চট্টগ্রাম:- চট্টগ্রামে সশস্ত্র মিছিল করেছে পতিত স্বৈরাচারী সরকারের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের ক্যাডাররা। ছাত্র জনতার খুনি ফ্যাসিবাদের দোসর ক্যাডার মাস্তানদের বিরুদ্ধে পুলিশ বাহিনীর রহস্যজনক নিরবতা এবং তাদের গ্রেফতারে নির্লিপ্ততার মধ্যে ঘুরে দাঁড়ানোর দুঃসাহস দেখিয়েছে ছাত্রলীগ নামধারী এসব চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা। পুলিশ বাহিনীর প্রতি রীতিমত চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে তারা রাজপথে নেমে পলাতক হাসিনার পক্ষে স্লোগান দিয়েছে। সচেতন মহল বলছে। গতকাল শনিবার ‘নিষ্ক্রিয় পুলিশ, আরামে আওয়ামী দস্যুরা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে পুলিশের নির্লিপ্ততায় আওয়ামী সন্ত্রাসীরা যেকোন সময় ঘুরে দাঁড়াতে পারে বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়। অবশেষে সে আশঙ্কাই সত্য হয়েছে। শেখ হাসিনার জন্মস্থান গোপালগঞ্জের পর চট্টগ্রামে প্রথম প্রকাশ্যে মিছিল করার দুঃসাহস দেখিয়েছে পতিত স্বৈরাচারের দোসর সন্ত্রাসীরা। ছাত্রলীগের মিছিলের প্রতিবাদে গতকাল বিকেলে নগরীর দামপাড়াস্থ মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) সদর দপ্তর ঘেরাও করে মিছিলকারীদের গ্রেফতারে আলটিমেটাম দিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা।
শুক্রবার রাত সাড়ে ১২টায় নগরীর জামালখান সড়কে এই মিছিল বের করা হয়। রাতের নীরবতা ভেঙে বিভিন্ন সেøাগান দেন ছাত্রলীগের ক্যাডাররা। এ সময় তাদের অনেকের হাতে দেশি ও আগ্নেয়াস্ত্র দেখা গেছে বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। মিছিল থেকে খুনি হাসিনার বিরুদ্ধে জারিকৃত গ্রেফতারি পরোয়ানা প্রত্যাহার করার দাবি তোলা হয়। ‘শেখ হাসিনার ভয় নেই- রাজপথ ছাড়ি নাই, এ মুহূর্তে দরকার- শেখ হাসিনার সরকার’ সেøাগানও শোনা যায়। মিছিলটি জামালখান সড়ক ঘুরে চেরাগি মোড়ের দিকে চলে যায়। তাতে অর্ধশতাধিক ক্যাডার অংশ নেয়।
মিছিলের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তাতে দেখা যায়, মিছিলকারীদের আগে পেছনে মোটরসাইকেল আরোহী ক্যাডাররা পাহারা দেয়। কেউ কেউ আবার সেই মিছিলের ভিডিও চিত্রও ধারণ করে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন এসময় আশপাশে কোথাও পুলিশ ছিলো না। হঠাৎ ছাত্রলীগের নামে সেøাগান দিয়ে মিছিল দেখে স্থানীয় লোকজন রীতিমত হতবাক হয়ে যান। তাদের কেউ কেউ সংঘবদ্ধ হয়ে মিছিলকারীদের প্রতিরোধ করারও চেষ্টা করেন।
তবে ঝটিকা মিছিলটি কিছু সময়ের মধ্যে ছত্রভঙ্গ হয়ে অলিগলিতে ঢুকে যায়। বিগত ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার নজিরবিহীন গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। এরপর থেকে পাতালে চলে যায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। সারাদেশে ব্যাপক ধরপাকড় হলে চট্টগ্রামের পুলিশ প্রশাসন ফ্যাসিবাদের দোসর আওয়ামী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো অভিযান পরিচালনা করেনি। ছাত্র জনতার আন্দোলনের বিরুদ্ধে চেরাগির পাহাড় এবং জামালখানে নিয়মিত মিছিল সমাবেশ করেছে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। স্থানীয় বহিষ্কৃত কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমনের নেতৃত্বে সেখানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মীদের উপর দফায় দফায় হামলাও হয়েছে।
