রাঙ্গামাটি:- রাঙ্গামাটি জেলা শহরে এগিয়ে থাকা স্কুলগুলোর একটি ‘গৌধূলি আমানতবাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।’ সেখানকার পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী বিনয় জ্যোতি চাকমা (১১)। কিন্তু নিজের মাতৃভাষা চাকমা বর্ণমালা লিখতে ও পড়তে পারে না। অথচ প্রাক-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত তাকে মাতৃভাষার পাঠ্যবই দেওয়া হয়েছিল। মাতৃভাষায় পাঠদান প্রসঙ্গে বিনয় জ্যোতি চাকমা জানায়, ‘স্যারেরা ক্লাসে পড়ান না। সহপাঠীরাও পারে না। এমনকি তার বাবা, মা-ও পারেন না’।
মাতৃভাষার পাঠদানে শহরের এই বিদ্যালয়ের যখন এমন অবস্থা, তখন পুরো জেলার ৯ শতাধিক বিদ্যালয়ের সার্বিক চিত্র সহজেই অনুমেয়। মূলত দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাবে এগোচ্ছে না ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষার পাঠদান। শিক্ষার্থীরাও এসব পাঠ্যবইয়ের পাঠ নিতে পারছে না। এই কারণে সরকারের এই মহতী উদ্যোগ থেকে আসছে না কাঙ্ক্ষিত সাফল্য।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, রাঙ্গামাটি জেলায় বাঙালি জনগোষ্ঠী ছাড়া ১৩টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের বসবাস। এদের মধ্যে কোনো কোনো নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব বর্ণমালা থাকলেও লিখন ও পাঠন চর্চা নেই। এমনকি বর্তমান প্রজন্ম নিজের বর্ণমালার সঙ্গে পরিচিতি ছাড়াই বেড়ে উঠছে। এর ফলে কয়েকটি জাতিগোষ্ঠী হারাতে বসেছে নিজস্ব ভাষা ও বর্ণমালা। তবে সরকারের সদিচ্ছায় ২০১৭ সালে শুরু হয় ‘মাতৃভাষায় প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম। এতে পাহাড়ের তিন জনগোষ্ঠীর (চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা) শিশুদের নিজের ভাষায় পড়ালেখার সুযোগ তৈরি হয়। প্রাক-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত নিজস্ব মাতৃভাষার বই চালু করে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। এই তিন বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত ২৮ হাজার ১৫৫ জন শিক্ষার্থীর মাঝে তাদের মাতৃভাষার ৬৩ হাজার ৪৬৮টি বই বিতরণ করা হয়েছে। দেওয়া হয়েছে শিক্ষক সহায়িকা ও শিখন চর্চা খাতাও।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয়ের তথ্য বলছে, রাঙ্গামাটি জেলার ১০ উপজেলায় চলতি শিক্ষাবর্ষে ৯০৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বই বিতরণ করা হয়েছে। প্রাক-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ৯১ হাজার ৩১৬ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে বই দেওয়া হয়েছে ৩ লাখ ৮৬ হাজার ৭৮৯টি। এর মধ্যে প্রাক-প্রাথমিকে ১৪ হাজার ১৮টি, প্রথম শ্রেণিতে ২১ হাজার ১২৯টি, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ২১ হাজার ৩২৭টি ও তৃতীয় শ্রেণিতে ৬ হাজার ৯৯৪টি বই বিতরণ করা হয়েছে। এদের মধ্যে প্রাক-প্রাথমিকে চাকমা ১১ হাজার ৭৪ জন, মারমা ২ হাজার ৮ জন, ত্রিপুরা ৬৩৬ জন, প্রথম শ্রেণিতে চাকমা ১৫ হাজার ৫৯৩ জন, মারমা ৩ হাজার ৫৩৪ জন, ত্রিপুরা ১ হাজার দুজন। আর দ্বিতীয় শ্রেণিতে চাকমা ১৬ হাজার ৯৯৮ জন, মারমা ৩ হাজার ৭৫ জন, ত্রিপুরা ৯৫৪ জন এবং তৃতীয় শ্রেণিতে চাকমা ৫ হাজার ৫৪০ জন, মারমা ১ হাজার ১১২ জন এবং ত্রিপুরা শিক্ষার্থী রয়েছে ৩৪২ জন।
গোধূলি আমানতবাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বিনয় জ্যোতি চাকমার বাবা সাংবাদিক পলাশ চাকমা বলেন, ‘স্কুলে শিক্ষক না থাকায় মাতৃভাষার পাঠদান হয় না। আমাদের মধ্যেও চর্চা আর সুযোগ না থাকায় আমরাও নিজেদের বর্ণমালা লিখতে ও পড়তে পারি না। ফলে বাসায় সন্তানকে শেখাব সেই সুযোগও নেই।’
ইলা চাকমা নামের আরেক অভিভাবক বলেন, ‘মাতৃভাষার বই পাওয়ায় অভিভাবক হিসেবে আমি দারুণ খুশি। বাচ্চারা এখন নিজের বর্ণমালা, ভাষা লিখতে ও শিখতে পারবে। বাচ্চাদের শিক্ষার ক্ষেত্রে মাতৃভাষার বই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু স্কুলগুলোতে পর্যাপ্ত দক্ষ শিক্ষক নাই। সরকারকে এদিকে নজর দিতে হবে’।
রাঙ্গামাটি পাবলিক কলেজের প্রভাষক ও লেখক মুকুল কান্তি ত্রিপুরা বলেন, ‘মাতৃভাষায় পাঠ্যবই প্রকাশ আওয়ামী লীগ সরকারের খুবই প্রশংসনীয় উদ্যোগ। তবে এসব বই পাঠদানে উপযুক্ত শিক্ষক না থাকায় সরকারের এ কার্যক্রম থমকে আছে। শিক্ষকদের মাতৃভাষার প্রশিক্ষণ দিয়ে এ সংকটের সমাধান সম্ভব নয়। এ জন্য স্ব স্ব মাতৃভাষায় দক্ষ ও বিশেষায়িত শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে।’
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা হৃষীকেশ শীল বলেন, ‘জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। খুব শিগগির মাতৃভাষার শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ শুরু হবে। তখন এ সংকট থাকবে না।’
রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খান বলেন, ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষাকে ধরে রাখতে সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এরই মধ্যে জেলার সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে মাতৃভাষার পাঠ্যবই।’ খবরের কাগজ