শিরোনাম

কক্সবাজারের চকরিয়ার ১০ ইউনিয়নে তামাকের বিষ

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় শনিবার, ২৩ মার্চ, ২০২৪
  • ৫১ দেখা হয়েছে

উঠান, স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘেঁষে তামাক চুল্লি ।। জ্বালানির কাঠ আসে বন থেকে ।। শিশুরা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ।। নজরদারি নেই কেন?
ডেস্ক রির্পোট:- লোকালয় এড়িয়ে দূরে, খোলা জায়গায় চুল্লি স্থাপন করে উৎপাদিত তামাক পাতা শোধন করার কথা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। মানুষের বাড়ির উঠানে উঠানে স্থাপন করা হয়েছে স্থায়ী তামাক চুল্লি। শুধু উঠান নয়, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘেঁষেও স্থাপন করা চুল্লিতে চলছে তামাক শোধন প্রক্রিয়া। এতে তামাক পোড়ানোর সময় নিকোটিনের উৎকট গন্ধে এলাকার পরিবেশ বিষিয়ে উঠেছে। ভালো করে শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে এখানকার মানুষের। বিভীষিকাময় এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে অনেকে নিজ গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন।

এই অবস্থা চলছে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার অন্তত ১০টি ইউনিয়নে। সরেজমিনে তামাকপ্রবণ ইউনিয়নগুলো ঘুরে এই চিত্র দেখা গেছে। দেখা গেছে, বাড়ির উঠানে প্রতিটি তামাক চুল্লির পাশে এবং বসতবাড়ির উঠানে, পেছনে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের জন্য স্তূপ করে রাখা হয়েছে হাজার হাজার মণ গাছের গুঁড়ি। এসব গাছের গুঁড়ি সংগ্রহ করা হয়েছে সংরক্ষিত, রক্ষিত বনাঞ্চলসহ ব্যক্তি মালিকানাধীন বাগান থেকে।

১৫ বছরের বেশি সময় ধরে তামাক চাষের সঙ্গে সম্পৃক্ত মানিকপুর গ্রামের আহমদ কবির, সুরাজপুরের ভিলেজার পাড়ার রমিজ উদ্দিন, কাকারার প্রপার কাকারার নুরুল আলমসহ তামাক চাষিরা জানিয়েছেন, তামাক পাতা ক্ষেত থেকে তোলার পর তা শোধনের জন্য আঁটি বেঁধে সারিবদ্ধভাবে চুল্লিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। এরপর সেই তামাক শোধনের জন্য চুল্লিতে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করতে হয় বড় বড় সাইজের লাকড়ি। এসব লাকড়ির যোগান দেন অবৈধ কাঠ ব্যবসায়ীরা।

ওইসব চাষি জানান, বর্তমানে জ্বালানি হিসেবে লাকড়ির আকাল চলছে। তবে দাম একটু বাড়িয়ে দিলে সহজেই মিলে। এই বছর প্রতি মণ লাকড়ি ২০০ থেকে ২২০ টাকার মধ্যে কিনতে হচ্ছে। অবশ্য কাঠ ব্যবসায়ীরা জ্বালানির লাকড়ি গাড়িতে করে সরাসরি তামাক চুল্লিতে পাঠিয়ে দেন।

সরেজমিনে দেখা গেছে, বাড়ির উঠানে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এমনকি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পাশে স্থাপিত চুল্লিতে বর্তমানে চলছে তামাক শোধনের প্রক্রিয়া। এতে ওইসব ইউনিয়নের মানুষ তামাক পোড়ানোর নিকোটিনের গন্ধে দুর্বিষহ জীবন–যাপন করছেন। তামাকের উৎকট গন্ধ বাতাসের সঙ্গে আশেপাশের কয়েক কিলোমিটার এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। তামাক শোধনের প্রক্রিয়ায় নারী–পুরুষের পাশাপাশি শিশুরাও শ্রম দিচ্ছে। এই অবস্থায় এসব ইউনিয়নের মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে গেছে। শ্বাসকষ্ট, হাঁফানি, চর্ম রোগসহ নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে এখানকার মানুষের।

