ডা. সাবরিনা এবং ডিবিপ্রধান

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় রবিবার, ১১ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪
  • ২০৭ দেখা হয়েছে

আলম রায়হান:- করোনার নমুনা সংগ্রহ ও ভুয়া প্রতিবেদন দেওয়ার অভিযোগে ২০২০ সালের ১২ জুলাই ডা. সাবরিনাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এর আগে তার স্বামীসহ আরও কয়েকজন গ্রেপ্তার হন। আদালতের রায়ে সাজা হয় তাদের। জেল থেকে বের হওয়ার পর ৫ ফেব্রুয়ারি একটি সংবাদমাধ্যমের সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের কারাগারগুলোতে সমকামিতার বিষয়ে মন্তব্য করেছেন ডা. সাবরিনা। বলেছেন পরকীয়া নিয়েও। বইমেলায় এ নিয়ে তিনি খোলামেলা কথা বলেছেন। একই সময় তার নিজ অনুভূতি এবং কারাগার প্রসঙ্গে আরও অনেক কথা বলেছেন। তার বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে পরদিন ৬ ফেব্রুয়ারি কথা বললেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশপ্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুসারে তিনি বলেছেন, ‘ডা. সাবরিনা যদি কারা কর্তৃপক্ষকে অভিযোগ করেন, তবে এ বিষয়ে তদন্ত হওয়া উচিত।’ হয়তো ভাবখানা যেন এই—ডা. সাবরিনা মনগড়া কথা বলেছেন।

কারাগারে আসলে কী হয়, কী চলে তা নিয়ে অনেক রটনা আছে। এর অনেক নিশ্চয়ই ঘটনাও। এসব বিষয় উঠে এসেছে অনেক গল্প-উপন্যাস-নিবন্ধে। কিঞ্চিৎ আমি নিজেও দেখে এবং অনুমান করার সুযোগ পেয়েছি ১৯৯৬ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ১৮ দিন থাকাকালে। সেই কথা বললে হয়তো ডিবিপ্রধান আমাকেই ধরে নিয়ে যেতে পারেন। প্রসঙ্গত, পত্রিকা অফিসে বসে ‘সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত’ করার অভিযোগ সাজিয়ে ৫৪ ধারা বলে আমাকে যিনি নয়াপল্টনের অফিস থেকে এক বিকেলে ধরে নিয়েছিলেন, তিনি ছিলেন সেই সময় ঢাকার ডিবিপ্রধান, সৈদয় বজলুল করিম। তিনি তখন খুবই ক্ষমতাবান এবং বেপরোয়া পুলিশ। অনেক কাণ্ডের সঙ্গে তিনি ডিএমপি কমিশনারকে চ্যালেঞ্জ করার কাণ্ডও করেছেন সেসময়। যাক সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ।

