ডেস্ক রির্পোট:- বিপ্লব যখন সমাজে বিদ্যমান ক্ষমতাসীন শ্রেণির ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি বিলোপ করে একটি নতুন সমাজ বা রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে তোলার চেষ্টা করে, তখন ক্ষমতাচ্যুত শ্রেণি এবং তাদের অনুসারীরা ক্ষমতায় ফিরে আসার জন্য যে প্রচেষ্টা চালায়, সেটাই হলো প্রতিবিপ্লব। এই প্রক্রিয়া মূলত বিপ্লবের বিরুদ্ধচারী শক্তির পুনরুত্থানের প্রচেষ্টা।
বিপ্লবের পরিপূর্ণতায় সবচেয়ে বড় বাধা প্রতিবিপ্লব।
বিপ্লব একটি সমাজে বিদ্যমান শোষণমূলক ও বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা উল্টে দিয়ে, সাধারণ জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের লক্ষ্য নিয়ে পরিচালিত হয়। এটি সাধারণত গণমানুষের দাবি ও স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে এবং নতুন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামো তৈরি করতে চায়।
অন্যদিকে প্রতিবিপ্লবের উদ্দেশ্য বিপ্লবের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত নতুন কাঠামোকে ধ্বংস করে পুরনো ব্যবস্থাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। ক্ষমতা হারানো শাসকগোষ্ঠী আবার তাদের পূর্ব অবস্থানে ফিরে আসতে চায় এবং বিপ্লবের অর্জনগুলোকে মুছে ফেলার চেষ্টা করে।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনকে অনেকে ‘আগস্ট বিপ্লব’ আবার অনেকেই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান বলে অভিহিত করছেন। ৫ আগস্ট দেশে বিপ্লব বা গণ-অভ্যুত্থান যাই ঘটুক না কেন, সেই পরিবর্তনকে পাল্টে দেওয়ার যেকোনো চেষ্টা বা ষড়যন্ত্রকে ‘প্রতিবিপ্লব’ বলা যেতেই পারে।
সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পরে বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতিবিপ্লবের চেষ্টা চলছে বলে মন্তব্য করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দিলারা চৌধুরী। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম দায়িত্ব প্রতিবিপ্লবকে ঠেকানো। কারণ যাদের আপনি ক্ষমতাচ্যুত করছেন, তারা তো আবার ক্ষমতা ফিরে পেতে চাইবে।
সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকেও একাধিকবার বিগত সরকারের সহযোগীদের বিভিন্ন ষড়যন্ত্র এবং প্রতিবিপ্লবের উদ্দেশ্যে দেশে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করে হচ্ছে বলে জানানো হয়েছে।
প্রতিবিপ্লবের আশঙ্কা প্রসঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক তাহমিদ আল মুদ্দাসসির চৌধুরী বলেন, প্রথম থেকে আমরা প্রতিবিপ্লবের আশঙ্কা করছি। ৫ আগস্টের পর প্রথমে জুডিসিয়াল ক্যু করার চেষ্টা করা হয়। এরপর সরকারি বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মচারীরা চেষ্টা করেছে সরকারকে কীভাবে অকার্যকর করা যায়। এর সবগুলোকেই আমরা ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই দেখছি। বিগত সময়ে যে ফ্যাসিস্ট কাঠামো তৈরি করা হয়েছিল, তারা নানাভাবে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য কাজ করেছে।
তিনি আরও বলেন, বিগত ফ্যাসিস্ট যখন একের পর এক সবগুলো ষড়যন্ত্রে ব্যর্থ হয়েছে, তখন তারা সংখ্যালঘু কার্ড খেলার চেষ্টা করেছে। তারা নিজেরাও সংখ্যালঘুদের ওপরে আক্রমণ করেছে। সেগুলোকে আবার ভারতীয় মিডিয়ায় অনেক বাড়িয়ে অপপ্রচার করছে। চিন্ময় কৃষ্ণ দাস গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে আওয়ামী লীগ তাদের লোকজনকে হিন্দু হিসেবে মোবিলাইজ করার চেষ্টা করছে, ইসকনের মিছিল থেকে জয় বাংলা স্লোগান দেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি রিকশাচালকদের আন্দোলনে ছাত্রলীগের উপজেলা পর্যায়ের একজন নেতৃত্ব দিয়েছেন। এসব ঘটনায় আমাদের কাছে পরিষ্কার আওয়ামী লীগ ভিন্ন ভিন্ন রূপে ফিরে আসার চেষ্টা এবং ষড়যন্ত্র করছে।
ছাত্র-জনতা বিগত সরকারের সকল ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় সজাগ, সদাজাগ্রত রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম এই সংগঠক।
অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে প্রতিবিপ্লবের সম্ভাবনা দেখছেন কি না জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, বর্তমানে যেসব ঘটনা ঘটছে তার অধিকাংশের পেছনেই কোনো না কোনোভাবে পতিত সরকারের সম্পর্ক রয়েছে। দেশে গণতন্ত্র ফিরে আসার পরে যারা বিভিন্ন দাবি, প্রতিবাদ, বিক্ষোভের নামে যে ঘটনাগুলো ঘটছে, সেটা এই মুহূর্তে ঘটার কথা নয়। দীর্ঘকালীন একটা ফ্যাসিবাদী শাসনের পরে একটা নতুন ব্যবস্থাপনা যখন এসেছে, তখন একটু সময় দেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু সে সময়ের আগেই যা ঘটছে, তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক ও সন্দেহজনক। আমাদের ধারণা এর পেছনে কোনো না কোনো দেশি-বিদেশি শক্তি কাজ করছে।
প্রতিবিপ্লবের প্রশ্নই ওঠে না মন্তব্য করে শামসুজ্জামানা দুদু আরও বলেন, কিছু গোষ্ঠী হয়তো এখানে কাজ করছে। তবে ব্যাপক জনগোষ্ঠী যেকোনো সময়ের চেয়ে সুদৃঢ় ইস্পাত কঠিন ঐক্যবদ্ধ আছে, যারা এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে তারা দেশের রাজনীতি সম্বন্ধে একেবারেই অজ্ঞ না হয় তারা এতটাই উচ্চাঙ্ক্ষায় আছে, বাস্তবতার সঙ্গে তার কোনো মিল নেই।
ফ্যাসিবাদের দেশি-বিদেশি দোসররা মিলে গণঅভ্যুত্থানকে নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্র করছে বলে মনে করেন গণসংসতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি। তিনি বলেন, ফ্যাসিবাদের দেশি-বিদেশি দোসররা মিলে ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকে নস্যাৎ করার জন্য নানান ষড়যন্ত্র করছে। কিন্তু জনগণের ঐক্যবদ্ধ শক্তি যেভাবে ফ্যাসিবাদী সরকারকে উৎখাত করেছে, তেমনিভাবে তাদের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে বাংলাদেশে নতুন একটি গণতান্ত্রিক বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠা করবেই, জনগণের বিজয় অনিবার্য। এই বিজয়কে কেউ ঠেকাতে পারবে না।
দেশে বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রতিবিপ্লবের সম্ভাবনা কতটুক রয়েছে জানতে চাইলে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, প্রথমত আমি মনে করি, এটা ছাত্র-জনতা-শ্রমিকের স্বতঃস্ফূর্ত গণঅভ্যুত্থান। এই ধরনের কোনো অভ্যুত্থানের পর আমি কোনো প্রতিবিপ্লবের সম্ভাবনা দেখি না।
তিনি আরও বলেন, গণঅভ্যুত্থানের যে আকাঙ্ক্ষা, যা ৯০ সালে আমরা বাস্তবায়ন করতে পারি নাই, মুক্তিযুদ্ধের পুরো চেতনা আমরা বাস্তবায়ন করতে পারি নাই। জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলে আমরা কতটুকু জনমানুষের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করতে পারব, সেই প্রশ্ন উঠতে পারে। কিন্তু প্রতিবিপ্লবের কোনো কারণ আমি এখনও দেখছি না। কারণ গণঅভ্যুত্থানের চেতনা যেভাবে জাগ্রত হয়ে আছে, কেউ যদি বাংলাদেশকে সংকটে ফেলতে চায়, সে পতিত স্বৈরাচার কিংবা দেশি-বিদেশি বা সাম্প্রদায়িক অপশক্তি হোক না কেন, এটা তারা পারবে না।
এ বিষয়ে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, বর্তমান সময়ে একদিকে ব্যাটারিচালিত রিকশাশ্রমিক, গার্মেন্টস শ্রমিকদের বাঁচার জন্য ন্যায্য দাবির আন্দোলন আছে। অন্যদিকে আবার ইসকন থেকে শুরু করে আনসার বিদ্রোহসহ আরও কিছু বিষয় রয়েছে, এসবের মধ্যে মনে হচ্ছে কোনো নেটওয়ার্ক কাজ করছে। তারা মনে করছে, এসব ঘিরে কোনো স্পার্ক তৈরি করা যায় কি না, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-সহিংসতা তৈরি করে সরকার দেশ চালাতে পারছে না—এমন পরিস্থিতি তৈরি করা, এসব কারণে সরকার যদি পুরোপুরি ফেইল করে, তাহলে আওয়ামী লীগ থেকে শুরু করে পুরনোরা ফিরে আসার এক ধরনের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। তবে সেটা সফল হওয়ার কোনো কারণ নেই, মানুষ এখন ঐক্যবদ্ধ। ঐক্যই এখন আমাদের সবচেয়ে বড় পুঁজি। তারা নানা চেষ্টা করবে, কিন্তু আমরা যদি আমাদের ঐক্য ধরে রাখতে পারি, তাদের কোনো প্রচেষ্টাই সফল হবে না। পাশাপাশি সরকারের একটা বীরোচিত ভূমিকা দরকার।
দেশে প্রতিবিপ্লবের কোনো পরিস্থিতি রয়েছে কি না জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এস এম আলি রেজা বলেন, এখন দেশে প্রতিবিপ্লবের কোনো সম্ভাবনা নাই। আমরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের লেন্স দিয়ে যেভাবে দেখি, যেকোনো বিপ্লবের পর সমাজে স্বাভাবিক কিছু অস্থিরতা থাকে। এখন সরকার সেটাকে কীভাবে এড্রেস করছে, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলানিউজ