ডেস্ক রির্পোট:- বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের সংকটের মধ্যেই বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ প্রথমবারের মতো ১০০ বিলিয়ন বা ১০ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। গত ডিসেম্বর শেষে সরকার ও বেসরকারি খাতে বিদেশি বিভিন্ন উৎস থেকে নেয়া ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১০০.৬৪ বিলিয়ন (১০ হাজার ৬৪ কোটি) ডলার, যা এক বছর আগে ছিল ৯৬.৫ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় (প্রতি ডলার ১১০ টাকা ধরে) এ ঋণের পরিমাণ ১১ লাখ ৭ হাজার ৪০ কোটি টাকা। দেশের মোট বিদেশি ঋণের ৭৯ শতাংশই নিয়েছে সরকার। বাকি ২১ শতাংশ ঋণ নিয়েছে বেসরকারি খাত। আর ১৫ বছর আগে ২০০৮ সাল শেষে এর পরিমাণ ছিল মাত্র ২২ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। অর্থাৎ গত ১৫ বছরে দেশের বিদেশি ঋণ বেড়েছে ৭৭.৮৫ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৩৪২ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদেশি ঋণের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সক্ষমতা অনুযায়ী বিদেশি ঋণ নিতে হয়। বর্তমানে যে পরিমাণ বিদেশি ঋণ রয়েছে, তা পরিশোধে সরকার চাপে পড়বে। তাই বিদেশি ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার।
তার মতে, চলতি বছর থেকে অনেক মেগা প্রকল্পের ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হচ্ছে। এতে ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়বে। এমনিতেই দেশে ডলারের তীব্র সংকট চলছে। বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ায় আরও বেশি পরিমাণে ডলারের প্রয়োজন হবে। তবে সেই অনুযায়ী রেমিট্যান্স, রপ্তানি আয়সহ দেশের ডলার সংস্থান বাড়ানো যাচ্ছে না। বিপরীতে দেশের রিজার্ভ ক্রমাগত কমছে। এমন প্রেক্ষাপটে পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার চীন ও রাশিয়া থেকে সাপ্লাইয়ার ক্রেডিট নিচ্ছে। তবে সেটা এখনই বন্ধ করতে হবে মনে করেন তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ডিসেম্বর শেষে বিদেশি ঋণের স্থিতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০০.৬৪ বিলিয়ন ডলার। এরমধ্যে সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ৭৯.৬৯ বিলিয়ন ডলার। এগুলোর ৮৫ শতাংশ ঋণ দীর্ঘমেয়াদি এবং বাকিগুলো স্বল্পমেয়াদি। আর দেশের বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২০.৯৫ বিলিয়ন ডলার। অথচ ২০০৮ সাল শেষে বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ২২.৭৯ বিলিয়ন ডলার। এরমধ্যে সরকারি খাতের ঋণ ছিল ২১.১৯ বিলিয়ন ডলার। আর বেসরকারি খাতের ছিল ১.৬০ বিলিয়ন ডলার।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, বিদেশি ঋণ বাড়ছে মানে দেশের জন্য উদ্বেগজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। বিদেশি ঋণ যদি এভাবে ক্রমাগত বাড়তে থাকে, তাহলে ঋণ পরিশোধের চ্যালেঞ্জ বাড়বে। তাছাড়া সরকারের ঋণ অনেক আগেই বিপজ্জনক মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। কারণ দেশের রাজস্ব ও রিজার্ভ উভয়ই কমে যাচ্ছে। চলতি বছর থেকে বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধের চাপ বাড়তে থাকবে। পরিস্থিতি সামাল দিতে চীন ও রাশিয়া থেকে যে সাপ্লাইয়ার ক্রেডিট নেয়া হচ্ছে, তা এখনই বন্ধ করতে হবে।
সাপ্লাইয়ার ক্রেডিট হলো একটি বাণিজ্যিক চুক্তি, যার অধীনে একজন রপ্তানিকারক ঋণের শর্তে বিদেশি ক্রেতাকে পণ্য বা পরিষেবা দেবে।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, ডলারের জোগান না বাড়লে পরিস্থিতি খারাপের দিকে মোড় নিতে পারে। তাই ভবিষ্যতে যেন বড় অপরিকল্পিত প্রকল্প না নেয়া হয়। প্রকল্প নিলে ভেবেচিন্তে নিতে হবে। আগামীতে কীভাবে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স বাড়ানো যায় সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর শেষে বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ৯ হাজার ৬৫৫ কোটি ডলার। তার মানে পরের তিন মাসে ৪ বিলিয়ন বা ৪০৯ কোটি ডলারের বিদেশি ঋণ বেড়েছে। এই সময়ে সরকার ৪৪২ কোটি ডলারের বিদেশি ঋণ নিয়েছে। তার বিপরীতে বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণের স্থিতি কমেছে ৬৪ কোটি ডলারের।
