৫৯৪ প্রতিষ্ঠানের হাজার কোটি টাকা পাচার

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় সোমবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪
  • ১২৫ দেখা হয়েছে

ডেস্ক রির্পোট:- আমদানি-রপ্তানিতে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ৫৯৪ প্রতিষ্ঠান ১ হাজার ৭৬ কোটি টাকা পাচার করেছে। এসব প্রতিষ্ঠান মিথ্যা তথ্য দিয়েও ৪১৬ কোটি টাকার কাঁচামাল আমদানি করে উৎপাদনে না লাগিয়ে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে। এসব আর্থিক অনিয়ম করায় ৫৯৪ প্রতিষ্ঠানেরই আমদানি-রপ্তানি স্থগিত এবং শুল্কমুক্ত সুবিধা বাতিল করা হয়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের বাস্তবে অস্তিত্বই ছিল না। বাকিগুলো এক সময়ে উৎপাদনে থাকলেও এখন নেই।

সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের অর্থপাচার সম্পর্কিত তৈরি প্রতিবেদন থেকে এসব জানা যায়। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর এবং চট্টগ্রাম কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত টাস্কফোর্স কমিটি আলাদাভাবে তদন্ত করেছে।

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর থেকে অর্থপাচার রোধে এবং মিথ্যা তথ্যে শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানি বন্ধ করতে সব বন্দরে স্ক্যানার ব্যবহার, বিদেশে রাজস্ব দপ্তর স্থাপন ও ল ফার্মের সঙ্গে চুক্তি করে পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে উদ্যোগ গ্রহণ, সোনা পাচার রোধে সেল গঠন, অবৈধ মানিচেঞ্জার বন্ধ করার সুপারিশ করেছে।

অর্থনীতিবিদরা শুল্ক গোয়েন্দাদের সুপারিশের সঙ্গে এক মত জানিয়ে অর্থপাচার কমাতে আরেও কিছু সুপারিশ করেছেন।

তারা পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে আইনি সক্ষমতা বাড়ানো এবং অর্থপাচারে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনারও পরামর্শ দেন।

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ ফকরুল আলম বলেন, ‘অর্থ পাচার বন্ধ করতে শুল্ক গোয়েন্দারা জোর দিয়ে কাজ করছেন। একই সঙ্গে তারা অর্থপাচার বন্ধ করতে বিভিন্ন সুপারিশও করেছেন। একই সঙ্গে কঠোর আইন প্রয়োগ এবং সুপারিশ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে অর্থপাচার বন্ধ হবে।’

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের প্রতিবেদন অনুযায়ী গত জুলাই থেকে প্রায় ৪ হাজার প্রতিষ্ঠানের ২০২২ এবং ২০২৩ সালের আমদানি-রপ্তানির তথ্য খতিয়ে দেখা হয়েছে। এর মধ্যে ৫৯৪টি প্রতিষ্ঠান অর্থপাচার এবং শুল্কমুক্ত সুবিধায় পণ্য এনে খোলাবাজারে বিক্রি করেছে। দুর্নীতিবাজ এসব প্রতিষ্ঠানের সবই চট্টগ্রাম ও এর আশেপাশে প্রতিষ্ঠিত। এসব প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের আওতাভুক্ত।

এসব প্রতিষ্ঠান ১১ হাজার ৩০২ চালানে ১ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি করলেও দেশে এনেছে ৫০২ কোটি টাকা। বাকি ১ হাজার ৭৬ কোটি টাকা সিঙ্গাপুর, দুবাই, মালয়েশিয়া, কানাডাসহ ২৫টি দেশে পাচার করতে ভুয়া রপ্তানি নথি ব্যবহার করেছে প্রতারকচক্র। রপ্তানি করতে পণ্যের প্রকৃত দামের চেয়ে অন্তত ১০ গুণ কম মূল্য দেখানোর পাশাপাশি রপ্তানি পণ্যকে ‍‍‍‍‍‘নমুনা’ পণ্য হিসেবে দেখানো হয়েছে। নমুনা পণ্য হিসেবে দেখানোর কারণে এসব পণ্যের বিপরীতে দেশে কোনো টাকা প্রবেশের সুযোগ নেই।

প্রতিবেদনে কালভিন ফ্যাশন লিমিটেড, ক্রাউন অ্যারো লিমিটেড, আজমাইন ফ্যাশন লিমিটেড, ডি ওয়াটার টেক লিমিটেড, ফোরসার্কেল ফ্যাশন ওয়্যার লিমিটেড, বিএসএ গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, ডিপিটি ফ্যাশন লিমিটেড, ইস্টার্ন ফ্যাশন লিমিটেড, ফ্যামান ফেয়ার লিমিটেড, গ্লোবাল স্পেশালাইজড গার্মেন্ট লিমিটেডসহ ৫৯৪ প্রতিষ্ঠানের বিন লক (ব্যবসা চিহ্নিতকরণ নম্বর বন্ধ) করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে শুল্ক গোয়েন্দার এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, এসব অর্থ পাচারের সঙ্গে একাধিক চক্র জড়িত। দেশে-বিদেশে অনেক সনামধন্য প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছি। খুব শিগগির তাদের বিরুদ্ধে আরও বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে মামলা করা হবে।

