ডেস্ক রির্পোট:- সারা দেশের কারাগারগুলো বন্দিতে ঠাসা। কারাগারের প্রতিটা কক্ষ বন্দিতে গিজগিজ করছে। বেশির ভাগ কারাগারেই ধারণ ক্ষমতার চেয়ে দ্বিগুণ বন্দি। খাবার, থাকার জায়গা, শৌচাগার, গোসল, চিকিৎসা সবকিছুতেই দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন বন্দিরা। দ্বিগুণ বন্দি হওয়ার কারণে ন্যায্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তারা। রাজনৈতিক অস্থির পরিস্থিতি বিরাজ করলে আরও বেহাল দশার সৃষ্টি হয়। দীর্ঘদিন ধরে কারাগারগুলোতে এই অবস্থা বিরাজ করলেও এ নিয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। কারা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বন্দি বেশি হলেও বড় ধরনের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। ৯০ হাজারের মতো বন্দি রাখার মতো ব্যবস্থা আছে। কিন্তু মানবাধিকার সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, কারাগারেও মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
কারণ কারাগার রাষ্ট্রীয় হেফাজত। সেখানে কেউ থাকলে তার দায়িত্বও রাষ্ট্রকে নিতে হবে। এ ছাড়া বিনা কারণে যাতে কাউকে কারাগারে যেতে না হয় সেজন্য থানা পুলিশকে সতর্ক থাকতে হবে।
কারাসূত্রগুলো বলছে, ১৩টি কেন্দ্রীয় ও ৫৫টি জেলা কারাগার নিয়ে দেশে ৬৮টি কারাগার আছে। এসব কারাগারে বন্দি ধারণক্ষমতা ৪২ হাজার ৮৮৮। কিন্তু এখন বন্দি আছে প্রায় ৭৪ হাজার ১০৩। ঢাকা বিভাগে বন্দি ধারণক্ষমতা ১৩ হাজার ৪২১। চট্টগ্রাম বিভাগে ৬ হাজার ৯৫০, রাজশাহী বিভাগে ৪ হাজার ১৭৯, খুলনা বিভাগে ৫ হাজার ৬৯, বরিশাল বিভাগে ১ হাজার ৯১৩, সিলেট বিভাগে ৪ হাজার ৪৬১, রংপুরে ৫ হাজার ১৭৯ ও ময়মনসিংহে ১ হাজার ৮০৩ জন।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কেরানীগঞ্জে বন্দি ধারণক্ষমতা ৪ হাজার ৫৯০ জন। গতকাল পর্যন্ত সেখানে বন্দি ছিল ৮ হাজার ৫৮২ জন। সিনিয়র জেল সুপার সুভাষ কুমার ঘোষ বলেন, বন্দি বেশি হলেও সমস্যা হচ্ছে না। এখনো অনেক বন্দি রাখার ব্যবস্থা আছে। কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারে ধারণ ক্ষমতা ১ হাজার জন। সেখানেও প্রায় দ্বিগুণ বন্দি রয়েছে। কাশিমপুর মহিলা কারাগারে ধারণক্ষমতা ২০০ হলেও সেখানেও প্রায় তিনগুণ বন্দি।
চট্টগ্রাম বিভাগের সবচেয়ে বড় কেন্দ্রীয় কারাগারে নানা সমস্যা রয়েছে। এই কারাগারটিতেও রয়েছে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত বন্দি। সেখানে প্রতিটি কক্ষে অসংখ্য বন্দিকে গাদাগাদি করে রাখা হয়েছে। চট্টগ্রাম কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মঞ্জুর হোসেন মানবজমিনকে বলেন, আমাদের এখানে বন্দি ধারণ ক্ষমতা ২ হাজার ৪৯ জন। বন্দি রাখা হয়েছে ৫ হাজার ৩০০ জন। এরমধ্যে ২৪০ জনের মতো নারী রয়েছেন। বাকি সবাই পুরুষ বন্দি। অতিরিক্ত বন্দি নিয়ে তিনি বলেন, সমস্যা তো কিছু হচ্ছে। তবে মানিয়ে নিতে হচ্ছে। আগে এই সংখ্যা আরও বেশি ছিল। গত বছরের শেষের দিকে দৈনিক সাড়ে ৬ হাজার থেকে ৭ হাজার পর্যন্ত বন্দি থাকতো এখানে।
