ডেস্ক রির্পোট:- উচ্চ হারের ব্যাংক সুদের পর ভয়াবহ ডলার সংকটে দেশের অর্থনীতি। বছরের বেশি সময় ধরে কিছুটা স্থিতিশীল থাকলেও হঠাৎ করে ডলার বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপে ডলারের নতুন দর নির্ধারণের পর কার্ব মার্কেট থেকে ডলার উধাও হয়ে গেছে। কোথাও ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যাংকিং খাতে ডলারের সংকটে বৈদেশিক বাণিজ্য মুখ থুবড়ে পড়ার অবস্থায় পৌঁছেছে। এ পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি সমস্যা তৈরি হয়েছে দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যে। আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খুলতে ব্যবসায়ীদের গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত দর ১১৭ টাকা হলেও ১২৪ থেকে ১২৫ টাকার নিচে কোনো ব্যাংক এলসি খুলতে চাচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডলার বাজারে হঠাৎ এ অস্থির পরিস্থিতি বৈদেশিক বাণিজ্যই নয়, দেশের মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রেও বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে; যা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন করে তুলতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংক এক ধাপে ডলারের বিনিময় হার ৭ টাকা বাড়ানোর ঘোষণা দেয় ৮ মে। ১১০ টাকার স্থলে ১১৭ টাকা আন্তব্যাংক দর নির্ধারণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ ঘোষণার পর দিন থেকেই খোলাবাজার থেকে ডলার এক প্রকার উধাও হয়ে যায়। ৯ মে বৃহস্পতিবার রাজধানীর বেশির ভাগ কার্ব মার্কেট ছিল ডলারশূন্য। বিদেশগামী যাত্রীরা চরম ভোগান্তির শিকার হয়েছেন। তবে অতিরিক্ত দর দিলে কোথাও কোথাও ডলার পাওয়া গেছে। খোলাবাজারের সঙ্গে ব্যাংকগুলোতেও ডলার সংকট সৃষ্টি হয়। বেশির ভাগ ব্যাংক এলসি খুলতে গেলে ডলার সংকটের কথা জানিয়েছে। বৃহস্পতিবার দেশের কোনো ব্যাংকেই এলসি খোলা যায়নি বলে একাধিক ব্যাংকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ ঘোষণার কারণে ভবিষ্যৎ মুনাফার জন্য ব্যবসায়ীদের মুদ্রা মজুতদারির কারণে খোলাবাজারে ডলার খুঁজে পাওয়া কঠিন ছিল। এমনকি মরিয়া ক্রেতারা তাদের বিদেশে যাতায়াত ও চিকিৎসার খরচ মেটাতে খোলাবাজারে ১ ডলারের জন্য ১২৮ টাকা পর্যন্ত পরিশোধ করেছেন বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত হারে ডলার কেনার বিষয়ে সতর্ক করার পর ব্যাংকগুলোয় মার্কিন ডলারের সংকট আরও গভীর হচ্ছে। খোলাবাজারে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত দামের চেয়ে প্রায় ১৫ টাকা বেশিতে, অর্থাৎ প্রতি ডলার ১২৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা খোলাবাজারে ডলারের এ রেকর্ড দাম সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তাঁরা জানিয়েছেন, উচ্চ হারে ডলারের লেনদেনের পেছনে থাকা অবৈধ ডলার ব্যবসায়ীদের সম্পর্কে তথ্য নিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ডলার সংকটের কারণে ব্যবসায়ীরা চাহিদা অনুযায়ী আমদানির এলসিও খুলতে পারছেন না। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের আমদানি কমার হার ছিল ১৫ দশমিক ৮১ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত আমদানি কমার হার প্রায় ৩০ শতাংশে পৌঁছেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রতি মাসে যে পরিমাণ পণ্য আমদানি হতো, বর্তমানে হচ্ছে তার অর্ধেক। চাহিদা অনুযায়ী মূলধনি যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি করতে না পারায় দেশের অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উৎপাদন সক্ষমতার বড় অংশ অলস বসে থাকছে।
