ডেস্ক রির্পোট:-‘নূতন পথের যাত্রী দুটি, ছুটছে যাহার সন্ধানে, যোগ করে দাও, এক করে দাও, হলদে সুতার বন্ধনে’—বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই কবিতার মতো সবার জীবন নতুন সুতার বন্ধনে বাঁধা পড়ে না। নানা পারিপার্শ্বিক বাস্তবতায় পুরো একটা জীবন কাটিয়ে দেন একাকিত্বে। অদৃশ্য এক বাধায় অনেকের তৈরি হয় বিয়ের প্রতি অনীহা। কেউ কেউ আবার পারিবারিক দায়বদ্ধতা পূরণ এবং জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দৌড়ে থেকে বিয়ের উপযুক্ত সময় পার করে ফেলেন। এ সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। বর্তমানে দেশে ৫০ পেরোনো ৭ লাখের কিছু বেশি নারী-পুরুষ অবিবাহিত রয়েছেন। তাদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যাই বেশি। তবে তথ্য বলছে, গত কয়েক বছরে বিয়ের প্রবণতা বেড়েছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স (এসভিআরএস) প্রতিবেদন ২০২২’-এ এমন তথ্য উঠে এসেছে। জরিপের তথ্যে দেখা যায়, ২০২২ সালে দেশে বিবাহিত মানুষের হার বেড়েছে। ২০২২ সালে বৈবাহিক অবস্থার চিত্র
পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দেশের ৪৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ পুরুষ এবং ৫৩ দশমিক ২৯ শতাংশ নারী বর্তমানে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ আছেন। আর বিয়ের বাইরে রয়েছেন মোট জনসংখ্যার ৭ কোটি ২০ লাখের বেশি। তাদের মধ্যে পুরুষ ৪৮ দশমিক ৪৯ শতাংশ এবং নারী ৩৬ দশমিক ৪২ শতাংশ।
সর্বশেষ আদমশুমারি এবং এসভিআরএসের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দেশে মোট জনসংখ্যার ৮ কোটি ৪১ লাখ ৩৪ হাজার ৩ জন পুরুষ। এর মধ্যে ৪ কোটি ৭ লাখ ৯৬ হাজার ৫৭৮ জন বিয়ে করেনি। অর্থাৎ প্রায় অর্ধেক পুরুষ এখনো বিয়ে করেনি। বিপরীতে ৮ কোটি ৫৬ লাখ ৮৬ হাজার ৭৮৪ জন নারীর মধ্যে বিয়ে করেনি ৩ কোটি ১২ লাখ ৭ হাজার ১২৬ জন।
বয়সভিত্তিক অবিবাহিতদের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দেশে বর্তমানে পঞ্চাশোর্ধ্ব নারী-পুরুষ রয়েছেন ২ কোটি ৮৮ লাখ ২৫ হাজার ৬৭৬ জন। এর মধ্যে ১ কোটি ৫১ লাখ ৭৮ হাজার ৩১২ জন পুরুষের মধ্যে ৫ লাখ ২২ হাজার ১৩৩ জন অবিবাহিত রয়েছেন। বিপরীতে পঞ্চাশোর্ধ্ব ১ কোটি ৩৬ লাখ ৪৭ হাজার নারীর মধ্যে কখনো বিয়ে করেননি ১ লাখ ৮৯ হাজার ৬৯৮ জন। এই হার পঞ্চাশোর্ধ্ব নারীর প্রায় দেড় শতাংশ।
সাধারণত বাংলাদেশে ৫০ বছরের বেশি বয়সে বিয়ে করার হার খুবই কম। সেই হিসাবে ৫০ বছর বয়স পার হলেও যারা বিয়ে করেন না, কিছু ব্যতিক্রম বাদে তাদের বেশিরভাগই সারা জীবন অবিবাহিত থাকেন। তাদের চিরকুমার বা চিরকুমারী বলা হয়। এই হিসাবে দেশে বর্তমানে চিরকুমার ও চিরকুমারীর সংখ্যা ৭ লাখ ১১ হাজার ৮৩১ জন।
৫০ বছরেরও বেশি বয়স হলেও বিয়ে না করার কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে, অধিকাংশ অবিবাহিতের মতে, ভালো ক্যারিয়ার গড়তে বেশি সময় চলে যায়। এ ছাড়া পারিবারিক এবং সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেকের বয়স বেশি হয়ে যায়। অনেকে আবার পছন্দের মানুষকে সঙ্গী হিসেবে না পাওয়ায় বিয়ে করেন না।
পঞ্চাশোর্ধ্ব অবিবাহিত জসিম উদ্দিন বলেন, ‘বিয়ে না করার নির্দিষ্ট কোনো একটা কারণ নেই। কোনো রিলেশনে (সম্পর্ক) যাওয়া হয়নি। কোনো রিলেশনও ছিল না। সামাজিক এবং পারিবারিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আসলে সময়টা বেশি চলে গেছে। একটা পর্যায়ে গিয়ে মনে হয়েছে, এখন আর বিয়ে করার সময় নেই। এ ছাড়া লাইফে স্টাবলিসড হওয়ার আগে বিয়ে করব না—এমন একটা টার্গেট ছিল। কিন্তু সেই টার্গেট অর্জন করতে আসলে একটু বেশি সময় লেগে গেছে। তখন মনে হয়েছে আর দরাকর নেই।’
বিয়ে না করায় কোনো সমস্যা অনুভব করছেন কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তেমন কোনো সমস্যা ফেস করছি না। পড়াশোনা করি, কাজ করি, সিনেমা দেখা এবং বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে সময় কেটে যায়।’ পরিবার থেকে এক সময় বিয়ের চাপ ছিল, এখন নেই বলে জানান তিনি।
অন্যদিকে দেশে ৬৫ বছরের বেশি বয়সী নারী-পুরুষ রয়েছেন ৯৭ লাখ। তাদের মধ্যে ৪৩ হাজার জন কখনো বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হননি। এর মধ্যে ৩১ হাজার ২৪৬ জন পুরুষের বিপরীতে নারী রয়েছেন ১২ হাজার ১৪৮ জন। অর্থাৎ ৬৫ ঊর্ধ্ব বয়সী নারীর চেয়ে প্রায় ১৯ হাজার বেশি পুরুষ অবিবাহিত রয়েছেন।
বয়সভিত্তিক অবিবাহিতদের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ৬০ থেকে ৬৪ বছর বয়সী অবিবাহিত পুরুষ রয়েছেন ২৫ হাজার ১৩ জন। বিপরীতে নারী ৮ হাজার ৭৯৯ জন। ৫৫-৫৯ বছর বয়সী ২৬ হাজার ৮৯৩ জন পুরুষের বিপরীতে নারী ৮ হাজার ৮৮৩ জন। আর ৫০ থেকে ৫৪ বছর বয়সী ৪২ হাজার ৪১৬ পুরুষের বিপরীতে নারী ১৭ হাজার ৪০৫ জন।
৫০ বছরের নিচে অবিবাহিতদের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ৪৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী ৪৭ হাজার ৪৯১ জন পুরুষের বিপরীতে অবিবাহিত নারী ২৫ হাজার ২২৪ জন। ৪০ থেকে ৪৪ বছর বয়সী ৭৯ হাজার ৩৭৫ জন পুরুষের বিপরীতে নারী ৩৪ হাজার ৪৩৫ জন। ৩৫ থেকে ৩৯ বছর বয়সী ১ লাখ ৮৬ হাজার ৫১ জন পুরুষের বিপরীতে নারী ৬৬ হাজার ১১৩ জন।
বিয়ের উপযুক্ত পুরুষের তুলনায় অবিবাহিত নারীর সংখ্যা অনেক কম। সাধরাণত বিয়ের উত্তম সময় ধরা হয় ২৫ থেকে ৩৪ বছরের মধ্যে। দেশে এই বয়সী অবিবাহিত পুরুষ রয়েছেন ২৫ লাখ ১ হাজার ৬৬২ জন। বিপরীতে অবিবাহিত নারী রয়েছেন মাত্র ৬ লাখ ৩৫ হাজার ৫৫৫ জন। অর্থাৎ এই বয়সে বিয়ের উত্তম সময় ধরা হলেও নারীর তুলনায় ১৮ লাখের বেশি রয়েছেন অবিবাহিত পুরুষ।