রাখিবো নিরাপদ, দেখাবো আলোর পথ এমন স্লোগানকে সামনে রেখে এগিয়ে যাচ্ছে কারা অধিদপ্তর। বন্দিদের বাসস্থান, খাদ্য, চিকিৎসা ও সুনাগরিক হিসেবে সমাজে পুনবার্সনের জন্য উৎসাহ ও প্রশিক্ষণ দেয়ার কথা থাকলেও সেটি সম্ভব হচ্ছে না বলে মনে করছেন মানবাধিকারকর্মীরা। তারা মনে করছেন, ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি বন্দি হলে নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়। অল্প জায়গায় অনেককে হিজিবিজিভাবে থাকতে হয়। গোসল করা থেকে শুরু করে টয়লেটে যেতেও লাইন দিতে হয়। সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয় চিকিৎসা নিতে। কারণ কারাগারে চিকিৎসকের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। অথচ বেশির ভাগ বন্দিরা চুলকানি, জ্বর, শ্বাসকষ্টসহ আরও নানা অসুখে ভুগছেন। দীর্ঘমেয়াদি অসুখে ভোগা বন্দির সংখ্যাও প্রতিটা কারাগারে শত শত। কিন্তু সাধারণ বন্দিদের চিকিৎসা নেয়া সম্ভব হয় না। তবে ভিআইপি বন্দিদের ক্ষেত্রে এরকম সমস্যা হয় না। তারা চাইলে কারাগারের ভেতরে চিকিৎসা নিতে পারেন। প্রয়োজন হলে বাইরের হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নেন।
যে কারণে বন্দি বেশি: রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঘোলাটে থাকলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ধরপাকড় শুরু করেন। আবার কোনো দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলন-সংগ্রামে হামলা সংঘর্ষ হলে নতুন মামলা হয়, এতে আসামি করা হয় অনেককে। এসব মামলা ধরে গ্রেপ্তার চলে। আবার অনেক সময় রাজনৈতিক পুরাতন মামলাও সচল করে গ্রেপ্তার অভিযান চালানো হয়। এসব আসামিদের ঠিকানা হয় কারাগারে। এর বাইরে কারাগারে হাজতি বন্দির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। যেসব বন্দিদের মামলার বিচার শেষ হয়নি তাদেরকে কারাগারে থাকতে হয়। এ ছাড়া থানা পুলিশের অভিযানে মাদক মামলার আসামিরা প্রতিদিনই গ্রেপ্তার হন। এসব আসামিরাও জামিনের আগ পর্যন্ত কারাগারে থাকেন। এর বাইরে প্রতারণা, ছিনতাই, ডাকাতি, খুনের মামলার আসামির সংখ্যা কম না।
ধারণক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ: গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে বলেছিলেন দেশের কারাগারগুলোতে বন্দির সংখ্যা বর্তমানে ধারণক্ষমতার প্রায় দ্বিগুণ। যশোর, সিলেট, দিনাজপুর, ফেনী, পিরোজপুর ও মাদারীপুর কারাগার ছাড়া বাকি সব কারাগারে ধারণক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত বন্দি আটক আছে। তিনি বলেন, কারাগারে ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি একটি চলমান প্রক্রিয়া। ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, খুলনা, নরসিংদী ও জামালপুরে কারাগার নির্মাণ বা সম্প্রসারণের কাজ চলছে। নির্মাণাধীন কারাগারগুলোর কাজ শেষ হলে ধারণক্ষমতা ৫ হাজার বৃদ্ধি পাবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল্লাহ আল মাসুদ চৌধুরী বলেন, আমরা প্রচুর প্রকল্প হাতে নিয়েছি। ৬টি প্রকল্প চলমান আছে। ২০২৪-২০২৫ সালের মধ্যে প্রকল্প শেষ হলে ধারণক্ষমতা ৫ হাজার ২৫৫ জন বৃদ্ধি পাবে। তারমধ্যে কেরানীগঞ্জে মহিলা কারাগারের কাজ শেষ হয়েছে। এখানে ৩০০ জন নারী বন্দি থাকতে পারবে। খুলনা, ময়মনসিংহ, নরসিংদী, কুমিল্লা, জামালপুরে কাজ চলছে। যেহেতু ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বন্দি বেশি তাই এসব উন্নয়ন প্রকল্প ছাড়াও প্রতি অর্থবছরে রাজস্ব খাতের আওতায় গুরুত্ব বিবেচনা করে বন্দি ব্যারাক নির্মাণ করে ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করি।