ডেস্ক রির্পোট:- ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আবদোল্লাহিয়ানসহ হেলিকপ্টারে থাকা সবাই নিহত হয়েছেন বলে ইরানের কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন। ইরানের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা রয়টার্স বার্তা সংস্থাকে বলেছেন, ‘প্রেসিডেন্ট রাইসি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও হেলিকপ্টারে থাকা অন্য সকল যাত্রী দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে’। তবে স্পর্শকাতর বিষয় হওয়ায় তিনি নাম প্রকাশ করতে চাননি। এদিকে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আবদোল্লাহিয়ানসহ অন্য সরকারি কর্মকর্তাদের মৃত্যুতে দেশজুড়ে পাঁচ দিনের শোক ঘোষণা করেছেন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি। গতকাল সরকারি এক বিবৃতিতে প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ তাদের সফরসঙ্গীদের মৃত্যুতে ইরানের জনগণের প্রতি গভীর শোক ও সমবেদনা জানিয়েছেন তিনি।
সরকারি বিবৃতিতে খামেনি বলেন, আমি আমার প্রিয় ইরানি জনগণের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়ে প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসিসহ অন্যদের মৃত্যুতে দেশজুড়ে পাঁচদিনের সরকারি শোক ঘোষণা করছি।
এর আগে, ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোখবারকে অন্তর্বর্তী দায়িত্ব পালনের জন্য নিয়োগ দেন আলী খামেনি। এ সম্পর্কিত এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, সংবিধানের ১৩১ ধারা অনুসারে মোহাম্মদ মোখবার নির্বাহী বিভাগের নেতৃত্ব দেবেন। খামেনি আরো জানান, আগামী ৫০ দিনের মধ্যে অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য আইন ও বিচার বিভাগের মধ্যে সমন্বয় করে কাজ করবেন। এদিকে, উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলী বাকেরি কানিকে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে ইরানের মন্ত্রিসভা।
গতকাল সকালে পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের পাহাড়ি ও তুষারাবৃত এলাকায় ইব্রাহিম রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টারের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পায় অনুসন্ধানী দল। দেশটির রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে জানানো হয়, সেখানে প্রাণের কোনো চিহ্ন নেই। পুরো হেলিকপ্টারটি ভস্মীভ‚ত হয়ে গেছে। এর আগে, হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হওয়ার এলাকায় একটি ‘হিট সোর্স’ (উত্তপ্ত স্থান) সনাক্ত করেছে তুরস্কের পাঠানো ড্রোন।
রোববার আজারবাইজানের সীমান্তের কাছে দুটি বাঁধ উদ্বোধন করেন প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি। এরপর হেলিকপ্টারে ইরানের উত্তর-পশ্চিমে তাবরিজ শহরের দিকে যাচ্ছিলেন তিনি। তার সঙ্গে ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির আবদোল্লাহিয়ান। তাদের সাথে ইরানের সর্বোচ্চ নেতার প্রতিনিধি আয়াতুল্লাহ মোহাম্মদ আলী আলে-হাশেম থাকতে পারেন বলে সংবাদ সংস্থা রয়টার্স ইরানের সরকারি বার্তা সংস্থা আইআরএনএ-র বরাতে জানিয়েছে। তাবরিজ থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে হেলিকপ্টারটি। কিন্তু ভারী কুয়াশা থাকায় অনুসন্ধান অভিযান চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। রোববারের দুর্ঘটনার পর ইরানের গণমাধ্যমে বর্তমান সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির বক্তব্য প্রচার করা হয়। তিনি জনসাধারণকে প্রার্থনা করার আহŸান জানান। সমর্থকদের তেহরানে প্রার্থনায় সমবেত হতে বলেন। রাষ্ট্রের দৈনন্দিন কর্মকাÐে কোনো প্রভাব পড়বে না বলেও আশ্বস্ত করেন দেশটির সর্বোচ্চ নেতা।
