ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু :- শিক্ষার্থীসহ সবাইকেই জীবনের গুরুত্ব ও মূল্য সম্পর্কে বুঝতে হবে। তাদের বুঝতে হবে, জীবন একটিই এবং তা মহামূল্যবান। জীবন একবার হারালে আর কোনো কিছুর বিনিময়েই ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। শিক্ষার্থীসহ সবারই স্মরণে রাখা প্রয়োজন, জীবনকে যদি সুন্দরভাবে সাজানো যায়, তা হলে জীবনকে সুন্দরভাবে উপভোগও করা যায়। তাই সবার উচিত, আত্মহত্যার পথ পরিহার করে জীবনকে ভালোবাসতে শেখা; জীবনকে সুন্দরভাবে সাজাতে শেখা এবং জীবনকে সুন্দরভাবে উপভোগ করা।
গত বছর (২০২৩) দেশে মোট ৫১৩ জন শিক্ষার্থী আত্মহনন করেছেন। এর মধ্যে স্কুলশিক্ষার্থী ২২৭ জন, কলেজশিক্ষার্থী ১৪০, বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষার্থী ৯৮ ও মাদ্রাসাশিক্ষার্থী রয়েছেন ৪৮ জন। এর মধ্যে স্কুলশিক্ষার্থী ২২৭ জন, যা ৪৪.২ শতাংশ; কলেজশিক্ষার্থী ১৪০ জন, যা ২৭.২ শতাংশ; বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষার্থী ৯৮ জন, যা ১৯.১ শতাংশ এবং মাদ্রাসাশিক্ষার্থী রয়েছেন ৪৮ জন, যা মোট শিক্ষার্থীর ৯.৪ শতাংশ। ৫১৩ জন শিক্ষার্থীর মাঝে পুরুষ শিক্ষার্থী ছিলেন ২০৪ জন, যা ৩৯.৮ শতাংশ। অন্যদিকে নারী শিক্ষার্থী ছিলেন ৩০৯ জন, যা ৬০.২ শতাংশ।
এই আত্মহননের পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ ছিল অভিমান এবং প্রেমঘটিত সমস্যা। বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশন আয়োজিত এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে গত ২৭ জানুয়ারি এ তথ্য প্রকাশ করা হয়। এক বছরে দেশে ৫১৩ জন শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার ফলে স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কেন আত্মহত্যা করছেন? গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২২ সালে আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থী ছিলেন ৫৩২ জন। করোনা মহামারিকালে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মহত্যার ঘটনা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়েছিল।
ওই গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মহত্যার ১০১টি ঘটনা ঘটে। আর সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে, যা ৬১.৩৯%। অপরদিকে মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে আত্মহত্যার হার ১১.৮৮% এবং প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে এই হার ৩.৯৬%। আর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার ছিল ২২.৭৭%। উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা করার ব্যাপারে খোঁজ নিলে দেখা যাবে, অনেক শিক্ষার্থীই হতাশা, মানসিক অশান্তি ও মানসিক অস্থিরতায় ভুগছিলেন। সংগত বিভিন্ন কারণে আগের তুলনায় সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে এ অবস্থা বৃদ্ধি পেয়েছে।
এ কথা ধ্রুব সত্য যে, একজন শিক্ষার্থীকে স্কুল-কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নিয়ে আসতে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সংগ্রাম করতে হয়। প্রত্যেক শিক্ষার্থীরই স্মরণে রাখা উচিত, অনেক আশা-ভরসা নিয়ে তাদের মা-বাবা তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়তে পাঠান। পাশাপাশি দেশ-জাতিও তাদের কাছ থেকে ভালো অনেক কিছু প্রত্যাশা করে। সবাইকে স্মরণে রাখতে হবে, মানুষের জীবনেই সমস্যা আসে এবং সমস্যা আসবেই। আর এটিই স্বাভাবিক। তার মানে এই নয় যে, জীবনে সমস্যা এলে আত্মহত্যা করে জীবনকে শেষ করে দিতে হবে। বরং জীবনে কোনো ধরনের সমস্যা এলে শিক্ষার্থীসহ সবাইকে আবেগনির্ভর না হয়ে সুস্থ মস্তিষ্কে বাস্তবতার আলোকে সেই সমস্যার সমাধান করা উচিত। প্রয়োজনে কোনো মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বা পেশাদার কোনো কাউন্সেলরের শরণাপন্ন হওয়া যেতে পারে। বলা বাহুল্য, আত্মহত্যা হচ্ছে মানবজীবনের এক চরম অসহায়ত্ব। ক্ষণিক আবেগে একটি মহামূল্যবান জীবনের চির অবসান ঘটানো, যা কোনো কিছুর বিনিময়েই ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। আর আত্মহত্যার মাধ্যমে নিজের মূল্যবান জীবনকে যেমন একদিকে শেষ করে দেওয়া হয়, তেমনি অন্যদিকে একটি সম্ভাবনারও চির অবসান ঘটে।