এ ব্যাপারে একাধিক ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বললে তাঁরা জানিয়েছেন, ডলার বাজার কিছুটা স্থিতিশীল ছিল গত কয়েক মাস। তবে ব্যাংকগুলো কখনোই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত দরে এলসি খুলতে চায় না। তারা কাগজপত্রে দর যা দেখায় বাস্তবে তার চেয়ে বেশি দিতে হয়। ১১০ টাকার নির্ধারিত দর থাকার সময় কোনো ব্যাংক এ দরে এলসি খুলতে রাজি হয়নি। দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী গ্রুপের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ব্যাংকে অতিরিক্ত টাকা দিলেই কেবল এলসি খুলতে রাজি হয়। খোলাবাজার থেকে ডলার কিনে দিতে হয়। তারা জানান, ঋণপ্রবাহ সংকুচিত হওয়া, সুদহার বৃদ্ধি, ডলার সংকট ও ডলারের বিনিময় হার নিয়ে নৈরাজ্য, প্রত্যাশিত মাত্রায় ঋণপত্র (এলসি) খুলতে না পারা, গ্যাস সংকট, উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাবে বিক্রি কমে যাওয়াসহ বহুমুখী সংকটে বেসরকারি খাত এখন বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছে। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে ব্যবসায়ীরা গণহারে ঋণখেলাপি হবেন। তাতে দেশের ব্যাংক খাতের আর্থিক ভিত আরও বেশি নড়বড়ে হয়ে উঠবে। সংকট তীব্র হয়ে ওঠায় ডলারের বিনিময় হার বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতেও দেশের ব্যাংক খাতে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল সর্বোচ্চ ৮৫ টাকা।
কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদিত দর হিসেবে দিলেও প্রতি ডলার ১২৮ টাকা পর্যন্ত। যদিও ঘোষিত দরে দেশের কোনো ব্যাংকেই ডলার মিলছে না। আমদানিকারকদের কাছ থেকে ব্যাংকগুলো ডলারপ্রতি ১২৪-১২৫ টাকাও আদায় করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সে হিসেবে এ সময়ে ডলারের বিনিময় হার বেড়েছে প্রায় ৪৭ শতাংশ। বিনিময় হার নিয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে দেশের ব্যবসায়ীদের ক্ষতি প্রতিনিয়ত বাড়ছে।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বারস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. মাহবুবুল আলম বলেন, ‘বাজারভিত্তিক সুদহার চালু করায় নতুন করে বিনিয়োগ বাড়বে না। একই সঙ্গে খরচ বাড়বে ব্যবসার। ডলারের দাম বাড়ায় রপ্তানিকারকরা একটু লাভবান হবেন, তবে আমদানির খরচ বাড়বে।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের এ পদক্ষেপের ফলে কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস বা ব্যবসার খরচ বাড়বে। সেটা নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ ব্যবসার খরচ বাড়লে জিনিসপত্রের দাম আরেক দফা বাড়বে। নতুন করে বিনিয়োগ বাড়বে না উল্টো খরচ বাড়বে ব্যবসার। এটা ভালো হবে না। সুদহার বাড়ানো ঠিক হবে না। একেক ব্যাংক একেক ধরনের সুদহার আরোপ করবে। ডলারের দাম যেভাবে ওঠানামা করে সেটা বাংলাদেশ ব্যাংককে নজরদারি করতে হবে।’ জানতে চাইলে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘ডলারের সাময়িক ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকগুলোতে ডলার সরবরাহ বাড়াতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। ডলার ব্যবসায়ীরা বৈদেশিক মুদ্রার দর আরও বাড়ানোর সংকেত পেয়ে গেছেন, সে কারণেই তারা স্টক রাখার পর ডলার ঘাটতির কথা বলছেন। সরবরাহ বাড়লে হার কমবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘খোলাবাজারে বিনিময় হার সব সময়ই ব্যাংকের চেয়ে বেশি থাকে, কখনো কখনো বাজার তদারকির অভাবে তা অস্বাভাবিক পর্যায়ে বেড়ে যায়।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ‘নগদ ডলারের পর্যাপ্ত মজুদ ও সরবরাহ ঠিক আছে। এখানে কে বিক্রি করবে কে করবে না, এটা তার নিজস্ব বিষয়। যারা মানি এক্সচেঞ্জে ডলার পাননি, তারা ব্যাংকে গেলেই ডলার কিনতে পারবেন। ব্যাংকগুলোর কাছে এখন ৫ কোটি নগদ ডলার মজুত আছে।’বাংলাদেশ প্রতিদিন