল্যাটফরমটির নেতারা। এটিই ছিল তাদের সবথেকে বড় শোডাউন। বিজয় র্যালিতে ঢাকার বিভিন্ন থানার পাশাপাশি বিভিন্ন জেলা, উপজেলা ও থানা থেকে অনেকে যুক্ত হন।
এদিকে গত ১৮ই ডিসেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক সমাবেশে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনে সারা দেশের সব সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার অপসারিত কাউন্সিলরদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা চায় জাতীয় নাগরিক কমিটি। তাদের এমন বক্তব্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। বিএনপি ও তার অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মীরা বিষয়টিকে ‘আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন’ হিসেবে উল্লেখ করে সমালোচনা করেছেন। যদিও জাতীয় নাগরিক কমিটি এটাকে কারও পুনর্বাসন নয়, ‘মিস কমিউনিকেশন’ বলে উল্লেখ করে।
ওদিকে জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতাদের মাধ্যমে নতুন রাজনৈতিক দল হলে এর সঙ্গে জাতীয় নির্বাচনের আগে সংস্কার চাওয়া দলগুলোর মধ্যে জোট গঠনের চেষ্টাও আছে। জোট গঠনের লক্ষ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক কমিটির সঙ্গে বেশকিছু রাজনৈতিক দলের আলোচনা চলছে। ‘সমঝোতা মঞ্চ’ অথবা ‘সংস্কার মঞ্চ’ নামে জোটটির আত্মপ্রকাশ হতে পারে।মানবজমিন