
ডেস্ক রির্পোট:- বড় একটি চক্র বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) ক্যাডার, নন-ক্যাডার পরীক্ষাসহ বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করত। রাজধানীসহ দেশব্যাপী রয়েছে এ চক্রের বিস্তার। ফাঁস হয়েছে মেডিকেল ও নার্সিংয়ের প্রশ্নপত্রও। বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীর সঙ্গে প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত এক চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীকে ১০ কোটি টাকার চেকসহ গত মঙ্গলবার আটক করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী প্রশ্নপত্র ফাঁসের এ চক্রের আরও আটজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। হাইপ্রোফাইল কয়েকজন প্রশ্ন ফাঁসকারীর নামও জানা গেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান শুরু করেছে।
এদিকে রাজধানীর পল্টন থানা প্রশ্ন ফাঁস মামলায় গ্রেপ্তার ১০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিন করে রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেছে তদন্তকারী সংস্থা সিআইডি। গতকাল তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার জুয়েল চাকমা আদালতে এ আবেদন করেন। আদালত সূত্রে জানা গেছে, আগামী ১৬ জুলাই আসামিদের উপস্থিতিতে রিমান্ড শুনানি হবে। এরা কারাগারে আটক রয়েছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সৈয়দ আবেদ আলী জড়িত ছিলেন নগদ লেনদেন ও চাকরিপ্রার্থী সংগ্রহের কাজে। পিএসসির সাবেক মেম্বার মাহফুজুর রহমান ছিলেন গাড়িচালক আবেদ আলীর গুরু। পিএসসির কোনো নিয়োগ পরীক্ষা এলেই এই চক্রের সদস্যরা প্রশ্নপত্র ফাঁস করে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিতেন।
গত ৫ জুলাই অনুষ্ঠিত রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করেন তারা। চক্রের সদস্যরা ওই পরীক্ষার আগের রাতে তাদের চুক্তি করা শিক্ষার্থীদের বাসায় রেখে ওই প্রশ্নপত্র ও তার উত্তর দিয়ে দেন। তদন্তে এখন পর্যন্ত আরও অনেকের নাম সামনে এসেছে। এদের মধ্যে হাইপ্রোফাইল আটজনকে শনাক্ত করা গেছে। জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনবে বলে জানিয়েছে সিআইডি। সিআইডির সূত্র জানায়, সৈয়দ আবেদ আলীর হাত ধরে যারা বিসিএস ক্যাডার হয়েছেন, তাদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। ২০১০ সালে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে আবেদ আলীর সম্পৃক্ততা পায় একটি গোয়েন্দা সংস্থা। তাকে গ্রেপ্তারও করা হয়। তিনি স্বীকারও করেছিলেন। প্রশ্নপত্র ফাঁসে কারা জড়িত, অন্যান্য প্রশ্নপত্র কীভাবে ফাঁস করা হয় সেই তথ্যও তিনি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে দেন। তখন বিষয়টি পিএসসির তৎকালীন চেয়ারম্যানকে অবহিত করা হয়েছিল। সে সময় আবেদ আলী পিএসসির চেয়ারম্যানের কাছে অঙ্গীকার করেন যে, আর কখনো প্রশ্ন ফাঁস করবেন না। তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ওই সময়ের পিএসসির চেয়ারম্যান গাড়িচালক আবেদ আলীসহ যে কয়জন কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন তাদের চাকরিচ্যুত করেন।