কারাগারের অভ্যন্তরে চলমান ঘটনা নিয়ে, গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ অথবা ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ থেকে না গিয়ে আদালতের পর্যবেক্ষণ উল্লেখ করাই বেহেতের। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, ‘দেশের একাধিক জেলে কার্যত ঠাঁই নেই অবস্থা। সমকামিতা ও পায়ুকামও বন্দিদের মধ্যে চলে জেলের অন্দরে। আর সেখানকার আবাসিকরা যখন বেরিয়ে আসেন জেল থেকে, তখন তারা কার্যত পশুর মতো হয়ে যান।’ বিচারপতি কেএম যোশেফ ও ঋষিকেশ রায়ের বেঞ্চ জানিয়েছেন, ‘জেলে কী হয়—সেটা খুব ভয়ংকর। আমাদের জেল পরিদর্শনের সুযোগ হয়েছে। সেখানে এতটাই ভিড় যে, সমকামিতা থেকে পায়ুকাম সবই হয়। যখন বেরিয়ে আসেন তখন পশু ছাড়া আর কিছু নয়। এটা থেকে একটি প্রতিহিংসার মনোভাব তৈরি হয়।’ আমাদের দেশের কারাগারে সমকামিতা হয় কি হয় না, সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। আর কোন কারণে অথবা কোন মতলবে ডা. সাবরিনা কারাগারে সমকামিতার প্রসঙ্গ তুলেছেন, সেটিও বিবেচ্য বিষয় হতে পারে। কিন্তু চট করে এ বিষয়ে ডিবিপ্রধানকে কথা বলতে হবে কেন? আর শুধু কথা বলাই নয়, কী কারণে এবং কখন ডা. সাবরিনা গ্রেপ্তার হয়েছেন, কীভাবে সাজা হয়েছে—এন্তার বয়ান দিয়েছেন ডিবিপ্রধান। এত সময় তিনি কোথায় পান! আসলে অতিকথন প্রবণতায় আক্রান্ত হয়ে অপ্রয়োজনীয় কথা বলার জন্য সময়ের অভাব হয় না। এ হচ্ছে অতিকথন প্রবণতায় আক্রান্ত হওয়ার আলামত। আর অতিকথনের প্রবণতায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশপ্রধান শুধু নন, আমাদের দেশের সবাই যেন আক্রান্ত। তবে ক্ষমতাসীনরা বেশ বেশিই আগানো বলে মনে হচ্ছে। আর পিছিয়ে নেই ক্ষমতাহীনরাও। সবমিলিয়ে চারদিকে যেন কথার বৃষ্টি বর্ষিত হচ্ছে! হয়তো এ ধারা থেকে পিছিয়ে থাকতে চাননি ডিবিপ্রধান। অথবা তিনি আলোচনায় থাকার ক্ষেত্রে ডা. সাবরিনাকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করেছেন। এ ব্যাপারে প্রচলিত একটি গল্প প্রাসঙ্গিক হতে পারে। গল্পটি এ রকম, চোর মালপত্র নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি টের পেয়ে গৃহকর্তা চোরের পিছু নিলেন। টের পেয়ে মালপত্র ফেলে ভোঁ-দৌড় দিল চোর। কিন্তু মালপত্রের দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে চোরের পেছনে ছুটতে থাকলেন গৃহকর্তা। কারণ, তাকে চোর ধরতেই হবে। চোর দৌড়ায়, দৌড়ান গৃহকর্তা। কিছুক্ষণের মধ্যে তার মনে হলো, আরে আমি তো দৌড়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়া লোক। চোরের পেছনে দৌড়ানো কি আমার সাজে! যেই চিন্তা সেই কাজ! তিনি চোরকে ছাড়িয়ে সামনে ছুটলেন। এই সুযোগে উল্টো দিকে ফিরে দৌড়াতে থাকল চোর রত্নটি। কিছুক্ষণ পর দৌড়ে ক্লান্ত মালিক বাড়ি ফেরার সময় দেখলেন, ফেলে দেওয়া মালপত্র চোর নিয়ে গেছে। তখন তিনি অনুধাবন করেন, প্রতিটি ঘটনায় প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হওয়া কোনো কাজের কাজ নয়। গল্পের সেই গৃহকর্তার মতো আমাদের ডিবিপ্রধানের কবে বোধোদয় হবে, তা বলা মুশকিল। হয়তো একদিন হবে, অথবা কোনোদিনই হবে না। এ বিষয়টি পরিষ্কার নয়। কিন্তু এটি খুবই পরিষ্কার, সব বিষয়ে তার কথা বলতেই হবে এবং তিনি আলোচনায় থাকবেনই। যেমনটাই ঘটে আসছে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের আজকের প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ প্রথম আলোচনায় আসেন জাতীয় সংসদ চত্বরে তৎকালীন বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নাল আবদিন ফারুককেন্দ্রিক ঘটনায়। বলা হয়, সে ঘটনাই তাকে উত্থানের শক্ত সিঁড়িতে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এরপর তিনি পেশাগত অনেক সাফল্য দেখিয়েছেন। কিন্তু এই সাফল্য অনেকটা ছাপিয়ে তিনি বারবার আলোচনায় আসছেন। এ ক্ষেত্রে সহায়ক বিষয় হচ্ছে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষকে আহার করানো, যা পাবলিসিটি হয়েছে, জেনেছে সবাই। নেতা থেকে নায়িকা—সব শ্রেণির মানুষ রয়েছেন প্রকাশিত তার আপ্যায়নের তালিকায়। এ নিয়ে নানা কথা বলা হচ্ছে। সবচেয়ে মজার কথা বলেছেন হিরো আলম। সহযোগীসহ রাজধানীর মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে ধারণ করা একটি ভিডিও ক্লিপে মধ্যাহ্নভোজের সময় ইউটিউবার আশরাফুল ইসলাম ওরফে হিরো আলমকে বলতে দেখা গেছে, ‘এটা ঠিক না। দুরকম খাবার দিচ্ছেন, ঠিক নাকি? অপু আসলে অনেক খাবার দিছেন, নেতা আসলে অনেক কিছু খেতে দিছেন। আমাদের খালি আলু ভর্তা, ডাল, ভাজি দিছেন, মাছ দিছেন।’

