&& শুধু রাজধানীতে বাস-মিনিবাস থেকে মাসে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার চাঁদাবাজি * পিছিয়ে নেই পুলিশ, ঘাটে ঘাটে টোকেন ধরিয়ে চলে নীরব চাঁদাবাজি
ডেস্ক রির্পোট:- রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে পরিবহণ চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট। মালিক-শ্রমিক সংগঠন, পুলিশ, স্থানীয় মাস্তান ও কতিপয় অসৎ রাজনৈতিক নেতারা এ চক্রে জড়িত। যাত্রী কিংবা পণ্য পরিবহণ-সব ক্ষেত্রেই চাঁদা ছাড়া ঘোরে না গাড়ির চাকা। পার্থক্য শুধু চাঁদাবাজির কৌশলে। আন্তঃজেলা ট্রাকের ক্ষেত্রে মাসোহারা হিসাবে টোকেন দিয়ে নীরব চাঁদাবাজি করে ট্রাফিক পুলিশ। আর ঢাকায় ঢোকার মুখে চাঁদা তুলতে সরব স্থানীয় মাস্তানদের লাঠিয়াল বাহিনী। পণ্যবাহী ট্রাকচালকদের জিম্মি করে চলে তাদের চাঁদাবাজি। চাঁদা না দিলে তারা হামলে পড়েন।
যাত্রী পরিবহণে মূল চাঁদাবাজির অভিযোগ রুট মালিক ও মালিক-শ্রমিক সমিতির নেতাদের বিরুদ্ধে। তারা প্রতিদিন চাঁদা তুলে বিভিন্ন স্তরে ভাগবাঁটোয়ারা করে নেন। দূরপাল্লা ও নগর পরিবহণে ‘জিপির’ (চাঁদা তোলার সাংকেতিক নাম) নামে বাসপ্রতি ৭০০ থেকে ৩ হাজার টাকা চাঁদা তুলেন রুট মালিকরা। এটা অনেকটা স্বীকৃত। এ খাত থেকে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার চাঁদা তোলা হয়। সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে শুধু ঢাকায় চলাচলকারী বাস থেকেই বছরে ১ হাজার ৬০ কোটি টাকা চাঁদাবাজির তথ্য প্রকাশ করে।
এদিকে অনুসন্ধানে ঢাকায় অন্তত ৭ হাজার বাস-মিনিবাস থেকে মাসে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা চাঁদাবাজির তথ্য পাওয়া গেছে। ভুক্তভোগীরা বলেছেন, বেপরোয়া চাঁদাবাজির কারণে সাধারণ পরিবহণ মালিকদের ‘লাভের গুড় পিঁপড়ায় খায়’। ফলে লোকসানের মুখে একসময় অনেকেই ব্যবসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার ড. খ. মহিদ উদ্দিন বলেন, ‘চাঁদাবাজির সেই পরিবেশ এখন আর নেই। আমরা সবাইকে বলে দিয়েছি, পুলিশের দ্বার সব সময় সবার জন্য উন্মুক্ত। যদি কোথাও চাঁদাবাজি হয়, সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জানান। বিভিন্ন স্থানে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের মোবাইল নম্বরও প্রদর্শন করে রাখা হয়েছে। প্রয়োজনে সেখানে কল করুন। তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এতে যারাই জড়িত থাকুক, পার পাওয়ার সুযোগ নেই। রমজান ও ঈদ উপলক্ষ্যে ঢাকার প্রবেশপথগুলোয় নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।’
জানা যায়, ঢাকা মেট্রোপলিটন রিজিওনাল ট্রান্সপোর্ট কমিটির অনুমোদিত রুটের সংখ্যা ৩৮৬টি। এর মধ্যে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) মাঠ পর্যায়ে জরিপ চালিয়ে ১২৮টি রুটে বাস-মিনিবাস চলাচলের প্রমাণ পেয়েছে। এসব রুটে সাত হাজারের বেশি গাড়ি চলাচল করে। বাস চালানোর জন্য মালিকদের বাসপ্রতি দিনে চাঁদা গুনতে হয় ৭০০ থেকে ১৫০০ টাকা। আর দূরপাল্লার গাড়ি থেকে জিপির নামে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা তোলা হচ্ছে। যেসব কোম্পানির ব্যানারে গাড়িগুলো চলে, সেই কোম্পানির পরিচালনা কর্তৃপক্ষ চাঁদা তুলে বিভিন্ন স্তরে ভাগবাঁটোয়ারা করে দেয়।
