তাপসের ভয়ংকর কারবার,গ্রেপ্তারের পর জেলহাজতে

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ৫ নভেম্বর, ২০২৪
  • ৫৫ দেখা হয়েছে

ডেস্ক রির্পোট:- সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সঙ্গে নিয়ে গান গাওয়া, ভারতীয় নায়িকা সানি লিওনকে নিজের মেয়ের বিয়েতে অতিথি করে নিয়ে আসা, এক নায়িকার সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে নিজ স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন, গানবাংলা চ্যানেল অবৈধ দখলসহ নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন তিনি। তার পুরো নাম কৌশিক হোসেন তাপস। তিনি গানবাংলার সিইও এবং চেয়ারম্যান। গ্রেপ্তারের পর গতকাল সোমবার তাকে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে।

তাপস সম্পর্কে জানা গেছে চাঞ্চল্যকর অনেক তথ্য। একসময় বাসাবাড়িতে ঘুরে ঘুরে প্রাইভেট পড়িয়ে জীবন চলত তার। কম বেতনে করেছেন বেসরকারি চাকরি। বেসরকারি টেলিভিশনে ছিলেন তবলাবাদক। আবৃত্তিশিল্পী রবিশঙ্কর মৈত্রীর নামে নিবন্ধন পাওয়া বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ‘গানবাংলা’ অবৈধভাবে নিজের দখলে নিয়েছেন তিনি। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাপকে। শনৈ শনৈ উন্নতি হয়েছে তার। বিতর্কিত এই ব্যক্তির কর্মকাণ্ড নিয়ে রয়েছে নানা আলোচনা ও সমালোচনা। গানবাংলায় তার বহুল আলোচিত কালা স্টুডিওতে ফাঁদে ফেলে এবং সরকারের বিভিন্ন মহলকে ম্যানেজ করে বড় বড় কাজ বাগিয়ে নিতেন তিনি। বিগত সরকারের পজিটিভ ইমেজ প্রচার ও মুজিব শতবর্ষের প্রচারের কাজে বড় ধরনের জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ২০১৮ সালে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সপ্তাহের ‘অনির্বাণ আগামী’ শীর্ষক আলোক উৎসবে আর্থিক জালিয়াতি করেছেন তিনি। এই বিষয়ে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) একাধিক অভিযোগও রয়েছে। বহুল আলোচিত সেই কৌশিক হোসেন তাপসকে রোববার রাতে রাজধানীর উত্তরা থেকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। উত্তরা পশ্চিম থানায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিবর্ষণের মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে সাত দিনের রিমান্ড আবেদনসহ আদালতে নেয় পুলিশ। আদালত আগামীকাল বুধবার রিমান্ড শুনানির দিন ধার্য করেছেন। পরে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রূপচর্চা ও ফ্যাশন বিশেষজ্ঞ হিসেবে দেশে-বিদেশে পরিচিত ফারজানা মুন্নীর মেয়েকে প্রাইভেট পড়াতেন তাপস। ছাত্রীর মাকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে বিয়ে করেন চতুর তাপস। ধনাঢ্য ওই নারীকে উপরে ওঠার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করেন তিনি। মুন্নীর বিরুদ্ধে নানা অনৈতিক কারবারে সম্পৃক্ততার অভিযোগ বহু পুরোনো। তার সঙ্গে যোগ দেন ধুরন্ধর তাপস। স্বামী-স্ত্রী মিলে দেদার চালিয়ে যান নানা অপকর্ম। টাকা কামানোর লক্ষ্যে ঠিকাদারি, গানের পরিচালক, গানে সুর করা ছাড়া জমির দালালিও করেছেন তিনি। রয়েছে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের অভিযোগ।

যেভাবে গানবাংলা তাপসের দখলে:

গানবাংলা বিনোদন চ্যানেলটি আবৃত্তিশিল্পী রবিশঙ্কর মৈত্রীর। ২০১১ সালের ২৪ অক্টোবর তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় থেকে গানবাংলা টেলিভিশনের লাইসেন্স পান রবিশঙ্কর। ২০১২ সালের ১ জুলাই তাপস আর ফারজানা আরমান মুন্নী ৮০ লাখ টাকার দুটি শেয়ার কিনে পরিচালক হন। রবিশঙ্কর মৈত্রকে কৌশলে সাজানো মামলায় ফাঁসিয়ে গানবাংলার সব নিজের নিয়ন্ত্রণে নেন। অভিযোগ রয়েছে চ্যানেলটি তাপসকে দিতে সহযোগিতা করেছিলেন তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর তৎকালীন ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি আশরাফুল আলম খোকন।