২০১১ সালে শেরেবাংলা নগর থানায় আবেদ আলীসহ কয়েক জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। ওই মামলায় বিজি প্রেসেরও দুজন কর্মকর্তা আসামি ছিলেন। ২০১৪ সালে বিচার কার্যক্রম শুরু হলে তখন মাত্র দুজন সাক্ষীর জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়। বর্তমানে মামলাটি বিচারাধীন। কিন্তু চাকরিচ্যুত হওয়ার পর আবেদ আলী প্রশ্ন ফাঁসের কাজটি পুরোদমে শুরু করেন। প্রশ্ন ফাঁস করেই কয়েক শ কোটি টাকার মালিক হয়ে যান। তার সঙ্গে বড় একটি গ্রুপ জড়িত। ওই সময় ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নগুলো বিজিপ্রেসে যারা টাইপ করত, সেখানেও ছিল আবেদ আলীর লোক। তারা প্রশ্নগুলো মুখস্থ করে ফেলত। তারা সবাই মিলে প্রশ্ন ফাঁস করত। তারা প্রশ্নপত্র ফাঁস করে বিভিন্ন কোচিং সেন্টারে পাঠাত। সেই কোচিং সেন্টারগুলোও শনাক্ত করে গোয়েন্দা সংস্থা। তবে এদের নেপথ্যের শক্তি এত শক্তিশালী ছিল যে, তাদের কিছুই করা যায়নি। তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ৫ জুলাই রেলওয়ের পরীক্ষা শুরুর আগে আবেদ আলী সাভারের রেডিও কলোনিতে বাসা ভাড়া নিয়ে বুথ তৈরি করেছিলেন। দুই দিনের জন্য ৪০ হাজার টাকায় কক্ষ ভাড়া নেওয়া হয়েছিল। এই কক্ষে ৫০ থেকে ৬০ জন চাকরিপ্রার্থীকে একত্রিত করে প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করানো হয়।
প্রতিজনের কাছ থেকে তিনি ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা নিয়েছেন। আবেদ আলী প্রশ্নপত্র ও উত্তরপত্র নিয়েছিলেন পিএসসির অফিস সহকারী সাজেদুলের কাছ থেকে। কয়েক মাস আগে অনুষ্ঠিত পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও পেয়েছিলেন আবেদ আলী। তখন মিরপুরে দুই দিনের জন্য একটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে বুথ বানান তিনি। সে সময় ৪৪ চাকরিপ্রার্থীর কাছ থেকে তিনি ৪ লাখ টাকা করে নিয়েছিলেন। অন্যান্য সময়ের প্রশ্ন ফাঁসের তথ্যও দেন তিনি। সূত্র জানায়, জবানবন্দিতে পিএসসির অফিস সহকারী সাজেদুল জানিয়েছেন, রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী পদে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তিনি পিএসসির এক সদস্যের কক্ষে থাকা ট্রাঙ্ক থেকে পেয়েছিলেন। এই প্রশ্নপত্র সাবেক গাড়িচালক আবেদ আলী ও ডেসপাস রাইডার খলিলুর রহমানের কাছে ৭৫ লাখ টাকায় বিক্রি করেন। গ্রেপ্তার হওয়া পানি ফিল্টার ব্যবসায়ী সাখাওয়াত জানিয়েছেন, পল্টনের কালভার্ট রোডের একটি বাড়ির দ্বিতীয় তলায় পানির ফিল্টারের গুদাম রয়েছে তাদের। পিএসসির অফিস সহকারী সাজেদুল ইসলাম তার পূর্বপরিচিত হওয়ায় প্রায়ই তার সঙ্গে দেখা করে চাকরিপ্রত্যাশী কেউ থাকলে জানাতে বলতেন তাকে। রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী নিয়োগ পরীক্ষার ৪৪ প্রার্থীকে ওই গুদাম কক্ষে রেখেছিলেন সাজেদুল। সারা রাত চাকরিপ্রার্থীরা প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করে পরদিন পরীক্ষা দিতে যান। জবানবন্দিতে পিএসসির অন্য অফিস সহকারী (ডেসপাস রাইডার) খলিলুর রহমান জানিয়েছেন, তিনি রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী পদে চাকরিপ্রত্যাশী ৫০ জনের কাছ থেকে বিভিন্ন অঙ্কের চেক নিয়েছেন। এই চক্রটি যাদের বুথে ঢুকিয়ে প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করিয়েছে, সবার নামের তালিকা সিআইডির কাছে রয়েছে।বাংলাদেশ প্রতিদিন