তখন প্রকাশ্যে অস্ত্রহাতে শৈবাল দাশ ও তার ক্যাডারেরা জামালখানে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে রাজপথে অবস্থান নিয়ে মিছিল সমাবেশ করেছে। অথচ এখনও পর্যন্ত সে এলাকায় কোন অভিযান পরিচালনা করেনি পুলিশ। হাসিনার সুবিধাভোগী কতিপয় পুলিশ কর্মকর্তা গোপনেই স্বৈরাচারের দোসরদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সুবিধাবাদী এসব পুলিশ কর্মকর্তারা এখনও পতি বিপ্লবের স্বপ্নে বিভোর। চট্টগ্রামে ছাত্র জনতার আন্দোলনে ১১ জন শহীদ হয়েছেন। প্রত্যেকটি ঘটনার সুস্পষ্ট অভিযোগে হত্যা মামলা হয়েছে। এসব মামলায় শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের মহানগর, থানা এবং ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতারাও আসামি। কিন্তু পুলিশ কোন আসামিকেই গ্রেফতার করেনি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, চট্টগ্রামের প্রশাসনে বিশেষ করে পুলিশের মধ্যে পতিত হাসিনার সুবিধাভোগী তৎপর থাকায় আওয়ামী লীগ নীরবেই তাদের গোপন কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা যে ইতোমধ্যে সংঘটিত হয়ে রাজনীতির মাঠ দখলের চেষ্টা করছে তার প্রমাণ হলো শুক্রবার রাতের ঝটিকা মিছিল। ওই মিছিলের পরও পুলিশ আওয়ামী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে জোরদার কোন অভিযান শুরু করেনি। তবে থানার ওসি ফজলুল কাদের চৌধুরী মিছিলের পর চার জনকে গ্রেফতারের তথ্য জানিয়েছেন। জানা গেছে, মুখ রক্ষার জন্য মিছিলের কয়েক ঘণ্টা পর চার পথচারীকে থানায় ধরে নিয়ে গেছে পুলিশ।
সিএমপি ঘেরাও : ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ও ছাত্র হত্যায় জড়িতদের গ্রেফতারের দাবিতে সিএমপি কমিশনারের কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা ও ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সংগঠনটির নেতা-কর্মীদের গ্রেফতারের দাবি জানানো হয় সমাবেশ থেকে। তার আগে নগরীর জামালখান প্রেসক্লাব চত্বরে সমাবেশ কর্মসূচি পালিত হয়। কর্মসূচিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা নানা সেøাগান দেন। সমাবেশে তারা ‘আমার ভাই কবরে-খুনি কেন বাইরে’, ‘আমার সোনার বাংলায়-ফ্যাসিস্টদের ঠাঁই নাই’, ‘আবু সাঈদ মুগ্ধ-শেষ হয়নি যুদ্ধ’, ‘ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা-হুঁশিয়ার সাবধান’ সেøাগান দেন।
কর্মসূচিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক খান তালাত মাহমুদ বলেন, ছাত্রলীগ শিক্ষার্থী ও জনতার ওপর নির্বিচার গুলি চালিয়েছে। অনেক শিক্ষার্থীকে খুন করেছে। কাউকে কুপিয়ে জখম করেছে। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী হামলায় অনেক শিক্ষার্থী হাত-পা হারিয়েছেন। ফলে এ সন্ত্রাসী সংগঠনকে অবিলম্বে নিষিদ্ধ করতে হবে। খান তালাত মাহমুদ বলেন, শুক্রবার গভীর রাতে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা জামালখানে রাস্তায় মিছিল করেছে। এসব সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার করতে হবে।
পুলিশ প্রশাসনে এখনো স্থবিরতা কাজ করছে দাবি করে খান তালাত মাহমুদ বলেন, রাতের অন্ধকারে গণহত্যায় জড়িত ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা রাস্তায় নেমে সেøাগান দিয়েছে। এখানে প্রশাসনের ব্যর্থতা আছে। এখনো যারা বাংলাদেশের দায়িত্বশীল জায়গাগুলোতে বসে আছেন অথচ সরকারকে সহযোগিতা করছেন না, নিজেদের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য কাজ করছেন, তারা ব্যক্তিস্বার্থ থেকে বেরিয়ে আসুন। বাংলাদেশের স্বার্থে কাজ করুন। নয়তো আপনাদের বিরুদ্ধেও আমাদের আওয়াজ উঠবে। আরেক সমন্বয়ক জোবায়ের আলম বলেন, প্রশাসনের বিরুদ্ধে আমাদের এই প্রতিবাদ। প্রশাসন থাকার পরও ছাত্রলীগ মিছিল করেছে। অবিলম্বে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে। কারণ, তারা গণহত্যা চালিয়েছে। পরে বক্তব্য শেষে শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে নগরের দামপাড়া ওয়াসায় অবস্থিত চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেন ও বিক্ষোভ করেন। পাশাপাশি গতকাল রাতে মিছিলকারী ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতারের দাবি জানান। খান তালাত মাহমুদ বলেন, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মিছিলকারীদের গ্রেফতার করতে না পারলে নগর পুলিশের কমিশনারকে পদত্যাগ করতে হবে। বিকেল ৫টায় শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ কর্মসূচি শেষ করেন। ইনকিলাব