মাহমুদুর রহমান মান্না :- বর্তমানে বাংলা-দেশ এক বড় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটকাল অতিক্রম করছে। ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে একটি কর্তৃত্ববাদী সরকার দেশের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। সর্বশেষ ২০০৮ সালে দেশে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়েছিল। এর পর থেকে জনগণের ভোট ছাড়াই পর পর তিনবার বর্তমান ক্ষমতাসীনরা সরকার গঠন করেছে। যেহেতু রাষ্ট্রক্ষমতার জন্য জনগণের ভোটের প্রয়োজন হয় না, তাই জবাবদিহির জায়গাটা প্রতিনিয়ত সংকুচিত হতে হতে এখন দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলা যায়। যার ফলে বাংলাদেশ অবাধ দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থপাচারের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। ক্ষমতায় টিকে থাকতে আমলা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট এবং অলিগার্কদের একটি নেক্সাস তৈরি করেছে ক্ষমতাসীনরা। সরকারের স্বজনতোষী নীতির ফলে দেশের অর্থনীতি আজ নাজুক হয়ে পড়েছে।
অবাধ দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থ পাচার আর মেগা প্রকল্পের নামে মেগা লুটের লক্ষ্যে নেওয়া বেহিসেবি বিদেশি ঋণ আর স্বজনতোষী নীতি দেশের অর্থনীতিকে এমন এক অবস্থায় নিয়ে গেছে, যেখান থেকে ফেরানোর ক্ষমতা বর্তমান ক্ষমতাসীনদের আছে বলে মনে হয় না। উন্নয়নের গণতন্ত্রের নামে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো জিডিপি, পার ক্যাপিটা ইনকাম আর মেগা দুর্নীতির উপরে দাঁড়িয়ে থাকা মেগা অবকাঠামো দেশের অর্থনীতির সবগুলো অঙ্গকে ধসে পড়ার জন্য এক লাইনে দাঁড় করিয়েছে যা ডমিনো ইফেক্টের মতো যে কোনো মুহূর্তে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়তে পারে। বছর দেড়েক আগেও সরকার দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে বাহাদুরি করত। রিজার্ভ থেকে উন্নয়ন প্রকল্প এবং বিমান কেনায় ঋণ, আলাদা তহবিল গঠন করে ব্যবসায়ীদের ঋণ, এমনকি অন্য দেশকে ঋণ দেওয়ার মতো স্টান্টবাজি করেছে। সেই রিজার্ভ এখন খালি হওয়ার উপক্রম হয়েছে। দেশে শুধু রিজার্ভ সংকটই নয়, সরকারের কাছে টাকাও নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ করে (টাকা ছাপিয়ে) সরকার ব্যয় নির্বাহ করছে অনেক দিন থেকেই।
অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে এবং সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখতে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা স্কিম বাধ্যতামূলক করার মতো নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। সরকার মহাসড়কে টোলের খড়গ চাপাচ্ছে। আর সরকারের অলিগার্কদের পকেট ভরার জন্য করা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নীতির কারণে ভর্তুকি কমানোর অজুহাতে দফায় দফায় দাম বৃদ্ধি করছে। অথচ এ কথিত ভর্তুকির প্রায় পুরোটাই সরকার তার অলিগার্কদের পকেটে তুলে দিয়েছে। একই সময়ে টাকার মূল্যমান কমেছে প্রায় ৫০ শতাংশ। ডলার সংকটের কারণে আমদানি সংকোচননীতি গ্রহণ করায় বাজারে পণ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে ক্রমেই