এখনো আন্তর্জাতিক মহল থেকে খুব একটা প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তবে, যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকজন সিনেটর ও রাজনীতিবিদ কথা বলেছেন। সিনেটের ডেমোক্র্যাট নেতা চাক শুমার জানিয়েছেন, মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সাথে তার কথা হয়েছে। ‘এখনো পর্যন্ত কোনো সন্দেহ করার মত কোনো তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি।’ কিন্তু, তিনি ‘পরিস্থিতির দিকে নজর রাখবেন।’ এক সংবাদ সম্মেলনে শুমার বলেন, ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের যে স্থানে কপ্টারটি বিধ্বস্ত হয়েছে, সেখানকার আবহাওয়া অত্যন্ত কুয়াশাচ্ছন্ন ও খারাপ ছিল। তাই এটিকে একটি দুর্ঘটনা বলেই মনে হচ্ছে। তবে, বিষয়টি এখনো পুরোপুরি তদন্তাধীন।
প্রেসিডেন্টের বহরে মোট তিনটি হেলিকপ্টার ছিল। অন্য দুটি হেলিকপ্টার নিরাপদে অবতরণ করেছে। পূর্ব আজারবাইজানের ডেপুটি গভর্নর ফর ডেভেলপমেন্ট আলি জাকারি স্থানীয় গণমাধ্যমকে জানান ‘ওই বহরে তিনটি হেলিকপ্টার ছিল এবং অন্য দুটি নিরাপদে অবতরণ করতে পেরেছে। একটি বিধ্বস্ত হয়েছে।’ নিরাপদে ফেরা হেলিকপ্টারে জ্বালানি মন্ত্রী আলী আকবর মেহরাবিয়ান এবং আবাসন ও পরিবহনমন্ত্রী মেহরদাদ বজরপাশ ছিলেন। ইরানের আধা সরকারি তাসনিম নিউজ এজেন্সি বলছে, হেলিকপ্টারের ভেতরে প্রেসিডেন্টের সাথে থাকা লোকজন জরুরি কল করতে সক্ষম হয়েছিলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্থানীয় গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেন, হেলিকপ্টারের সাথে রেডিও যোগাযোগ করা হয়েছিল, তবে তিনি এর বাইরে আর কোনও ব্যাখ্যা দেননি।
রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা জানায়, রাইসিকে বেল ২১২ মডেলের একটি হেলিকপ্টার বহন করছিল। এই মডেলটি যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি। ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পরে যুক্তরাষ্ট্রের এটি ইরানের কাছে বিক্রি করার কথা নয়। সে হিসেবে উড়োযানটি অন্তত ৪৫ বছরের পুরনো। এর আগেও আকাশপথে দুর্ঘটনায় দেশটির অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। প্রতিরক্ষা ও বিভিন্ন সময়ে পরিবহনমন্ত্রী, ইরানের রেভুল্যুশনারি গার্ড ও সেনাবাহিনীর কমান্ডার বিমান বা হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন।
ইব্রাহিম রাইসি একদিন আগে প্রতিবেশী আজারবাইজানে ছিলেন। তিনি দেশটির প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভের সাথে বাঁধ উদ্বোধন করতে গিয়েছিলেন। ৬৩ বছর বয়সী রাইসি ২০২১ সালে দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে দেশটির মরালিটি বা নৈতিকতা বিষয়ক আইন কঠোর করার নির্দেশ দেন। তাকে একজন কট্টরপন্থী ধর্মীয় নেতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ কারণে তিনি সরকার বিরোধী ব্যাপক বিক্ষোভের মুখেও পড়েছেন।
বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলোর সাথে পারমাণবিক আলোচনায় তিনি কঠোর চাপ সৃষ্টি করেছিলেন। অনেকে মনে করেন তিনি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির উত্তরসূরি হওয়ার জন্য নিজেকে তৈরি করছেন। ২০১৯ সালে সর্বোচ্চ নেতা তাকে বিচার বিভাগের প্রধানের শক্তিশালী পদে নিযুক্ত করেন। রাইসি বিশেষজ্ঞদের অ্যাসেম্বলির ডেপুটি চেয়ারম্যান হিসেবেও নির্বাচিত হন। ইরানে ৮৮-সদস্যের এই বোর্ড দেশটির পরবর্তী সর্বোচ্চ নেতা নির্বাচন করে থাকে।