সরেজমিন বাসচালক ও হেলপারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাজধানীতে চলাচলকারী ব্যক্তিমালিকানাধীন বাসের অন্যতম বড় কোম্পানি আলিফ এন্টারপ্রাইজ। এ কোম্পানির অধীনে চারটি রুটে কমবেশি ২৫০টি বাস চলাচল করে। মিরপুর-১ থেকে বনশ্রী হয়ে ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার রুটে চলে ৭০টি গাড়ি। দিনে জিপির নামে মালিকদের গাড়িপ্রতি চাঁদা দিতে হয় ১১০০ টাকা। ৬০ টাকা দিতে হয় সিটি করপোরেশনের চাঁদা। মোহাম্মদপুর শিয়া মসজিদ থেকে বনশ্রী হয়ে স্টাফ কোয়ার্টার রুটে চলে ৫০টি গাড়ি। দিনে প্রতি গাড়ি থেকে চাঁদা তোলা হয় ১০২০ টাকা। মোহাম্মদপুর শিয়া মসজিদ থেকে আব্দুল্লাহপুর-কামারপাড়া রুটে চলে ৪৫টি গাড়ি। প্রতি গাড়ি থেকে চাঁদা নেওয়া হয় ১১০০ টাকা। মিরপুর ১৪ নম্বর থেকে আশুলিয়া-ইপিজেড রুটে চলে ৯০টি গাড়ি। প্রতি গাড়ি থেকে দিনে চাঁদা তোলা হয় ১১০০ টাকা। এ হিসাবে এ কোম্পানি দিনে চাঁদা তোলে ২ লাখ ৮১ হাজার ৫০০ টাকা। মাসে এ চাঁদার হার দাঁড়ায় ৮৪ লাখ ৪৫ হাজার (প্রায় কোটি) টাকা। এ কোম্পানির মালিক সাইদুর রহমান এককভাবে এই চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করেন। চাঁদার একটি অংশ স্টাফদের মাধ্যমে বিভিন্ন স্তরে পৌঁছে দেওয়া হয়। বাকিটা কোম্পানির স্টাফদের বেতন এবং নিজে ভোগ করেন। সাধারণ মালিকদের পথে বসিয়ে এখন তিনি অঢেল টাকার মালিক। এ হিসাবে রাজধানীতে চলাচলকারী ৭ হাজার বাস-মিনিবাস থেকে মাসে প্রায় ২৩ কোটি টাকার বেশি চাঁদা তোলা হচ্ছে। বছরে এই চাঁদার অঙ্ক দাঁড়ায় পৌনে ৩০০ কোটি টাকার বেশি।
চাঁদাবাজির বিষয়ে জানতে আলিফ এন্টারপ্রাইজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইদুর রহমানের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। একই নম্বরের হোয়াটসঅ্যাপে তার বক্তব্য চেয়ে খুদেবার্তা পাঠালেও তিনি কোনো জবাব দেননি। তবে মোবাইল ফোনে তার প্রতিষ্ঠানের হিসাব কর্মকর্তা মো. সাব্বির বলেন, ‘আমাদের কোম্পানির ব্যানারে চারটি রুটে কমবেশি ১৫০টি বাস চলাচল করে। তবে আমরা কোনো চাঁদা আদায় করি না। কোম্পানির পরিচালন ব্যয় বাবদ গাড়িপ্রতি ৪/৫শ টাকা নেওয়া হয়।’
অনুসন্ধানে জানা যায়, ঢাকায় যাত্রীবাহী পরিবহণ ও ট্রাকে চাঁদাবাজির ধরন আলাদা। বাসগুলোর ক্ষেত্রে মূলত কেন্দ্রীয়ভাবে মালিক সমিতিগুলো এটি নিয়ন্ত্রণ করে। পণ্যবাহী ট্রাকে এমন কেন্দ্রীয় কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এ কারণে যে যেভাবে পারছে এ পরিবহনগুলো থেকে চাঁদা তুলছে। সরেজমিন দেখা যায়, ঢাকার বাইরে ট্রাকে পণ্য ওঠানো থেকে শুরু হয় চাঁদাবাজি। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ঢাকায় আসতে গড়ে ৫-৭টি স্পটে ৭০০ থেকে এক হাজার টাকা চাঁদা গুনতে হয়। এছাড়া রয়েছে বিভিন্ন ধরনের কার্ড। এক মাসের জন্য ১৫শ টাকা দিয়ে এই কার্ড নিলে সংশ্লিষ্ট ট্রাকের বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয় না। মেয়াদ শেষে কার্ড নবায়ন না করলেই মামলা হয়। চলে নানামুখী হয়রানি। এছাড়া বিভিন্ন সাংকেতিক কোড ব্যবহার করলে চাঁদার পরিমাণ বাড়ে-কমে।