দ্রব্যমূল্য জনগণের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। পাশাপাশি সরকারের নেক্সাসে থাকা উচ্চ মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট বাজারকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলেছে। ফলে বর্তমানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে এবং দ্রব্যমূল্য অতীতের যে কোনো সময়ের রেকর্ড অতিক্রম করে নিম্নবিত্ত, এমনকি মধ্যবিত্তের সম্পূর্ণভাবে নাগালের বাইরে চলে গেছে।
আগেই বলেছি, বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের ক্ষমতার উৎস জনগণের ভোট নয়। বরং একটা নেক্সাস, যাদের জনগণের ট্যাক্সের টাকায় নানা রকম অনৈতিক সুবিধা দিয়ে নিজেদের পক্ষে রেখে তারা ক্ষমতায় টিকে আছে। আবার সরকার এবং সরকারি দলের অনেকেই এ অনৈতিক সুবিধার একটা বড় অংশীদার। ফলে এ গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষার বিপরীতে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। পাশাপাশি সরকারি দল এত বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত যে, এ বৃত্ত থেকে বের হওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয় এবং তাদের সেই সদিচ্ছাও নেই। দেশের নিত্যপণ্যের বাজার হাতেগোনা কয়েকটি শিল্প গ্রুপের হাতে নিয়ন্ত্রিত হয়, যার সবই সরকারের মদদপুষ্ট। ফলে যে কোনো ধরনের জবাবদিহির ঊর্ধ্বে থেকে তারা ব্যবসা পরিচালনা করে। এক কথায় বলা যায়, এ সরকারই একটি সিন্ডিকেট। বাজার এ সরকারি সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি।
অন্যদিকে প্রতি বছর গড়ে দেশ থেকে ব্যাংকিং চ্যানেলে আমদানি-রপ্তানি ব্যবসার আড়ালে ওভার এবং আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়। অন্য চ্যানেলে পাচার হওয়া অর্থ যোগ করলে এ পরিমাণ ১ লাখ কোটি টাকারও বেশি। সরকারের যোগসাজশেই এ অর্থ পাচার হয়, যার অসংখ্য প্রমাণ বিভিন্ন ঘটনায় আমাদের সামনে ইতোমধ্যে পরিষ্কার হয়েছে। ফলে এ অর্থ পাচার রোধ করার কোনো পরিকল্পনা সরকার কখনোই গ্রহণ করেনি এবং আগামীতেও করবে না। উপরন্তু প্রতি বছর বাজেটে পাচার হওয়া অর্থের বৈধতা দেওয়ার একটা প্রচেষ্টা থাকে সরকারের পক্ষ থেকে। মেগা প্রকল্পের নামে মেগা লুটের মাধ্যমে বিদেশি ঋণের লাখ লাখ কোটি টাকা সরকার আর তার অলিগার্করা আত্মসাৎ করে চলেছে। যার ফলে বাড়ছে বিদেশি ঋণের পরিমাণ এবং ঋণের কিস্তি পরিশোধের চাপ। ফলস্বরূপ একদিকে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তলানিতে পৌঁছে গেছে, অন্যদিকে টাকার মূল্যমান প্রতিনিয়ত আশঙ্কাজনকভাবে কমছে। এর প্রভাবে মূল্যস্ফীতি অতীতের সব রেকর্ড অতিক্রম করেছে।
আমদানি সংকোচনের প্রভাব পড়ছে দেশের উৎপাদন ব্যবস্থা এবং ব্যবসা বাণিজ্যে। পাশাপাশি সরকারের স্বজনতোষী এবং ভুলনীতির কারণে অকল্পনীয় হারে অব্যাহতভাবে বাড়ছে জ্বালানি তেল, গ্যাস এবং বিদ্যুতের দাম। ফলে উৎপাদন খরচ বেড়েছে কয়েক গুণ। একদিকে বাড়ছে মূল্যস্ফীতি, অন্যদিকে সংকুচিত হচ্ছে প্রতিযোগিতামূলক বৈদেশিক বাণিজ্যের সুযোগ। অথচ এর পরেও জ্বালানি খাতে স্বজতোষী নীতি থেকে বের হয়নি সরকার। গণতন্ত্র, মানবাধিকার, শ্রমনীতির প্রশ্নে আমদানিকারক দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করেছে সরকার। ফলে রপ্তানি কমছে আশঙ্কাজনকভাবে। অবৈধভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকতে এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের কোনো উদ্যোগ সরকার নিচ্ছে না। কিংবা বলা যায়, সেই সক্ষমতা তাদের নেই।