এদিকে, ইরানের অন্তর্র্বতীকালীন প্রেসিডেন্ট হিসেবে মোহাম্মদ মোখবার-এর নাম অনুমোদন করেছেন সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি। তিনি দুই মাস এ দায়িত্ব পালন করবেন। এর মধ্য পরবর্তীতেও দেশের নেতৃত্ব দেয়ার পথ সুগম হলো তার। ইরানের সংবিধান অনুযায়ী, আগামী ৫০ দিনের মধ্যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করতে হবে।
২০২১ সালের নির্বাচনে রাইসি ক্ষমতায় আসার পর মোখবারকে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। ৬৮ বছর বয়সী এই ক‚টনীতিক সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি’র ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। ২০১০ সালে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন মোখবারকে ‘পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র সংক্রান্ত তৎপরতায়’ জড়িত থাকার অভিযোগে নিষেধাজ্ঞার তালিকায় অন্তর্ভ‚ক্ত করে। সেতাদ নামে একটি বিনিয়োগ তহবিলের দায়িত্বেও ছিলেন তিনি। ভ‚মি থেকে ভ‚মিতে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন সরবরাহ করার চুক্তি করতে মোখবার গত অক্টোবরে রাশিয়া সফর করেন।
রাইসির লাশ উদ্ধার করে নেয়া হয়েছে তাবরিজে, আজ দাফন : ঘন কুয়াশার কারণে রোববার রাতে উদ্ধার তৎপরতা চালানো অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। তবে আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে উদ্ধার কাজে গতি বাড়ে। তুর্কি বার্তা সংস্থা আনাদোলু এজেন্সি জানায়, প্রথমে তুরস্কের বায়রাকতার আকিঞ্জি ড্রোন অবস্থান সনাক্ত করে। সেখানকার অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ ইরানি কর্তৃপক্ষকে জানায় তারা। পরে উদ্ধারকারী দল ঘটনাস্থলে পৌঁছায়।
রেড ক্রিসেন্ট সদস্য ও অন্যদের ধারণ করা বিভিন্ন ভিডিও প্রকাশ করে বার্তা সংস্থা রয়টার্স ও স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো। তাতে দেখা যায়, স্ট্রেচারে করে মৃতদেহ বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবকরা। কুয়াশাচ্ছন্ন পাহাড়ি অসমতল পথে তাদেরকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল। ইরানের বিপ্লবী গার্ডস এর ঘনিষ্ঠ সংবাদমাধ্যম তাসনিম জানায়, সবগুলো মরদেহই তাবরিজে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আজ শেষকৃত্যের আগ পর্যন্ত সেখানকার ফরেনসিক বিভাগেই রাখা হয়েছে লাশ। প্রেসিডেন্ট রাইসি এবং তার সহচরদের গন্তব্যই ছিল তাবরিজ শহর। আরেকটিতে ভিডিওতে, হেলিকপ্টারের একটি দরজা পড়ে থাকতে দেখা গেছে। দরজায় লেখা ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান। সেখানে সমবেত হয়ে আছেন অনেকে। পোশাক দেখে যাদের সেনাসদস্য বলেই প্রতীয়মান হয়। অন্য এক ভিডিওতে দেখা যায়, পাহাড়ের পাদদেশে জড়ো হয়েছেন ইরানের সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তারা।
ইরানের অন্তর্র্বর্তী প্রেসিডেন্টকে পুতিনের ফোন, সম্পর্ক জোরদারের অঙ্গীকার : কিছুক্ষণ আগে জানা গেছে, ইরানের সদ্য দায়িত্ব নেয়া অন্তর্র্বতী প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোখবারকে ফোন করেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন। ফোনালাপে এব্রাহিম রাইসিকে একজন ‘নির্ভরযোগ্য অংশীদার’ বলে অভিহিত করেন পুতিন। ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে এই তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, দুই নেতা ‘রাশিয়া-ইরানের সম্পর্ক আরো শক্তিশালী করতে পারস্পরিক মনোভাব’ ব্যক্ত করেছেন। সূত্র : বিবিসি, পার্সটুডে।