বান্দরবানজুড়ে আতঙ্ক, যৌথ বাহিনীর টহল।
ব্যাংকে হামলা, অস্ত্র লুট ও অপহরণের ঘটনায় ছয় মামলা পুলিশের।
থানায় হামলার সময় প্রাণভয়ে জঙ্গলে আশ্রয় নেয় ৫০০ পরিবার।
থানচি, রুমার পর এবার রোয়াংছড়িতে গুলির শব্দ পাওয়া গেছে।
বান্দরবান:-‘চারদিকে গোলাগুলির শব্দ। ভয়ে ছোট বাচ্চাকে নিয়ে প্রথমে খাটের নিচে ঢুকে পড়ি। বেশ কিছুক্ষণ চলে গোলাগুলি। বাইরে হইচই-আওয়াজ। সবাই পাশের জঙ্গলে চলে যাচ্ছে। এর মধ্যেই বাচ্চাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। গোলাগুলি থেকে বাঁচতে গ্রামের অন্য মানুষের সঙ্গে জঙ্গলে আশ্রয় নিই।’
কথাগুলো বান্দরবানের থানচি উপজেলার ফজলপাড়া বাজারসংলগ্ন বাড়ির বাসিন্দা নুরবানু বেগমের। এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল গত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে। সে সময় থানচি থানা লক্ষ্য করে সন্ত্রাসীরা গুলি ছোড়ে। জবাবে পাল্টা গুলি ছোড়ে পুলিশ। প্রাণভয়ে থানার পাশের ফজলপাড়া, হেডম্যানপাড়া ও বাঙালিপাড়ার প্রায় ৫০০ পরিবার জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। গুলির শব্দ থামার পর রাত ১০টার দিকে বাড়ি ফেরে তারা। মাঝরাতে আলীকদমে চেকপোস্টে হামলার খবর আসে। এমনিতেই রুমা ও থানচিতে তিন ব্যাংকে সন্ত্রাসী হামলায় আতঙ্ক ছড়িয়েছিল।
তার মধ্যে থানা ও চেকপোস্টে হামলা আতঙ্ক আরও বাড়িয়েছে। গতকাল শুক্রবার থানচি থেকে অনেকেই নিরাপদ আশ্রয়ে সরে গেছেন।
গতকাল থানচির বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বেশির ভাগ দোকানপাট বন্ধ। বেলা ১১টার দিকে উপজেলা সদরের ব্রিজের মাথায় গিয়ে দেখা যায়, চাঁদের গাড়িতে এলাকা ছাড়ছে অনেকে। তবে অন্যান্য দিনের তুলনায় যানবাহন চলাচল ছিল কম। বাঙালিপাড়ার মো. মাসুম উর ইসলাম বলেন, ‘নিরাপদ জায়গায় যাচ্ছি। আপাতত বান্দরবান সদরে এক আত্মীয়ের বাসায় যাচ্ছি।’
থানচি সদর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান অং প্রু ম্রো বলেন, পুরো রাত আতঙ্কে কেটেছে। ভয়ে অনেকে বান্দরবান সদরের বিভিন্ন পরিচিতজনের বাড়িতে চলে যাচ্ছে।
থানচি উপজেলাটি বান্দরবান সদর থেকে প্রায় ৭৮ কিলোমিটার দূরে। থানচির পাশের উপজেলা রুমা ৩০ কিলোমিটার দূরে। থানচির ফজলপাড়ার বাসিন্দা আরিফ ওরফে কানাইয়া আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘৮টা ২০ মিনিটে আমরা গোলাগুলির শব্দ শুনতে পাই। হেডম্যান, ফজল ও বাঙালিপাড়ার মানুষ ভয়ে জঙ্গলে পালিয়ে যায়। দুই ঘণ্টা আমরা সবাই জঙ্গলেই ছিলাম।’ থানচি বাজারের জান্নাত রেস্টুরেন্টের কর্মচারী মো. মহসীন বলেন, ‘আমরা খাদ্যগুদামে আশ্রয় নিয়েছিলাম।’ রুমা উপজেলা প্রশাসনের কর্মচারী মো. আবুল খায়ের বলেন, ‘৪০ বছর চাকরিজীবনে এ রকম পরিস্থিতি দেখিনি। সশস্ত্র হামলার পর সবার মধ্যে ভয় কাজ করছে।’
যৌথ বাহিনীর টহল জোরদার
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসন সূত্র বলেছে, সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় বান্দরবান সদর থেকে রুমা ও থানচি পর্যন্ত যৌথ বাহিনীর টহল জোরদার করা হয়েছে। বান্দরবানের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর) মো. শাহ আলম বলেন, সব জায়গায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।
ব্যাংক ডাকাতির ঘটনায় ৬ মামলা
গতকাল দুপুরে থানচি থানা পরিদর্শন শেষে চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি (প্রশাসন) সঞ্জয় সরকার বলেন, তিন ব্যাংকে ডাকাতি, পুলিশ ও আনসারের অস্ত্র লুট, থানায় হামলা এবং ব্যাংক ম্যানেজারকে অপহরণের ঘটনায় ছয়টি মামলা করেছে পুলিশ। মামলায় চার শতাধিক অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। মামলায় কেএনএফ সন্ত্রাসীদের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।
থানা ঘিরে শতাধিক অস্ত্রধারীর গুলি
পুলিশ বলেছে, বৃহস্পতিবার রাতে থানচি থানা আক্রমণের চেষ্টার আগে কেএনএফের একটি দল রেকি করে। এরপর উপজেলার নাইক্ষ্যানপাড়া থেকে থানার দিকে আসার চেষ্টা করে ৮০-৯০ জনের সশস্ত্র দল। উপজেলার হাসপাতাল রোড দিয়েও ৩০ জনের একটি দল থানা আক্রমণের চেষ্টা করে। তবে আত্মরক্ষার্থে পুলিশ গুলি চালিয়ে আক্রমণ ঠেকিয়ে দেয়।