অবিবাহিত নারীর তুলনায় পুরুষ প্রায় চারগুণ: দেশে পুরুষের বিয়ের বয়স ২১ বছর এবং নারীদের ক্ষেত্রে ১৮ বছর নির্ধারণ করা আছে। তবে বিবিএসের জরিপ প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বাংলাদেশে বিয়ের গড় বয়স ২৫ বছর। সেই হিসাবে দেশে বর্তমানে বিবাহযোগ্য প্রাপ্তবয়স্ক অবিবাহিত নারী-পুরুষ রয়েছেন প্রায় ২ কোটি ৬২ লাখ ৪১ হাজার জন। এর মধ্যে বিবাহযোগ্য পুরুষ ২ কোটি ৯ লাখ ৩৮ হাজার, যার বিপরীতে নারী মাত্র ৫৩ লাখ ৩ হাজার। অর্থাৎ বিবাহযোগ্য পাত্রীর তুলনায় ১ কোটি ৫৬ লাখে বেশি পুরুষ অবিবাহিত।
অবিবাহিত বেশি সিলেটে, কম রাজশাহী: বিভাগের হিসাবে অবিবাহিত মানুষের হার সবচেয়ে বেশি সিলেট বিভাগে। এ বিভাগের প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ৫৭ দশমিক ৮৩ শতাংশ পুরুষ ও ৪৪ দশমিক ৯১ শতাংশ নারী এখনো বিয়ে করেননি। বয়স হওয়ার পরও বিয়ে না করার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় অবস্থানে চট্টগ্রাম বিভাগ। এ বিভাগের ৫৫ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক এখনো বিয়ে করেননি। রাজশাহী বিভাগে অবিবাহিত সবচেয়ে কম। এ বিভাগের ৪৩ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ পুরুষ এখনো অবিবাহিত রয়েছেন। রাজশাহীর পর অবিবাহিত পুরুষের হার সবচেয়ে কম খুলনা ও রংপুরে। তবে অবিবাহিত নারীর হার সবচেয়ে কম খুলনা বিভাগে।
সরকারিভাবে বাংলাদেশে বিয়ের বয়স নির্ধারণ করা থাকলেও কেউ কেউ বিয়ে করেন ২৫ বছর বয়সে। কেউ আবার বয়স ৩০ পেরিয়ে গেলেও অপেক্ষা করেন মনের মতো সঙ্গীর জন্য। বিয়ের আদর্শ সময় নিয়ে ২০১৫ সালে একটি গবেষণা করে যুক্তরাষ্ট্রের ইউটাহ বিশ্ববিদ্যালয়। সেই গবেষণায় বিবাহিত জীবন দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য ২৮ থেকে ৩২ বছরের মধ্যে বিয়ে করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
গবেষণায় যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছে, ২৮ থেকে ৩২ বছর বয়সেই মানুষের পরিণতবোধ আসে। তারুণ্যের অস্থিরতা কাটতে থাকে। সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। কর্মজীবনেও এই বয়সে এসে স্থিতি আসে মানুষের জীবনে। তাই ২৮ থেকে ৩২ বছর বয়সের মধ্যেই বিয়েটা সেরে ফেলা ভালো। সন্তান নেওয়া ও তাকে একটা পর্যায় পর্যন্ত অভিভাবকের ছায়া দেওয়ার জন্যও ভালো সময় পাওয়া যায়।
বাংলাদেশেও এখন বড়সংখ্যক মানুষ ২৫ থেকে ৩৪ বছর বয়সের মধ্যে বিয়ে করছেন। পড়াশোনা শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে তার পরেই বিয়ের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তারা। মেয়েদের ক্ষেত্রেও একই চিত্র। এসভিআরএসের জরিপ প্রতিবেদনেও তেমন চিত্র উঠে এসেছে।কালবেলা