এর আগে তৈরিপোশাক রপ্তানির আড়ালে ৩৩টি প্রতিষ্ঠানের ৮২১ কোটি টাকা পাচারের তথ্য উদঘাটন করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। এসব প্রতিষ্ঠান ১৩ হাজার ৮১৭টি চালানে ৯৩৩ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি করলেও দেশে আনে ১১১ কোটি টাকা। বাকি ৮২১ কোটি টাকা সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, কাতার, স্পেন, কুয়েত, ফিলিপাইন, সুইডেন, রাশিয়া, পানামা, থাইল্যান্ড, জর্জিয়া এবং ফিলিস্তিন অঞ্চলসহ ২২টি দেশে পাঠানো হয় বলেও তদন্তে ধরা পড়ে। এ কাজে জড়িতদের ধরতেও তদন্ত চলছে।

অর্থ পাচার কমাতে সুপারিশ
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে আমদানি-রপ্তানি হচ্ছে এক জাতীয় পণ্য আর পণ্যের সঙ্গে কাগজপত্রে থাকছে অন্য ধরনের পণ্যের ঘোষণা। এনবিআর লোকবলের অভাবে সব পণ্য ঘোষণার সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে পারছে না। আর এ সুযোগে অর্থপাচার এবং মিথ্যা তথ্যে শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানি হচ্ছে। এসব বন্ধ করতে সব বন্দরে স্ক্যানার বসিয়ে তার সাহায্যে আমদানি-রপ্তানি করা পণ্যের কার্টনে প্রকৃতপক্ষে কী পণ্য বন্দরে প্রবেশ করানো হচ্ছে বা বন্দর থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তা যাচাই করতে বলা হয়েছে। এতে মিথ্যা ঘোষণার সুযোগ থাকবে না বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। রাজস্ব দপ্তর স্থাপন ও ল ফার্মের সঙ্গে চুক্তি করে পাচার করা অর্থ ফেরত আনা সহজ হবে বলেও জানানো হয়েছে।

সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল অর্থপাচার বন্ধে স্ক্যানারের ব্যবহারে জোর দিয়ে এনবিআরকে সব বন্দরে স্ক্যানার কিনতে পদক্ষেপ নিতে বলেছিলেন। এনবিআর এ নির্দেশ বাস্তবায়নে উদ্যোগ নিয়েছে।

স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাজুস) সাবেক সভাপতি এনামুল হক খান বলেন, চোরাচালানের মাধ্যমে প্রতিবছর প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। সিআইডির তথ্য অনুযায়ী, অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জার প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতিদিন ৭৫০ কোটি টাকা সমমূল্যের অর্থ লেনদেন হচ্ছে। আনুমানিক এ হিসাবে সংখ্যাটি মাসে ২২ হাজার ৫০০ কোটিতে দাঁড়ায়। এ পরিমাণ অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে পাচার হচ্ছে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, দেশে অনুমোদিত ২৩৫টির বাইরে আরও ৭০০-এর মতো মানিচেঞ্জার প্রতিষ্ঠান অনুমোদন ছাড়াই কার্যক্রম চালাচ্ছে। শুল্ক গোয়েন্দারা সোনা পাচার রোধে এবং অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জার বন্ধে সুপারিশ করেছেন।

এগমন্ট গ্রুপ হলো বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (এফআইইউ) সমন্বয়ে গঠিত একটি আন্তর্জাতিক ফোরাম। এ গ্রুপের সদস্যরা বিভিন্ন দেশের একই ধরনের সংস্থার কাছ থেকে অর্থপাচার, সন্ত্রাসে অর্থায়ন ও বিদেশে পাচার করা অর্থের তথ্য পেতে পারে। বাংলাদেশ এগমন্ট গ্রুপের সদস্য। এ সুবিধা ব্যবহার করে তথ্য সংগ্রহের কাজ করছে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘দেশে দুর্নীতি আরও কমাতে হবে। এতে অসাধু ব্যক্তিরা অর্থ হাতিয়ে নিয়ে পাচার করতে পারবেন না। একই সঙ্গে পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে আইনি সক্ষমতা বাড়ানো এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে পারলেও অর্থপাচার কমবে।’খবরের কাগজ

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.net
Website Design By Kidarkar It solutions