গানবাংলা চ্যানেলটির পুরো নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তাপস নানা অপকর্ম করতেন। গানবাংলায় দেশি-বিদেশি শিল্পী নিয়ে আসতেন। ইউক্রেন ও ফিলিফাইনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে নারী শিল্পীদের নিয়ে আসতেন তাপস। তাদের গুলশান ও খিলক্ষেত এলাকার কয়েকটি অভিজাত হোটেলেও লাইভ মিউজিক শিল্পী ও নৃত্য শিল্পী হিসেবে সরবরাহ করতেন। এর মাধ্যমে তিনি হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা। অনেক শিল্পীর গান চুরিরও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তিনি বাংলার অনেক জনপ্রিয় গান ধ্বংস করেছেন বলেও প্রকৃত শিল্পীদের অভিযোগ। তার বিষয়ে একজন শিল্পী আক্ষেপ করে বলেন, ‘তাপস দেশের সংগীত অঙ্গনে বড় ক্ষতির জন্য দায়ী।’

বহুল আলোচিত কালোঘর স্টুডিও : গানবাংলা ভবনে ‘কালোঘর স্টুডিও’ নামে বিশেষ স্টুডিও ছিল। চারদিকে কালো কাঁচে ঢাকা থাকত স্টুডিওটি। ফলে এর নাম হয় ‘কালোঘর স্টুডিও।’ সেখানে প্রায় প্রতিরাতে বসত বিশেষ আসর। আসরে থাকত দেশি-বিদেশি মডেল, নায়িকা ও তরুণীরা। আয়োজন থাকত মদপান ও সিসা সেবনেরও। সেখানে জড়ো হয় বিশেষ শ্রেণির ধনী মানুষ। পছন্দ মতো বিশেষ জনের সঙ্গে একান্তে সময় কাটানোর ব্যবস্থা রয়েছে কালোঘর স্টুডিওতে। সেগুলো ভিডিও করে রাখত তাপস। সেখানে যাওয়া ব্যক্তিরা পরবর্তীতে ক্রমাগত ব্লাকমেইলিংয়ের শিকার হয়েছেন। ঠিকাদারি কাজ বাগিয়ে নেওয়া, বড় বড় তদবির করাসহ নানা ভাবে অর্থ আদায় হতো ব্লাকমেইল করা লোকজনের কাছ থেকে। কালোঘর স্টুডিওতে কাজ করার জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে তরুণীদের আনা হতো। একাধিক ব্যক্তি ব্লাকমেইলিংয়ের বর্ণনা দিয়েছেন কালবেলার কাছে।

মেয়ের বিয়েতে সানি লিওনকে এনে বিতর্ক : স্ত্রী ফারজানা মুন্নীর প্রথম ঘরের মেয়েকে প্রাইভেট পড়াতে গিয়ে মুন্নীর সঙ্গে তাপসের পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা। সেই প্রাইভেট ছাত্রীর বিয়েতে ২০২২ সালের ১৪ মার্চ ঢাকায় আসেন বহুল আলোচিত নায়িকা সানি লিওন ও তার স্বামী ড্যানিয়েল। রাজধানীর গুলশানে শেফস টেবিল রেস্টুরেন্টে জমকালো বিয়ের আয়োজন করা হয়েছিল। বিয়েতে সানি লিওন পারফর্মও করেছেন। তার আগে কয়েক দফায় সানি লিওন ঢাকায় আসার চেষ্টা করেন। কিন্তু তথ্যমন্ত্রণালয় তাকে অনুমতি দেয়নি। তাপস-মুন্নীর মেয়ের বিয়েতে সানি লিওনের যোগ দেওয়াকে কেন্দ্র করে সরব ছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। ওই সময় বিষয়টি ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়।

গোপন কনসার্ট কারবার : তাপস বিভিন্ন সময়ে মুম্বাইয়ের জনপ্রিয় শিল্পী নোরা ফাতিহি, উর্বশী রাউ তেলাসহ বলিউডের অনেক নায়িকা ও শিল্পীদের ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে এনে গোপন কনসার্ট করতেন। ওইসব কনসার্টের প্রতিটি টিকিটের দাম হাঁকা হতো ১ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত। ওইসব সেলিব্রেটিদের সঙ্গে একটি ছবি তোলার জন্যও দিতে হতো লাখ লাখ টাকা।

আলোক উৎসবে দুর্নীতি

২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সপ্তাহের দ্বিতীয় দিনে ‘অনির্বাণ আগামী’ শীর্ষক আলোক উৎসব হয়। তৎকালীন দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২০ হাজার মেগাওয়াটের মাইলফলক স্পর্শ করায় রাজধানীর তিনটি পয়েন্টে বর্ণিল আলোক উৎসবের আয়োজন করে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়। হাতিরঝিল, সদর ঘাট ও বসুন্ধরা আন্তর্জাতিক কনভেনশন সেন্টারে ওই উৎসবে তাপসকে বরাদ্দ দেওয়া হয় ২৭ কোটি টাকা। ওই সময় দুদকে জমা পড়া এক অভিযোগে বলা হয়, মাত্র ২ কোটি টাকা ব্যয় করে ২৭ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছিলেন তাপস। তার ওই দুর্নীতির বিরুদ্ধে কেউ মুখ খোলার সাহস পায়নি। রহস্যজনক কারণে দুদকও তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করেনি।