বর্তমানে তামাকের শোধন চলা ইউনিয়নগুলো হলো চকরিয়ার কাকারা, সুরাজপুর–মানিকপুর, বমুবিলছড়ি, চিরিঙ্গা, ফাঁসিয়াখালী, লক্ষ্যারচর, কৈয়ারবিল, বরইতলী, হারবাং, পৌরসভার একাংশসহ ১০টি ইউনিয়ন। মাতামুহুরী নদীর দুই তীরের খাস জমিসহ এসব ইউনিয়নের অন্তত ৮ হাজার একর জমিতে এবারও তামাকের আবাদ করা হয়। বর্তমানে মাঠ থেকে ৫০ শতাংশ পরিপক্ব তামাক পাতা তোলা হয়েছে। এসব তামাক পাতা শোধনের জন্য চুল্লিগুলোতে চলছে কর্মযজ্ঞ।

কাকারা ইউনিয়নের প্রপার কাকারার পরিবেশ সচেতন ছোটন হোসাইনসহ বেশ কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, তামাক কোম্পানিগুলো বরাবরই প্রশাসনকে আশ্বাস দেয়, লোকালয় থেকে দূরে খোলা আকাশের নিচে তামাক শোধনের জন্য চুল্লি স্থাপন করা হবে। কিন্তু তা মানা হয় না। এমনকি তামাক চাষপ্রবণ এলাকায় এসব নজরদারি করার জন্য পরিবেশ রক্ষায় নিয়োজিত সরকারি বা বেসরকারি কোনো সংস্থা বা দপ্তরের তৎপরতা দেখা যায় না। তাই প্রতি বছর এই দুর্বিষহ যন্ত্রণা ভোগ করতে হচ্ছে মানুষকে।

পরিবেশ সচেতন ব্যক্তিরা বলেন, তামাক শোধনের জন্য যখন চুল্লিগুলোতে আগুন দেওয়া হয়, তখন আর কেউ বাড়িতে থাকতে পারেন না। দিনের বেলায় অন্যত্র আশ্রয় নিলেও রাতের বেলায় ঘুম হারাম হয়ে যায়। প্রচণ্ড ধোঁয়া আর তামাকের নিকোটিনের গন্ধে দম বন্ধ হওয়ার মতো পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছে তারা। যারা নিকোটিন সহ্য করতে পারেন না তাদের অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। রমজানের মধ্যে দুর্বিষহ এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কাছে লিখিতভাবে অভিযোগ দেওয়া হলেও কোনো কাজ হয়নি। এমনকি প্রশাসনের কেউ এই দুর্বিষহ অবস্থা দেখতে আসেননি। এই অবস্থায় তামাক চাষ করেন না, গ্রামের এমন অনেকে অন্যত্র বাসা ভাড়া নিয়ে থাকছেন।

তামাক চাষপ্রবণ ইউনিয়নগুলোর পরিবেশ সচেতন একাধিক ব্যক্তি ও জনপ্রতিনিধি বলেন, প্রতি বছর তামাক কোম্পানিগুলো নানা প্রলোভনে সাধারণ মানুষকে তামাক চাষে প্রলুব্ধ করে আসছে। এই কারণে দুই যুগের বেশি সময় ধরে নীল চাষের মতোই এখানে তামাকের আগ্রাসন চলছে। আর কোনো ধরনের নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়াই মানুষ কাজ করছে তামাক চাষ থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াকরণ পর্যন্ত। কোনো কাগজপত্র ছাড়াই আবাসিক এলাকায় চলছে তামাক প্রক্রিয়াজাতকরণ। তামাক প্রক্রিয়াজাতকরণের ফলে অসুস্থ হচ্ছে মানুষজন। দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে সাধারণ মানুষ।

কাকারা ইউনিয়নের দরগা রাস্তার বাসিন্দা আলী আহমদের বাড়িতে দেখা যায়, উঠানে, পেছনে ও সড়কের ধারে স্থাপন করা হয়েছে তামাক শোধনের একাধিক চুল্লি। এসব চুল্লির মধ্যে একটি একেবারে পাকা চুল্লি। সেই চুল্লিতে বড় সাইজের গাছের গুঁড়ি ঢুকিয়ে আগুন দেওয়া হয়েছে। আর প্রতি চুল্লির আগুনের সামনে বসে কিছুক্ষণ পরপর লাকড়ি দিচ্ছেন। অপরদিকে পাশে একাধিক নারী–পুরুষ মিলে তামাক পাতার আঁটি বেঁধে সারিবদ্ধভাবে রাখছেন। সেখানে একাধিক শিশুকেও কাজ করতে দেখা গেছে।

