মোহাম্মদ আবুল হোসেন:- পিটিআইয়ের চেয়ারম্যান গওহর আলি খান দাবি করেন, তারা ১৭০ আসনে জয়ী হবেন। কিন্তু নির্বাচনের ফল ঘোষণায় বিলম্ব ঘটিয়ে কারচুপি করা হয়েছে। তার মাধ্যমে তাদেরকে কম আসন দেয়া হয়েছে। এ অভিযোগ নিয়ে তারা আদালতে গিয়েছেন রোববার। কারচুপির অভিযোগে এদিন সারা দেশে তারা প্রতিবাদ বিক্ষোভ পালন করেছেন। অন্যদিকে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, পাকিস্তানে জোট সরকার হচ্ছে। যে বা যিনিই সরকার গঠন করুন, একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ার কারণে অন্যদের নিয়ে অবশ্যই জোট করে সরকার গঠন করতে হবে। ইমরান খানের পিটিআই যেহেতু সবচেয়ে বেশি আসন পেয়েছে, তাই তারাও সরকার গঠনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে অনেক আগে থেকেই ধরে নেয়া হয়েছিল নতুন প্রধানমন্ত্রী হবেন নওয়াজ শরীফ। কিন্তু তার দল দ্বিতীয় অবস্থানে থাকলেও তিনি অন্যদের, বিশেষ করে পিপিপিকে সঙ্গে নিয়ে জোট সরকার গঠনের জন্য জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
বলা হচ্ছে, তার ওপর সেনাবাহিনীর আশীর্বাদ আছে। যদি তাই হয় তাহলে তাকে ঠেকানো খুবই কঠিন। তবে নীতির প্রশ্নে বলতেই হয়, ইমরান খান বা তার দল যদি সরকার গঠন করতে না-ও পারে, তবু তারাই এবারের নির্বাচনে নৈতিক বিজয়ী দল। মানুষ প্রমাণ করে দিয়েছে তারা এখনো ইমরান খানের ওপর আস্থা রাখে। ইমরান খানের মধ্যে যে জাদুকরী শক্তি, বুদ্ধিমত্তা আছে, তার মূল্য তারা দিয়েছেন। ফলে ইমরান খান তাদের কাছে কিংবদন্তি হয়েই থেকে যাচ্ছেন
ইমরান খান। একজন জীবন্ত কিংবদন্তি। একজন জাদুকর যেন। তিনি পাকিস্তানকে দিয়েছেন বিশ্বকাপ ক্রিকেট চ্যাম্পিয়নের স্বাদ। রাজনীতিতে হাত দিয়ে হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। পাকিস্তানবাসীর কাছে তিনি এক বিস্ময়ের নাম। সেই ১৯৯২ সালে তার চমক দেখানো শুরু। বিশ্বকাপ ক্রিকেটে ইংল্যান্ডকে বধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। দলীয় ২৪৯ রানের মধ্যে তিনিই ১১০ বলে সর্বোচ্চ ৭২ রান করেন। তার বোলিংয়ে সাজঘরে ফেরেন ইংল্যান্ডের লড়াকু ব্যাটসম্যান রিচার্ড ইলিংওয়ার্থ। ইমরানের বলে ক্যাচ উঠলে তা তালুবন্দি করেন রমিজ রাজা। সেই ম্যাচটি ছিল টান টান উত্তেজনার। সেখানে ঠাণ্ডা মাথায় দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন ইমরান। ফল হিসেবে বিশ্বকাপ ট্রফিটা প্রথমবার পাকিস্তানের ঘরে গেছে। সেই থেকে ইমরান খান পাকিস্তানের ক্রিকেটের এক কিংবদন্তি। তার সঙ্গে জোরালো সহায়তায় যারা ছিলেন তার মধ্যে অন্যতম ওয়াসিম আকরাম, রমিজ রাজা, আমির সোহেল, জাভেদ মিয়াদাঁদ, ইনজামামুল হক, সেলিম মালিকের নাম না বললে তাদের প্রতি অবিচার করা হয়। ইমরান খান সেই যে বিশ্বকাপ ট্রফি তুলেছেন ঘরে তখন থেকেই তিনি বিশ্বজোড়া খ্যাতিমান। এর অনেকটা পরে তিনি রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছেন। নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ২০১৮ সালে নাটকীয়তায় প্রধানমন্ত্রী হন। তার দল পাকিস্তান তেহরিকে ইনসাফ ক্ষমতাসীন হয়।