ট্রাকচালক ও মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পুলিশের তরফ থেকে বিভিন্ন সাংকেতিক চিহ্ন ও নম্বর দিয়ে চাঁদা আদায়ের টোকেনও দেওয়া হচ্ছে। হাইওয়ে সড়কে সরেজমিন দেখা যায়, লেজার লাইট দিয়ে ইশারা দিয়ে থামানো হচ্ছে গাড়ি। এরপর টোকেন চেক করে কোনো গাড়ি তাদের ইশারা না মেনে সামনে গেলে সেগুলোয় ভাঙচুর করা হচ্ছে। ঢাকার প্রবেশপথগুলোয়ও দেখা গেছে এমন পরিস্থিতি। রাজধানীর কাওরান বাজার, বাবুবাজার, গুলিস্তান, দৈনিক বাংলা মোড়, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, ইত্তেফাক মোড়, টিটিপাড়া, কাজলা, গাবতলী, ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টারসহ বিভিন্ন এলাকায় তাদের দৌরাত্ম্য বেশি চোখে পড়েছে। তবে কিছুদিন আগে চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে র্যাবের অভিযানে কয়েকটি এলাকা থেকে ৫১ জন গ্রেফতারের পর এ এলাকাগুলোয় লাঠিয়াল বাহিনীর তৎপরতা কিছুটা কমেছে।
ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় সরেজমিন দেখা যায়, সড়কে মূলত বিভিন্ন ইজারাদার প্রতিষ্ঠানের নাম নিয়ে চলে চাঁদাবাজি। কোথাও আবার সিটি টোল, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন এবং সমিতির নামে ওঠে চাঁদা। রাত যত গভীর হয়, তাদের তৎপরতা ততই বাড়তে থাকে। কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে প্রতি রাতে নেমে পড়েন তারা। ৩-৭ জনের একেকটি গ্রুপের হাতে থাকে লাঠি। শুরুতে তারা ইশারা করে পণ্যবাহী গাড়িগুলোকে থামান। ভুক্তভোগীদের মধ্যে রফিক নামের এক ট্রাকচালক যুগান্তরকে জানান, ‘আমাগো চাঁন্দা কাটতে সয়ে গ্যাছে। না দিলেই নানা ঝামেলায় পড়তি হয়।’ হেলপার মনির জানান, চাঁদাবাজদের সিগন্যাল উপেক্ষা করে গাড়ি চালানোয় অনেকে নানা রকম ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। চাঁদাবাজরা কারও কারও গাড়িও ভাঙচুর করেছেন। মারধর করেছেন অনেক চালক ও সহযোগীকে। এ কারণে চাঁদাবাজদের এক ইশারাতেই এখন থেমে যায় গাড়ি। প্রতিটি স্পটে গড়ে ১০০-৩০০ টাকা দিতে হয় চাঁদা।
কুমিল্লা থেকে ট্রাকে কাঁচামাল নিয়ে ঢাকার কাওরান বাজারে আসেন চালক জাহিদ হাসান (ছদ্মনাম)। তিনি বলেন, ঢাকায় আসতে তাকে ৬০০-৭০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। কাজলা, চিটাগাং রোড, শনিরআখড়াসহ বিভিন্ন পয়েন্টে দিতে হয় এ চাঁদা। তার ভাষায়, ‘পোলাপান রাতে আইসা গাড়ির সামনে খাড়ায়। কথামতো টাকা দেই নাই দেইখা একবার লাডি দিয়া পিডাইয়া আমার গাড়ির সামনের গ্লাস ওরা ফাডাইয়া ফালাইছে। এখনো গ্লাসটা ফাডা (ভাঙা)। একেক জায়গায় দেড়শ-দুইশ কইরা টাকা দিতে হয়।’
জানা যায়, চাঁদা তোলার জন্য রীতিমতো বেতনভুক্ত লাঠিয়াল বাহিনীও রাখা হচ্ছে। তারা রোস্টার করে ডিউটি বণ্টন করে চাঁদা তোলে। যারা সরাসরি রাস্তা থেকে চাঁদা আদায় করেন, তাদের প্রতি রাতে ৭০০-১০০০ টাকা করে বেতন দেওয়া হয়। বিনিময়ে প্রতিটি স্পট থেকে লাখ লাখ টাকা যায় চাঁদাবাজদের হাতে। এই টাকার বড় একটি অংশ যায় পুলিশ ও স্থানীয় রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের হাতে। এভাবে বছরের পর বছর চলছে চাঁদাবাজচক্রের তৎপরতা। মাঝেমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে চুনোপুঁটিরা ধরা পড়লেও গডফাদাররা থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।যুগান্তর