জনশুমারি ও গৃহগণনা শুমারির চূড়ান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ। সেই হিসাবে গত ডিসেম্বরের শেষে মাথাপিছু বিদেশি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৫৯২ ডলার (প্রায় ৬৫ হাজার টাকা)। যদিও গত জুনের হিসাবে মাথাপিছু বিদেশি ঋণ ছিল ৫৭৪ ডলার। আট বছর আগে এটা ছিল ২৫৭ ডলারের কিছু বেশি।
গত ডিসেম্বর শেষে সরকারি খাতে বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ৭ হাজার ৯৬৯ কোটি ডলার। তার আগের তিন মাসে বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ৭ হাজার ৫২৭ কোটি ডলার। অর্থাৎ গত বছরের শেষ তিন মাসে সরকারি খাতে বিদেশি ঋণের স্থিতি বেড়েছে ৫.৮৭ শতাংশ। অন্যদিকে গত ডিসেম্বর শেষে বেসরকারি খাতের ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ২ হাজার ৯৫ কোটি ডলার, যা গত সেপ্টেম্বরে ছিল ২ হাজার ১২৮ কোটি ডলার।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালে সরকারের বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ২০.৩৩ বিলিয়ন ডলার। এরপর থেকে সরকারের বিদেশি ঋণ দ্রুতগতিতে বেড়েছে। একইসঙ্গে বিদেশি ঋণ বেড়েছে বেসরকারি খাতেরও। বিদেশি ঋণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ২০১৮ সালের পর। ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষে বিদেশি ঋণের স্থিতি ৬৮.৫৫ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকে। ২০২০-২১ অর্থবছরে এ প্রবৃদ্ধি ১৯ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। ওই অর্থবছর শেষে বিদেশি ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ৮১.৬২ বিলিয়ন ডলারে। ২০২১-২২ অর্থবছরে বিদেশি ঋণের প্রবৃদ্ধি হয় ১৬.৯ শতাংশ। অর্থবছর শেষে এ ঋণের স্থিতি ৯৫.৪৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে বিদেশি ঋণের স্থিতি ৯৮.৯৪ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। আর গত বছর শেষে এ ঋণের স্থিতি ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়।
ইআরডি’র ডিসেম্বরের হিসাবে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ঋণদানে শীর্ষ দেশ ও সংস্থার মধ্যে ছিল বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাপান, রাশিয়া, ভারত ও চীন। সাম্প্রতিককালে চীনা ঋণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। এসব ঋণ নেয়া হয় মূলত প্রকল্প বাস্তবায়ন ও বাজেট সহায়তা হিসেবে। বিদেশি অর্থায়নে বেশ কিছু বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার। এরমধ্যে রয়েছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্প, মেট্রোরেল (লাইন-৬), হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল, কর্ণফুলী টানেল, মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০শে মার্চ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী (বিপিএম৬) দেশের রিজার্ভ ছিল ১৯.৯৯ বিলিয়ন ডলার। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবে বাংলাদেশের নিট রিজার্ভ এখন প্রায় ১৭ বিলিয়ন ডলার। দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রিজার্ভ ছিল ২০২১ সালের আগস্টে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব হিসাবায়ন পদ্ধতি অনুযায়ী, ওই সময় রিজার্ভের পরিমাণ ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। এরপর থেকেই রিজার্ভের ক্ষয় শুরু হয়।
অর্থনীতিবিদ গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বিদেশি ঋণ ও ঋণের ব্যয় দুটোই বাড়ছে। সর্বশেষ নেয়া বিদেশি ঋণগুলোও ব্যয়বহুল। তাই আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।