স্থানীয় সূত্র বলেছে, বৃহস্পতিবার রাত ৮টার দিকে থানচি সদর ইউনিয়নের টুকতং ম্রোপাড়ায় সশস্ত্র একটি দলকে দেখা যায়। এ ছাড়া মোটরসাইকেলে তিন-চারজন অপরিচিত লোক থানচি থানা জামে মসজিদের আশপাশে ঘোরাঘুরি করছিল। ঠিক একই সময় থানচি সদর ইউনিয়নের তংক্ষ্যংপাড়ায় ১০-২০ জনের সশস্ত্র একটি দল অবস্থান করছিল। স্থানীয়রা গোপনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে মোবাইল ফোনে বিষয়টি জানায়। রাত সাড়ে ৮টায় টুকতংপাড়া থেকে থানচি থানা লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে সন্ত্রাসীরা।
থানচি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জসিম উদ্দিন গতকাল সকালে বলেন, ‘এখন পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে। আমরা জানতে পেরেছি, সন্ত্রাসীরা থানার আশপাশে রয়েছে। এ জন্য আমরা সতর্ক অবস্থায় রয়েছি।’
তিন উপজেলায় হামলার পরিকল্পনা ছিল
রুমায় উহ্লাচিং মারমা নামের এক যুবককে গুলির ঘটনায় কেএনএফের বিরুদ্ধে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি বিক্ষোভ করে এলাকাবাসী। এর জেরে ফেসবুকে ‘বান্দরবনবাসী’ নামের একটি পেজ থেকে রুমা, থানচি ও রোয়াংছড়িতে হামলার হুমকি দেওয়া হয়। এরপর গত ১২ মার্চ বম সম্প্রদায়ের দুই ব্যক্তিকে আটকের ঘটনায় ‘কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ)’ নামের পেজ থেকে ‘সুন্দর ফিডব্যাক’ দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়।
দ্বিতীয় পোস্টের ২১ দিনের মাথায় গত মঙ্গলবার রাতে রুমায় বিদ্যুতের সাবস্টেশন বন্ধ করে সোনালী ব্যাংকে হামলা চালায় কেএনএফ সদস্যরা। অপহরণ করে ব্যাংকের ব্যবস্থাপক নেজাম উদ্দিনকে। পরদিন দুপুরে গুলি চালিয়ে হামলা হয় থানচির সোনালী ও কৃষি ব্যাংকে। এরপর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মুক্তিপণের বিনিময়ে ব্যাংক ব্যবস্থাপককে ছেড়ে দেয় কেএনএফ। ঘণ্টাখানেক পর থানচি থানা লক্ষ্য করে গুলি চালায় তারা। তার কয়েক ঘণ্টা পর মধ্যরাতে আলীকদম চেকপোস্টে হামলা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, যে তিন উপজেলায় হামলার হুমকি দিয়েছিল কেএনএফ, তার মধ্যে দুটিতে এরই মধ্যে হামলা করেছে তারা। এই পরিস্থিতিতে রোয়াংছড়িতে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। রোয়াংছড়ির দায়িত্বে থাকা বান্দরবানের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর) মো. শাহ আলম বলেন, ‘রোয়াংছড়িতে এখনো কোনো সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেনি। তবে আমরা নিরাপত্তা জোরদার করেছি।’
এদিকে হামলার বিষয়ে গতকাল সকালে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট নামের ফেসবুক পেজে সংগঠনটির মিডিয়া ও ইন্টেলিজেন্স উইংয়ের প্রধান ‘কর্নেল সলোমন’-এর বরাতে একটি পোস্টে দাবি করা হয়, কেএনএফের সঙ্গে শান্তি আলোচনার যে চুক্তি সরকার করেছে, তার কোনো শর্তই সরকারপক্ষ সম্পাদন করেনি। পোস্টে জেলে বন্দীদের (কেএনএফ সদস্য নয়) মুক্তি না দেওয়া, নিরীহ জনগণকে হয়রানি, গ্রেপ্তারের হুমকিসহ ১০টি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে কথা বলতে পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির আহ্বায়ক ক্য শৈ হ্লার মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
এবার রোয়াংছড়িতে গোলাগুলির খবর
থানচি, রুমার পর এবার রোয়াংছড়িতে গোলাগুলির শব্দ পাওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, কেএনএফ এই গুলি করেছে। গতকাল রাত ১২টার দিকে রোয়াংছড়ির পাহাড় থেকে এই গুলির শব্দ শোনা যায় বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
রোয়াংছড়ির দায়িত্বে থাকা বান্দরবানের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. শাহ আলম বলেন, ‘আমিও স্থানীয়দের কাছ থেকে রোয়াংছড়িতে ফায়ার হয়েছে বলে শুনেছি। আমি স্পটে আছি, ভেরিফাই করার চেষ্টা করছি।’আজকের পত্রিকা