তামাক চাষিরা জানান, সারা বছরের শ্রম তখনই স্বার্থক হয় যখন তামাক কোম্পানিগুলো ঠিকমতো পাতার গ্রেডিং নির্ধারণ করে। যদি গ্রেডিং প্রতারণা করা হয় তাহলে মাথায় হাত উঠবে চাষিদের। এক্ষেত্রে তামাক কোম্পানিগুলোর দয়ার ওপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় নেই।

অভিজ্ঞ চাষিরা জানান, এক হেক্টর জমিতে উৎপাদিত তামাক পাতা শোধনের জন্য একটি চুল্লির প্রয়োজন হয়। আর একটি চুল্লি তৈরিতে প্রয়োজন পড়ে ২০টির মতো বড় খুঁটি। সেই খুঁটিও সংগ্রহ করা হয় সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে। এছাড়া এক হেক্টর জমিতে উৎপাদিত তামাক পাতা শোধনে গড়ে ৫০০ মণ জ্বালানি কাঠের প্রয়োজন পড়ে। সেই জ্বালানিও সংগ্রহ করা হয় বনাঞ্চল থেকে। গাছ ও কাঠ সংগ্রহ হয় সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও সামাজিক বনায়ন থেকে।

কঙবাজার উত্তর বন বিভাগের ফাঁসিয়াখালী রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. মেহরাজ উদ্দিন বলেন, ফাঁসিয়াখালী রেঞ্জের অধীনস্থ পাঁচটি বিটের সংরক্ষিত বনাঞ্চল এবং সামাজিক বনায়ন উজাড় করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ বনবিভাগ বর্তমানে কঠোর অবস্থানে থেকে নজরদারি বাড়িয়েছে। এতে সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে তামাক চুল্লিতে লাকড়ি সরবরাহ দেওয়ার কোনো তথ্য নেই।

চাষিরা জ্বালানি হিসেবে গাছের গুঁড়ি কোত্থেকে পাচ্ছে? এমন প্রশ্নে রেঞ্জ কর্মকর্তা বলেন, বিভিন্ন ব্যক্তি মালিকানাধীন বাগান থেকেই হয়ত চুল্লিগুলোতে এসব জ্বালানির যোগান দেওয়া হচ্ছে।

পরিবেশ অধিদপ্তর কঙবাজার কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, কঙবাজার জেলায় তামাক চাষের পরিধি দিন দিন বেড়েছে। তবে লোকালয়ে তামাক শোধনে চুল্লি স্থাপনের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া যায় ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

চকরিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এস এম নাসিম হোসেন বলেন, তামাক চাষ নিরুৎসাহিত করতে চাষি পর্যায়ে প্রতি বছর কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়। কিন্তু কোম্পানিগুলো চাষিদের অধিক লাভের প্রলোভনে ফেলায় তামাক চাষ বন্ধ করা যাচ্ছে না।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. শোভন দত্ত বলেন, তামাক চাষের কারণে অধ্যুষিত এলাকায় মানুষের শ্বাসকষ্ট, হাঁপানিসহ শিশুদের শ্বাস–প্রশ্বাসের নানা রোগ দেখা দিতে পারে। এই ধরনের রোগী হাসপাতালে ভিড় করছেন প্রতিনিয়ত।

এ ব্যাপারে চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ফখরুল ইসলাম বলেন, তামাক চাষের ক্ষতিকর দিক নিয়ে আগামীতে চাষিদের সচেতন করা হবে। পাশাপাশি লোকালয় এড়িয়ে তামাক চুল্লি স্থাপনের ওপর জোর দেওয়া হবে। তবে সরকারিভাবে যদি তামাক চাষ নিষিদ্ধ করা হয় তাহলে স্থায়ীভাবে এই সমস্যা দূরীভূত হবে।আজাদী

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.net
Website Design By Kidarkar It solutions