তার সময়কালে পাকিস্তান তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল ছিল। সহিংসতার পরিমাণ ছিল কম। অর্থনীতিও মোটামুটি স্বাভাবিক ছিল। তিনি উগ্রপন্থিদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা করেছেন। ফলে সহিংস হামলা হয়েছে কম। কিন্তু তার বিরুদ্ধে বড় এক অভিযোগ আছে। তা হলো ২০১৮ সালে তিনি ক্ষমতায় গিয়েছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সমর্থনে। তারাই তাকে ক্ষমতায় যেতে সাহায্য করেছিল। এ কথা আমাদের নয়। এমন কথা পাকিস্তানি মিডিয়াগুলোর, বিশেষ করে ডনে এ নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। ফলে সেনাবাহিনীর সঙ্গে ইমরান খানের সম্পর্ক ছিল মধুর। এ জন্য তিনি শাসনকাজ চালাতে পেরেছেন নির্বিঘ্নে। কিন্তু সামরিক গোয়েন্দা প্রধান পদে নিয়োগ নিয়ে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল জাভেদ কমর বাজওয়ার সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। সেনাপ্রধান গোয়েন্দা প্রধান পদে যাকে মনোনয়ন করেছিলেন, তাকে অনুমোদন দিতে অস্বীকার করেন ইমরান খান। সেখান থেকে শুরু। তারপর পানি অনেকদূর গড়িয়েছে। সেনাপ্রধানের সঙ্গে ইমরানের সম্পর্ক দা-কুমড়ো হয়ে ওঠে। তিনি আস্থাভোটে ক্ষমতা হারান। কিন্তু ক্ষমতা থেকে যাওয়ার আগেই তিনি তখনকার সেনাপ্রধান জাভেদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনেন। অভিযুক্ত করেন যুক্তরাষ্ট্রকে। তবে এসব অভিযোগ সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো প্রত্যাখ্যান করে। ইমরান খানের বিদায়ের পর ক্ষমতায় আসে বিরোধী দলগুলোর জোট পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (পিডিএম)। তারা ইমরান খানের রেখে যাওয়া পার্লামেন্টের বাকি মেয়াদ দায়িত্ব পালন করে।
একের পর এক মামলা হতে থাকে ইমরানের বিরুদ্ধে। গত বছর ৯ই মে তাকে গ্রেপ্তার করা হয় ইসলামাবাদ হাইকোর্টের প্রাঙ্গণ থেকে। এর প্রতিবাদে ক্যান্টনমেন্ট সহ স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভয়াবহ হামলা চালায় তার সমর্থকরা। আগুন ধরিয়ে দেয়। ভয়াবহ এক অবস্থার সৃষ্টি হয় পাকিস্তানে। এসব ঘটনায় অভিযুক্তদের সামরিক আদালতে বিচার করার কথা বলা হয়। মামলা হয় ইমরান খানের বিরুদ্ধেও। তাকে এই মামলা, তোষাখানা মামলা এবং স্ত্রী বুশরা বিবির সঙ্গে বিয়ের মামলায় জেল দেয়া হয়। এরই মধ্যে আসে পাকিস্তানে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন। সেই নির্বাচনে ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিকে ইনসাফকে (পিটিআই) নিষিদ্ধ করা হয়। বাতিল করা হয় তাদের দলীয় নির্বাচনী প্রতীক ক্রিকেট ব্যাট। এসবই যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে করা হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়। বিষয়টি বুঝতে হলে কোনো রাজনৈতিক বোদ্ধা বা রাজনীতিক হওয়ার প্রয়োজন নেই। ইমরান খানকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করে দিতে ছক সাজানো হয়।
অন্যদিকে সরকারি পদে যাবজ্জীবনের জন্য অযোগ্য পাকিস্তান মুসলিম লীগ নওয়াজের (পিএমএলএন) প্রধান নওয়াজ শরীফকে লন্ডন থেকে দেশে ফেরার সবুজ সংকেত দেয়া হয়। তিনি দেশে ফেরার পর পরই গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানোর কথা থাকলেও তিনি বিমানবন্দরে নেমে আদালতে গিয়ে জামিন পেয়ে যান। একের পর এক মামলা থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়া হতে থাকে। অন্যদিকে ইমরান খানকে একের পর এক মামলায় দেয়া হতে থাকে জেল। এসবই সাজানো খেলা। বিষয়টি প্রকাশ্যে চলে আসে যে, নওয়াজ শরীফকে সমর্থন দিচ্ছে সেনাবাহিনী। এসব কথা তারা প্রত্যাখ্যান করলেও সত্য দিনের আলোর মতো সত্য। ইমরান খানকে মাইনাস করে দেয়ার চেষ্টা হিতে বিপরীত হয়েছে। উল্টো তিনিই যে পাকিস্তানে এ মুহূর্তে সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা তা প্রমাণিত হয়েছে। তার দল পিটিআই দলীয় পরিচয়ে নির্বাচন করতে পারেনি। পারেনি নিজেদের মার্কা নিয়ে নির্বাচন করতে। পক্ষান্তরে উপায়হীন হয়ে তার দলের প্রার্থীরা স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করেছেন। তাতে তাদের এক একজনের ছিল এক এক মার্কা।