প্রশ্ন হচ্ছে, এ পরিস্থিতি থেকে কি উত্তরণ সম্ভব? এক কথায় উত্তর দিলে বলতে হবে, সম্ভব, তবে তার জন্য সবার আগে প্রয়োজন জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা, যাদের এ সংকট কাটানোর সদিচ্ছা থাকবে। এমন একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা যার মূলনীতি হবে জনগণের কল্যাণ। এমন একটি সংগঠনের হাতে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব যারা নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য কাজ করবে না, যাদের ক্ষমতার উৎস হবে জনগণের সমর্থন। এ কারণেই আমরা কল্যাণ রাষ্ট্রের কথা বলি, কল্যাণ অর্থনীতির কথা বলি। অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের অভিপ্রায় না থাকলে এবং জনগণের সমর্থন থাকলে সেই সরকার সিন্ডিকেটকে প্রশ্রয় দেবে না; জ্বালানি খাতে রেন্টাল, কুইক রেন্টাল, ক্যাপাসিটি চার্জ আর লুটপাটকে জায়েজ করতে সংসদকে ব্যবহার করে ইনডেমনিটি আইন জারির মতো স্বজনতোষী নীতি গ্রহণ করবে না; পাচারকারীদের প্রশ্রয় দেবে না কিংবা নিজেরাও লুটপাট, পাচারের অংশীদার হবে না। দুর্নীতি, লুটপাট, বিদেশে অর্থপাচার বন্ধ করতে পারলে এবং জ্বালানি খাতসহ সরকারের সব কর্মকাণ্ডে স্বজনতোষী নীতি বর্জন করলে দেশের রিজার্ভ সংকট কাটবে, টাকার মূল্যমান বাড়বে এবং একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে, দ্রব্যমূল্য মানুষের নাগালের মধ্যে থাকবে।
এজন্য প্রয়োজন কল্যাণ অর্থনীতি, কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে সংগঠন গড়ে তোলা। যাদের কাছে জনগণের কল্যাণই হবে সত্যিকারের উন্নয়ন। আমরা এমনই একটি সংগঠন গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। ইউনিভার্সাল বেসিক পে ধারণা থেকে আমরা বলি, দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী থেকে শুরু করে ৬ কোটি মানুষকে মাসে ১ হাজার করে টাকা দেয়া, মধ্যবিত্ত পর্যন্ত বিনামূল্যে ওষুধসহ সব ধরনের চিকিৎসা প্রদান এবং উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত বিনা খরচে শিক্ষা এবং নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানদের বিনা খরচে উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করা। এ লক্ষ্যগুলো অর্জনই আমাদের উন্নয়নের সংজ্ঞার প্রথম পাঠ। অবকাঠামোগত উন্নয়ন অবশ্যই প্রয়োজন। কিন্তু সেই উন্নয়নের খেসারত দিয়ে যদি দেশের মানুষকে না খেয়ে থাকতে হয়, নিম্নবিত্ত, এমনকি মধ্যবিত্ত পর্যন্ত স্বাভাবিক জীবনযাত্রার নিশ্চয়তা না পায়, মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস ওঠে; তাকে আর যাই হোক, উন্নয়ন বলা যায় না। করোনা মহামারি চলাকালীন যখন ক্ষমতাসীনরা মেগা প্রকল্পের নামে মেগা লুট চালিয়ে যাচ্ছিল, তখন আমরা বলেছি, ‘বিপর্যয়ের মধ্যে জনগণকে বাঁচিয়ে রাখার চেয়ে বড় কোনো উন্নয়ন প্রকল্প হতে পারে না।’ মাহমুদুর রহমান মান্না : সভাপতি, নাগরিক ঐক্য