ডেস্ক রির্পোট:- বৈশ্বিক শক্তি হওয়ার রাজনৈতিক অভিলাষ, অর্থনৈতিক স্বার্থ ও বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবকে সীমিত রাখতে ভারত বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে চায় বলে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের ভূমিকা আছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে সেই ভূমিকা কাজ করে। ২০১৩ সাল থেকে এটা স্পষ্ট। ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে এতটাই উৎসাহী যে, এই লক্ষ্যে ক্রমাগতভাবে যেকোনো ধরনের রাগ-ঢাক ছাড়াই কথাবার্তা বলা হচ্ছে।
গতকাল ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজের ‘বাংলাদেশ ও তার প্রতিবেশী: বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের প্রভাব’ শীর্ষক এক ওয়েবিনারের মূল বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। ওয়েবিনারে সাংবাদিক মনির হায়দারের সঞ্চালনায় আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন ও টেক্সাসের ইউনিভার্সিটি অফ ডালাসের শিক্ষক ও কলামিস্ট শাফকাত রাব্বী। এ ছাড়া সমাপনী বক্তব্য রাখেন টেকসই উন্নয়ন বিষয়ক লেখক ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব।
প্রফেসর আলী রীয়াজ বলেন, ভারত বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে চায় কেন? আমি মনে করি এর কারণ তিনটা। প্রথমত, বৈশ্বিক শক্তি হওয়ার রাজনৈতিক অভিলাষ এবং ভূ-কৌশলগত নিরাপত্তা। দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক স্বার্থ। তৃতীয়ত, বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবকে সীমিত রাখা।
এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেন, ভারত গোটা দক্ষিণ এশিয়াকে তার উঠান বলে বিবেচনা করে। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার সময় থেকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, ভারত ভৌগোলিকভাবে তার সীমানা বৃদ্ধি করতে চেয়েছে। তাদের নীতি নির্ধারকদের বিবেচনায় ভারত এমন একটা এলাকায় আছে যেখানে তার চারপাশের দেশগুলো তার প্রতি শত্রু ভাবাপন্ন। এটা তাদের ধারণা। এই বিবেচনা থেকেই ভারত তার প্রতিবেশীদের ওপর এক ধরনের নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণ করতে অভ্যস্ত। এক্ষেত্রে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে প্রতিবেশী দেশগুলোর ক্ষমতাশীলরা তাদের অভ্যন্তরীণ এবং পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে ভারতের পরামর্শ গ্রহণ করবে। ব্যতিক্রম হলেই ভারত তার স্বার্থের অনুকূলে যেকোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে বা করবে। ভারতের এই দৃষ্টিভঙ্গি যদিও দীর্ঘদিনের। কিন্তু ভারতের এই দৃষ্টিভঙ্গি আরও বেশি দৃঢ় এবং সুস্পষ্ট রূপ লাভ করেছে ২০০১ সালের পর থেকে।
তিনি বলেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, বিশ্ব রাজনীতির পরিবর্তন, চীনের উত্থান ও প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা এবং দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে চীনকে মোকাবিলা করার জন্য ভারতের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভর করা ভারতের দীর্ঘদিনের সুপ্ত আকাক্সক্ষাকে জাগিয়ে তোলে। নিজেকে সে বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে উপস্থিত করতে চায়। বৈশ্বিক শক্তির জন্য তার দরকার নিজস্ব এলাকায় একচ্ছত্র আধিপত্য।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে গত এক দশক ধরে সামগ্রিকভাবে গণতন্ত্রের যে পশ্চাদ অপরসারণ হয়েছে সে সময় ভারত কখনোই কোনো কথা বলেনি। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সময়ে সময়ে এ নিয়ে আপত্তি তোলা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হলে অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের লাভবান হওয়ার সম্ভাবন অনেক বেশি। এতে ভারতের বাণিজ্যিক স্বার্থ ক্ষুণ্ন হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। বর্তমানে দেশের ভেতরে কী ঘটছে, সেটা কেবল দেশের ভেতরের ঘটনা দিয়ে বিচার করা যাবে না উল্লেখ করে আলী রীয়াজ বলেন, অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়েছে দেশের পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তার প্রশ্নগুলো। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা আরও বেশি বিবেচ্য ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে। এই অঞ্চলে যে ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা চলছে তার একটি মঞ্চ বা থিয়েটারে পরিণত করেছে বাংলাদেশকে।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, আমাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য ভারতের ভারতের ওপর নির্ভর করি। ভারত তো চেষ্টা করবে তাদের সর্বোচ্চ সুবিধা নিতে। এটাতে তাদের দোষ দেখি না। সার্বিকভাবে চীনকে কন্টেন করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ভারত এক কিন্তু আবার ভারত চাইবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অবশ্যই তাকে সহায়তা করবে কিন্তু সহায়তাকারী মূল খেলোয়াড় হবে না। মূল খেলোয়াড় হবে ভারত। এটা হলো ভারতের জয়। তারা এটা কতোটুকু সফল হবে সেটা হলো দেখার বিষয়। সেই সূত্রে তারা চাচ্ছে না আঞ্চলিক কোনো রাষ্ট্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাইজোটাল ভূমিকা নিক।
টেক্সাসের ইউনিভার্সিটি অফ ডালাসের শিক্ষক ও কলামিস্ট শাফকাত রাব্বী বলেন, ভারতের একটা চারিত্রিক ব্যাপার আছে তারা কীভাবে মানুষের সঙ্গে ডিল করে। আর আমাদের একটা চারিত্রিক ব্যাপার আছে কেউ আমাদের ওভাবে ডিল করলে আমরা কীভাবে রিয়্যাক্ট করবো। এই দু’টোই এই মুহূর্তে বাংলাদেশের অনুকূলে না। আমাদের দেশের মানুষ ভারতে গিয়ে ক্রেডিট কার্ড দিয়ে খরচ করে আসছে, সিনেমা দেখছে, গান শুনছে। সবকিছুই ভারতের মতো করছে। পুরোপুরি ভারতে নকল করে আবার রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ভিন্ন কিছু চাইলে বা অধিপত্য থেকে বের হতে চাইলে তো তা সম্ভব না। তিনি বলেন, তাই ভারত আর বাংলাদেশের এই পরিস্থিতিতে এককভাবে ভারতের দোষ দিয়ে লাভ নেই। আমাদেরও জাতিগত চারিত্রিক কিছু সমস্যা রয়েছে। এজন্য আমরা এই আধিপত্যবাদের মধ্যে এসে পড়েছি। এর থেকে উত্তরণের পথ আসবে সেদিন যখন আমরা ভারতের মাইন্ডসেটও বুঝতে পারবো এবং আমাদের মাইন্ডসেটের যে ল্যাকিংস আছে সেটাকেও কালেক্টিভলি বুঝে ঠিক করতে পারবো।
ওয়েবিনারে সমাপনী বক্তব্যে টেকসই উন্নয়ন বিষয়ক লেখক ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, বাংলাদেশ ভারতের সম্পর্ককে উইন-উইন ভিত্তিক বা ন্যায্যতার ভিত্তিতে এগিয়ে নিতে ভারতকে প্রতিবন্ধকতা উঠিয়ে নেয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। অর্থাৎ বাংলাদেশে একদলীয় শাসকের উত্থানের পথে নয় বরং গণতন্ত্র বিকাশের মধ্যে স্থিতিশীলতা খোঁজার চেষ্টা যদি ভারতে মধ্যে থাকে তাহলে দুই দেশের সম্পর্ক রাজনৈতিক দলের মধ্যে না হয়ে মানুষের মধ্যে হবে।