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, ধারণক্ষমতার চেয়ে যখন বেশি বন্দি হয়ে যায় তখন সুযোগ-সুবিধা কমে নানান অসুবিধার সৃষ্টি হয়। আমি মনে করি কারাগারের স্পেস কিছুটা বাড়ানো উচিত। যখন কারাগারগুলো তৈরি করা হয়েছিল তখন এত লোক কারাগারে থাকতো না। এখন কারাগারও বেড়ে গেছে থাকার লোকও বেড়ে গেছে। তাই বিনা কারণে কাউকে কারাগারে যাওয়ার বিষয়টি অ্যাভয়েড করা উচিত। কারণ কারাগার ভালো জায়গা না। সেখানে ভালো মানুষ গেলেও খারাপ হয়ে যায়। অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ হয়ে যায়। সেজন্য কারাগারে যত সম্ভব কম লোক ঢোকানো দরকার। তিনি বলেন, একটা অপরাধ হলেই ধরে চালান দিয়ে দিলাম এটা ঠিক না। আবার কারাগারে না পাঠালেও উপায় নাই। কারণ কোনো অপরাধীকে ধরে থানায় ২৪ ঘণ্টার বেশি রাখতে পারে না। তাকে আদালতে হাজির করা আইনের বিধান। আদালতে হাজির করলে আদালত আসামিদের কোনো কোনো ক্ষেত্রে কারাগারে পাঠিয়ে দেন। তাই আটক-গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে থানা পুলিশকে ক সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। একটা নিরপরাধ মানুষকে যেন সন্দেহের বশীভূত হয়ে কারাগারে না পাঠানো হয়। তাহলে তার জীবনটা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তিনি বলেন, বড় ধরনের অপরাধ করতে পারছে বলে যতক্ষণ তার মনে না হবে ততক্ষণ তাকে কারাগারে না পাঠিয়ে জামিনে দেয়া উচিত। তাকে বলতে হবে সে যেন প্রতি সপ্তাহে থানায় দু’দিন রিপোর্ট করে। অনেক শর্ত দিয়েও মানুষকে কারাগারের বাইরে রাখা যায়। রাখিবো নিরাপদ, দেখাবো আলোর পথ কারাগারের এই স্লোগান নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, উদ্দেশ্য মহৎ কিন্তু সামর্থ্য আর কিছু মানুষের মিস হ্যান্ডলিংয়ের কারণে অনেক কিছু সম্ভব হয় না।
কারাগারেও মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে—
মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেছেন, একজন মানুষকে যখন অভিযুক্ত করা হয় বা তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয় তারপরেও ওই ব্যক্তিটির কিছু অধিকার থাকে। কারাগার মানেই রাষ্ট্রীয় হেফাজত। যেহেতু বন্দির স্বাধীনভাবে কিছু করার ক্ষমতা নেই- তাই তার স্বাস্থ্য, আবাস, খাবার ও অন্যান্য যেসব সুযোগ- সুবিধা পাওয়ার কথা সেগুলো নিশ্চিত এবং উপযুক্ত হওয়া দরকার।
কারাগার পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বলেন, গত কয়েক মাসে বিরোধী রাজনৈতিক দলের অসংখ্য নেতাকর্মীরা আটক হওয়ার কারণে বড় অঙ্কের বন্দি কারাগারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বন্দি বাড়ার কারণে সেই সুযোগ- সুবিধাগুলো কমে গেছে। আর একটা অমানবিক পরিবেশে বন্দিদের রাখা হচ্ছে। রাষ্ট্র তার নাগরিকদের নিপতিত করছে। যদি আমাদেরকে এই পরিমাণ সংখ্যায় আটক রাখতে হয় এবং সংখ্যা যদি এভাবে বাড়ানো হয় তবে আবাসস্থলসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হোক। রাষ্ট্রের অধীনে বা রাষ্ট্রীয় হেফাজতে যিনি থাকেন তার সুযোগ-সুবিধা দেখার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শুধু নির্বাচনের সময় বন্দি বাড়ে না। যখন সমাজের ভেতর থেকে আন্দোলন-সংগ্রামে কোনো বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় তখন হঠাৎ করে গ্রেপ্তার বৃদ্ধি পায়।
পুরনো মামলাগুলো সচল হয়। এসময় রাতারাতি অনেক মানুষকে আটক করে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করা হয়। মানবজমিন