সড়কে মৃত্যুর মিছিল : দায় নিচ্ছে না কেউ,দশ বছরে প্রাণহানি ৭৮ হাজার

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় সোমবার, ১৩ মে, ২০২৪
  • ৯০ দেখা হয়েছে

ডেস্ক রির্পোট:- সড়কে দিনদিন বাড়ছে দুর্ঘটনা, দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। প্রতিবছর প্রাণ যাচ্ছে কয়েক হাজার মানুষের। কিন্তু কেউ নিচ্ছে না এসব দুর্ঘটনার দায়ভার। বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, বেশির ভাগ সড়ক দুর্ঘটনায় হত্যাচেষ্টা ও হত্যাকাণ্ডের ধারায় মামলা হওয়া উচিত। এছাড়া সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ার পেছনে রয়েছে বহু কারণ। বিভিন্ন সময়ে চিহ্নিত করা সমস্যাগুলো বছরের পর বছর জিইয়ে রাখা, আদালতের নিষেধাজ্ঞা না মানা এবং আইনের সঠিক বাস্তবায়ন না করায় লাগাম টানা যাচ্ছে না সড়ক দুর্ঘটনার।

তারা বলছেন, ১৪ বছরে সড়ক যোগাযোগব্যবস্থার বিপুল উন্নয়ন হলেও দুর্ঘটনা হ্রাস পায়নি। সম্প্রতি সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে সড়কে গতি নিয়ন্ত্রণে সরকার যে গাইডলাইন দিয়েছে, তা কতটুকু সুফল বয়ে আনবে-এ নিয়েও সন্দিহান তারা। সড়ক-মহাসড়কে চলাচলরত বিভিন্ন যানবাহনের বেঁধে দেওয়া গতিসীমার যৌক্তিকতা, গতি নিয়ন্ত্রণের কার্যকারিতা নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। এমনকি গতিসীমা নির্ধারণে দুর্ঘটনা কমবে নাকি বাড়বে, এ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৪ থেকে ২০২৩ সাল-১০ বছরে সড়কে ৫৬ হাজার ৩৬০টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭৮ হাজার ১০৭ জন নিহত হয়েছেন। এতে আহত হয়েছেন ১ লাখ ৪০ হাজার ৬৪৯ জন। এ হিসাবে গড়ে বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় ৮ হাজার মানুষের প্রাণহানি এবং ১৪ হাজারের বেশি লোক আহত হয়েছেন। যাদের ৬০ ভাগই হাত-পা বা অন্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হারিয়েছেন।

জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, হাসপাতালটির জরুরি বিভাগের মোট রোগীর ৫৬ শতাংশই সড়ক দুর্ঘটনার শিকার। হাসপাতালের শয্যাগুলোর ২৫ থেকে ৩০ শতাংশই সড়ক দুর্ঘটনাকবলিত রোগী থাকেন। এছাড়া দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ৬০ শতাংশই কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী। যাদের বয়স ১৬ থেকে ৪৫ বছর। ফলে সড়ক দুর্ঘটনায় শুধু ব্যক্তির জীবনহানিই ঘটে না বরং পারিবারিক অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়। কথায় আছে, একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না। যে ব্যক্তি অকালে চলে যায়, পরিবার, সমাজ ও প্রতিষ্ঠান তার অবদান থেকে বঞ্চিত হয়।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ার পেছনে বেপরোয়া গতি, বিপজ্জনক ওভারটেকিং, রাস্তাঘাটের নির্মাণ ত্রুটি, ফিটনেসবিহীন যানবাহন অবাধে চলাচলের সুযোগ, যাত্রী ও পথচারীদের অসতর্কতা, চালকের অদক্ষতা, যানবাহন চালক ও মালিকের বেপরোয়া মনোভাব, চলন্ত অবস্থায় মোবাইল বা হেডফোন ব্যবহার, মাদকসেবন করে যানবাহন চালানোসহ ১০১টি কারণ উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সংস্থাটির কর্ণধাররা তখন দাবি করেন, কারণগুলো খতিয়ে দেখে সমস্যাগুলো সমাধান করলে সড়ক দুর্ঘটনা কমে আসবে।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক বলেন, মহাসড়কে বাসের গতির চেয়েও মোটরসাইকেলের গতি কমিয়ে আনায় দুর্ঘটনার হার নিশ্চিত আরও বাড়বে। এছাড়া দেশের সব শহরকে একই গতিসীমার মধ্যে আনা হয়েছে। ঢাকা শহরের যানবাহনের গতি আর রাজশাহী শহরের যানবাহনের গতি এক নয়। আমি মনে করি, নতুন এ নীতিমালা কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন হয়নি। এটি একটি আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত। তিনি বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে হলে কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন নীতিমালা করতে হবে। গোড়ায় গলদ রেখে মাথায় পানি ঢাললে রোগ সারবে না। তিনি বলেন, দুর্ঘটনার নেপথ্য কারণগুলো ধরে ধরে সমাধান করতে পারলেই সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব।

বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সাবেক পরিচালক ও পরিবহণ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান বলেন, যে গতিসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা আমাদের দেশের সড়কব্যবস্থার বাস্তবতায় বিজ্ঞানসম্মত নয়। আইনটি যারা করেছেন, তারা হয়তো বাইরের দেশের বাস্তবতা দেখেছেন। তিনি বলেন, বাইরের দেশে লেনভিত্তিক গাড়ি চলে, কোন লেনে কোন গাড়ি চলবে, তাও নির্ধারণ করা থাকে। আমাদের দেশে ঢাকা শহরেই লেনব্যবস্থা চালু নেই। তাছাড়া মহাসড়কে বিভিন্ন শ্রেণির গাড়ির জন্য আলাদা লেন নেই। যে কারণে এ গতিসীমা বেঁধে দেওয়ার কারণে ওভারটেকিং বাড়বে। আর ওভারটেকিং যেখানে বাড়ে, সেখানে মুখোমুখি সংঘর্ষ বাড়ে। এ গতিসীমা বাস্তবায়ন করা হলে সড়কে হযবরল অবস্থার সৃষ্টি হবে। তিনি বলেন, মহাসড়ক ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের গতিসীমা এক করে অর্থনীতির চাকার ওপর হালকা ব্রেক চাপার মতো অবস্থা তৈরি করা হয়েছে। এ গাইডলাইন যেভাবে করা হয়েছে, তা যদি এভাবেই বাস্তবায়ন করা হয়, তবে দুর্ঘটনা বাড়বে বৈ কমবে না।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুনিবুর রহমান বলেন, গাইডলাইন এখনো আমরা অফিশিয়ালি হাতে পাইনি। হাতে পেলে তা পর্যালোচনা করে দেখব কীভাবে কাজ করা যায়। সে অনুযায়ী আমরা উদ্যোগ নেব।

হাইওয়ে পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মো. শাহাবুদ্দিন খান বলেন, আগে সড়ক এবং গাড়ির ধরনের ভিত্তিতে বিস্তারিতভাবে গতিসংক্রান্ত কোনো নির্দেশনা ছিল না। যে কারণে আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে হাইওয়ে পুলিশ ও ট্রাফিক পুলিশের সমস্যা হতো। এখন পুলিশের পক্ষে সহজ হবে আইন প্রয়োগ করা। তিনি বলেন, আমরা আগেও বেপরোয়া গতির যানবাহনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি। এখন গাইডলাইন থাকায় এসব যানবাহনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া আরও সহজ হবে। গাইডলাইন বাস্তবায়ন করা গেলে সড়কে দুর্ঘটনা কমবে বলে তিনি আশাবাদী।

এদিকে বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার বলছেন ভিন্নকথা। তিনি দাবি করেন, গতিসীমা নিয়ন্ত্রণে যে গাইডলাইন দেওয়া হয়েছে, তা শুধু বিজ্ঞানসম্মতই নয়, বাস্তবসম্মতও। এ গাইডলাইন কার্যকর হলে সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস পাবে। তিনি মনে করেন, সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে হলে চালক, যাত্রী, পথচারী-সবাইকে সচেতন হতে হবে, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। তিনি আরও জানান, ৮ এপ্রিল থেকে গাইডলাইনটি কার্যকর করতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

সড়কে ১০ বছরে নিহত ৭৮ সহস্রাধিক : ২০২৩ সালে ৬ হাজার ২৬১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৯০২ জন নিহত এবং ১০ হাজার ৩৭২ জন আহত হয়েছেন। ২০২২ সালে ৬৭৪৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৯৯৫১ জন নিহত ও ১২৩৫৬ জন আহত, ২০২১ সালে ৫ হাজার ৬২৯টি দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৮০৯ জন নিহত ও ৯ হাজার ৩৯ জন আহত, ২০২০ সালে ৪ হাজার ৮৯১টি দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ৬৮৬ জন নিহত ও ৮ হাজার ৬০০ জন আহত, ২০১৯ সালে ৫৫১৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭৮৫৫ জন নিহত ও ১৩৩৩০ জন আহত এবং ২০১৮ সালে ৫ হাজার ৫১৪টি দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ২২১ জন নিহত ও ১৫ হাজার ৪৬৬ জন আহত হয়েছেন। দুর্ঘটনার মধ্যে ২০ শতাংশের বয়স ১৬ বছরের নিচে।

২০১৭ সালে ৪৯৭৯টি দুর্ঘটনায় ৭৩৯৭ জন নিহত ও ১৬১৯৩ জন আহত, ২০১৬ সালে ৪৩১২টি দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ৫৫ জন নিহত ও ১৫৯১৪ জন আহত, ২০১৫ সালে ৬ হাজার ৫৮১টি দুর্ঘটনায় ৮ হাজার ৬৪২ জন নিহত ও ২১ হাজার ৮৫৫ জন আহত এবং ২০১৪ সালে ৫ হাজার ৯২৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৮ হাজার ৫৮৯ জন নিহত ও ১৭ হাজার ৫২৪ জন আহত হন।যুগান্তর

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.net
Website Design By Kidarkar It solutions