আপ্যায়নে মানের ভিন্নতায় হিরো আলমের উচ্চারণ ‘এটা ঠিক না।’ এরই প্রতিধ্বনি করে অনেকেই বলছেন, প্রতিটি ইস্যুতে ডিবিপ্রধানের কথা বলাটা ঠিক নয়। আবার ‘এটা ঠিক না’—এ কথা নানা ক্ষেত্রেই বলা চলে। কেউ বলেন। কেউ আবার বলেন না। কিন্তু সবারই বলা উচিত, বৈদেশিক কোনো ঘটনায় দেশ যখন সংকটের মুখোমুখি হয়, তখন মনগড়া কথা বলা একেবারেই ঠিক নয়। যেটি সমানে বলে চলেছে সাবেক শাসক দল বিএনপি। যেমন বিএনপি বলছে, সীমান্তে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ও সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সংঘর্ষে বাংলাদেশিদের হতাহতের ঘটনা প্রসঙ্গে। এ বিষয়ে সরকারের ‘নিষ্ক্রিয়তার’ সমালোচনা করে নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে বিএনপি। দলটির স্থায়ী কমিটি বলেছে, ‘সরকার সীমান্ত নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। ধৈর্য ও সংযম দেখানোর কৌশল সরকারের নতজানু পররাষ্ট্রনীতির বহিঃপ্রকাশ।’ ৬ ফেব্রুয়ারি বিএনপির স্থায়ী কমিটির পাঠানো বিবৃতিতে এ কথা বলা হয়েছে। এটি ‘নতজানু পররাষ্ট্রনীতির’ বহিঃপ্রকাশ বলে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিএনপির স্থায়ী কমিটি। সরকার জাতীয় সার্বভৌমত্বকে অবজ্ঞা করছে অভিযোগ করে বিবৃতিতে বলা হয়, আওয়ামী লীগ সরকার অনির্বাচিত বলেই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সাহস পাচ্ছে না। বরং তাদের অপরিণাম দর্শিতার কারণেই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী দীর্ঘকাল দেশে অবস্থান করে মানবিক সংকট তৈরি করেছে।

সাবেক শাসক দল বিএনপিকে কে প্রশ্ন করবে, একটি দেশের অভ্যন্তরীণ সহিংস বিরোধের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশকে কি সেই সংঘাতে জড়িত করতে হবে? আর সেটা না করলেই তা হবে নতজানু পররাষ্ট্রনীতি? বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন, মিয়ানমারে যা চলছে, তা শুধু দেশটির অভ্যন্তরীণ বিরোধ বা বিষয় নয়। এর নেপথ্যে পরাশক্তির স্বার্থের খেলা চলমান, যা চলছে উইক্রেন ও গাজায়। চলছে ইরাক, লিবিয়ায়। এসব বাস্তবতা বিবেচনায় না নিয়ে মিয়ানমারের খেলার মাঝে ‘ইয়া আলী’ বলে বাংলাদেশের ঝাঁপ দেওয়া কি সাহসিকতা? নাকি আগুনে পতঙ্গের ঝাঁপ দেওয়ার মতো কর্ম—সেটি কিন্তু বিএনপির বিবেচনায় নেওয়া উচিত। আর শুধু এই ইস্যুতে নয়, সব বিষয়ই কথা বলছে বিএনপি। তা ‘আব্বাসের সঙ্গে গাবগাছ’ ছন্দ মিলানোর মতো হলেও! এ নিয়ে আমজনতার মধ্যে বিরক্তির নানা প্রশ্ন ওঠে। যেমন প্রশ্ন উঠেছে, ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দাপ্রধান কীসের ভিত্তিতে কারাগারে সমকামিতা নিয়ে ডা. সাবরিনার বক্তব্য প্রসঙ্গে কথা বলছেন। এ বিষয়ে বক্তব্য দেওয়ার ব্যাপারে কি তার কোনো বাধ্যবাধকতা আছে? আরও প্রশ্ন আছে, কোনো বিতর্কিত আলোচনার মাঝখানে কেনই বা বারবার প্রবেশ করতে হবে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দাপ্রধানকে! অনেক হয়েছে, তিনি থামলে ভালো লাগে। যেমন ভালো লাগে, ‘হেন করেঙ্গা তেন করেঙ্গা’—গোছের কথা বলা থেকে মন্ত্রীরা বিরত থাকলে। জনতা চায়, আগে করেন! বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন, বিদেশি ঘোরে থাকা বিএনপিকে বোকা বানিয়ে ৭ জানুয়ারি পুলসিরাত পার হওয়াই কিন্তু শেষ কথা নয়! অনেক কিছু আছে সামনে। তা হতে পারে নিকটেও, বিশেষ করে ডলার সংকট!

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com
Website Design By Kidarkar It solutions