জয় বাংলা কনসার্টে অনিয়ম

কৌশিক হোসেন তাপস জয় বাংলা কনসার্টসহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কনসার্ট করে কোটি-কোটি টাকা হাতিয়েছেন। দেশের জনপ্রিয় সংগীতশিল্পীদের অনেকেই তাপসের পেছনে পেছনে ঘুরতেন বড় আয়োজনে গান করার জন্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ স্মরণে ২০১৫ সাল থেকে প্রতি বছর জয় বাংলা কনসার্টের আয়োজন হয়। সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) যুব শাখা ‘ইয়াং বাংলা’ এই কনসার্টের আয়োজনে থাকলেও ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ও শিল্পী আনাসহ যাবতীয় কাজ করতেন তাপস। এই কনসার্টের মাধ্যমে ব্যাপক জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

মুজিব বর্ষ ও নির্বাচনের আগে প্রচার

২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের প্রচার চালাতে প্রায় সাড়ে তিনশ কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ পান তাপস। প্রায় ৮০ কোটি টাকা ঘুষ দিয়ে ওই কাজ নেন বলে অভিযোগ রয়েছে। নামমাত্র প্রচার চালিয়ে ওই অর্থের পুরোটাই তিনি আত্মসাৎ ও বিদেশে পাচার করেন। এ ছাড়াও মুজিব বর্ষ উপলক্ষে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকার প্রচারের কাজ করেন তাপস। এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে তার বিরুদ্ধে পৃথক দুটি অভিযোগ জমা হয়েছে বলে দুদকের একজন পরিচালক কালবেলাকে নিশ্চিত করেছেন।

গানবাংলার নামে ভবন দখল

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় গানবাংলা ভাঙচুর করা হয়। বারিধারা জে ব্লকে ভবনটির অধিকাংশ ফ্লোরজুড়ে ছিল চ্যানেলটির স্টুডিও সেটআপ, শুটিং ফ্লোর, সাউন্ড সিস্টেম, এডিটিং প্যানেল, সম্প্রচার যন্ত্রসহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশ। সেগুলো ভাঙচুর করে আন্দোলনকারীরা। ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে গানবাংলার নামে জে ব্লকে একটি বহুতল ভবন দখল করে নেন তাপস। এ ছাড়াও আওয়ামী সংস্কৃতি অঙ্গনের আস্থাভাজন ও সুবিধাভোগী তাপস ৫ আগস্টের আগেই নিজের রূপ বদলে ফেলেন। তিনি নিজ ফেসবুক প্রোফাইলের রং লাল করে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার চেষ্টা করেন।

গ্রেপ্তারের পর যা জানাল ডিএমপি

তাপসকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি সোমবার দুপুরে আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। সংস্থাটির উপকমিশনার তালেবুর রহমান জানান, রাজধানীর উত্তরায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হামলার ঘটনায় করা মামলার এজাহারনামীয় আসামি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল গানবাংলার চেয়ারম্যান কৌশিক হোসেন তাপসকে ডিবির সহায়তায় গ্রেপ্তার করেছে ডিএমপির উত্তরা পূর্ব থানা পুলিশ। রোববার মধ্যরাতে ভাটারা থানার প্রগতি সরণিতে অবস্থিত গানবাংলা টেলিভিশনের কার্যালয়ে অভিযান পরিচালনা করে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

ডিএমিপি আরও জানায়, তাপস বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলার ঘটনায় উত্তরা পূর্ব থানায় করা একটি মামলার এজাহারনামীয় আসামি। গত ১৮ জুলাই উত্তরা পূর্ব থানাধীন ৪ নম্বর সেক্টরে অবস্থিত আজমপুর নওয়াব হাবিবুল্লাহ হাই স্কুলের সামনে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ইশতিয়াক মাহমুদ গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন। ভিকটিম ইশতিয়াক মাহমুদ বাদী হয়ে গত ২৯ অক্টোবর উত্তরা পূর্ব থানায় একটি মামলা করেন। কৌশিক হোসেন তাপস এই মামলার এজাহারনামীয় আসামি। তদন্তাধীন এ মামলায় গোয়েন্দা তথ্য ও প্রযুক্তির সহায়তায় বাংলা টেলিভিশনের কার্যালয় থেকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সহায়তায় অভিযান পরিচালনা করে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাকে ওই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে ৭ দিনের রিমান্ড আবেদনসহ আদালতে পাঠানো হয়। আদালত আগামীকাল বুধবার রিমান্ড আবেদন শুনানির দিন ধার্য করেছেন। আদালতে তার আইনজীবী জামিন আবেদন করলেও তা না-মঞ্জুর করে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে।

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com
Website Design By Kidarkar It solutions