এ জন্য কোন জন ইমরান খানের প্রার্থী তা সাধারণ ভোটারের বোঝার কথা ছিল না। কিন্তু তারা যখন সবচেয়ে বেশি আসনে বিজয়ী হয়েছেন তখন এটা বুঝতে বাকি থাকে না যে, ইমরান খানের প্রার্থীকে ভোটাররা বেছে বেছে বের করেছেন। তারা ইমরান খানের প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে সংশ্লিষ্ট স্বতন্ত্র প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন। হয়তো এমনটা আশা করেনি পাকিস্তানের এস্টাবলিশমেন্ট বা নির্বাচন কমিশনও। এর ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। ইমরানের প্রার্থীরা সবচেয়ে বেশি আসনে বিজয়ী হয়েছেন। এ কারণে নির্বাচন ৮ই ফেব্রুয়ারি ঘোষণা হলেও তার ফল প্রকাশ করতে বেদনা বোধ হয়েছে কর্তৃপক্ষের। তারা এক্ষেত্রে অস্বাভাবিক বিলম্ব করেছে এবং করছে। যখন এই লেখা লিখছি তখনো পূর্ণাঙ্গ সরকারি ফল ঘোষণা করা হয়নি। ফলে বিভিন্ন মিডিয়ায় এক এক রকম ফল ঘোষণা করা হয়েছে। সে মতে ইমরান খান সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা পেয়েছেন প্রায় ১০০ আসন। নওয়াজ শরীফের পিএমএলএন পেয়েছে ৭৪ আসন। আসিফ আলি জারদারির পিপিপি পেয়েছে ৫৪ আসন। অন্যরা পেয়েছেন ছিটেফোঁটা আসন। তবে বিস্ময়ের বিষয় হলো জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান একটিও আসন পায়নি। শুক্রবার ফল ঘোষণা শুরুর পর পর প্রক্ষেপণে বলা হয়, ইমরান খানের দল ১৩০ আসনে জয়ী হতে পারে। এর সূত্র ধরে পিটিআইয়ের চেয়ারম্যান গওহর আলি খান দাবি করেন, তারা ১৭০ আসনে জয়ী হবেন। কিন্তু নির্বাচনের ফল ঘোষণায় বিলম্ব ঘটিয়ে কারচুপি করা হয়েছে। তার মাধ্যমে তাদেরকে কম আসন দেয়া হয়েছে। এ অভিযোগ নিয়ে তারা আদালতে গিয়েছেন রোববার। কারচুপির অভিযোগে এদিন সারা দেশে তারা প্রতিবাদ বিক্ষোভ পালন করেছেন। অন্যদিকে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, পাকিস্তানে জোট সরকার হচ্ছে। যে বা যিনিই সরকার গঠন করুন, একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ার কারণে অন্যদের নিয়ে অবশ্যই জোট করে সরকার গঠন করতে হবে।
ইমরান খানের পিটিআই যেহেতু সবচেয়ে বেশি আসন পেয়েছে, তাই তারাও সরকার গঠনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে অনেক আগে থেকেই ধরে নেয়া হয়েছিল নতুন প্রধানমন্ত্রী হবেন নওয়াজ শরীফ। কিন্তু তার দল দ্বিতীয় অবস্থানে থাকলেও তিনি অন্যদের, বিশেষ করে পিপিপিকে সঙ্গে নিয়ে জোট সরকার গঠনের জন্য জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। বলা হচ্ছে, তার ওপর সেনাবাহিনীর আশীর্বাদ আছে। যদি তাই হয় তাহলে তাকে ঠেকানো খুবই কঠিন। তবে নীতির প্রশ্নে বলতেই হয়, ইমরান খান বা তার দল যদি সরকার গঠন করতে না-ও পারে, তবু তারাই এবারের নির্বাচনে নৈতিক বিজয়ী দল। মানুষ প্রমাণ করে দিয়েছে তারা এখনো ইমরান খানের ওপর আস্থা রাখে। ইমরান খানের মধ্যে যে জাদুকরী শক্তি, বুদ্ধিমত্তা আছে, তার মূল্য তারা দিয়েছেন। ফলে ইমরান খান তাদের কাছে কিংবদন্তি হয়েই থেকে যাচ্ছেন।