কোনো ব্যক্তির আত্মহত্যা করার পেছনে যেসব কারণ নিহিত থাকে, তার মধ্যে রয়েছে বিষণ্নতা, আর্থিক, সামাজিক, পারিবারিক সমস্যা কিংবা নিতান্ত ব্যক্তিগত মনঃকষ্ট, বাইপোলার ডিস-অর্ডার, সিজোফ্রেনিয়া, পার্সোনালিটি ডিস-অর্ডার, অ্যাংজাইটি ডিস-অর্ডার, অ্যালকোহল ব্যবহারজনিত ডিস-অর্ডার ইত্যাদি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যানমতে, বর্তমান বিশ্বে প্রায় ১২১ মিলিয়ন মানুষ মাত্রাতিরিক্ত বিষণ্নতার শিকার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপ অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বে প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে বার্ষিক আত্মহত্যার হার ১১.৪%। এক জরিপে দেখা যায়, শুধু ২০১২ সালে সারা বিশ্বে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে আট লাখ চার হাজারটি। হিসাবমতে, প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একটি করে আত্মহত্যা সংঘটিত হচ্ছে। তবে এর মধ্যে ১৫-২৯ বছর বয়সীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। আর বাংলাদেশে বার্ষিক আত্মহত্যার সংখ্যা গড়ে ১০ হাজার ২২০টি, যার মধ্যে ৫৮ থেকে ৭৩% আত্মহত্যাকারীই নারী।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আত্মহত্যার পেছনে কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে: পারিবারিক বা ব্যক্তিগত সম্পর্কের মধ্যে ভুল-বোঝাবুঝির সৃষ্টি হওয়া, সম্পর্কের ঘাটতি বা বিচ্ছেদ ঘটা, অপরিসীম অর্থকষ্ট, যৌন, শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন-নিপীড়ন, মাদকাসক্তিসংক্রান্ত সমস্যা, নানা ধরনের মানসিক অসুস্থতা ইত্যাদি। পাশাপাশি রয়েছে পরিবারের সদস্য বা নিকটাত্মীয়, প্রিয় বন্ধুবান্ধবী কিংবা প্রিয় কোনো নেতা, অভিনেতা, শিল্পী, খেলোয়াড়ের আকস্মিক মৃত্যু বা আত্মহত্যার সংবাদ, কর্মস্থল বা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে সহকর্মী বা সহপাঠীদের সঙ্গে ভুল-বোঝাবুঝি সৃষ্টি হওয়া, দীর্ঘদিনের বেকারত্ব বা হঠাৎ চাকরিচ্যুতি বা চাকরিতে পদাবনতি ঘটা ইত্যাদি। এসব চিন্তাভাবনার ফলে মনের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া প্রচণ্ড রকমের হতাশা ও ক্ষোভের কারণে মানুষ তার নিজের প্রতি আস্থা ও সম্মানবোধ হারিয়ে ফেলে। তখন থেকেই সে সবার কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করে এবং একসময় আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। আবার কিছু ব্যর্থতা কিংবা কোনো কিছু কারও কাছ থেকে চেয়ে না পাওয়ার বিষয়টিও মানুষকে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দেয়।
পরিসংখ্যানমতে, আত্মহত্যার ক্ষেত্রে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা অনেকাংশে এগিয়ে রয়েছে। তবে আশ্চর্যের বিষয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা ও আত্মহত্যা চেষ্টার প্রবণতা বেড়ে চললেও এখন পর্যন্ত দেশের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই নেই কোনো পেশাদার পরামর্শক বা কাউন্সেলর। অথচ আত্মহত্যাজনিত মৃত্যুর বেশির ভাগই প্রতিরোধযোগ্য। বেশির ভাগ ব্যক্তিই আত্মহত্যার সময় কোনো না কোনো গুরুতর মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, শারীরিক ও মানসিক যেকোনো অসুস্থতায় যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা লাভের সুযোগ আত্মহত্যার প্রবণতা কমায়। পাশাপাশি আত্মহত্যা প্রতিরোধে কিছু বিষয় রয়েছে, যেগুলোকে প্রটেকটিভ ফ্যাক্টর বলা হয়। যেমন- জীবনের খারাপ সময়গুলোতে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতা জন্মানো, নিজের প্রতি শ্রদ্ধা ও আত্মবিশ্বাস জন্মানো, সমস্যা সমাধানের কার্যকর দক্ষতা বাড়ানো এবং প্রয়োজনে অন্যের কাছ থেকে ইতিবাচক সহায়তা লাভের চেষ্টা করা ইত্যাদি। এসব ফ্যাক্টরকে আত্মহত্যার ক্ষেত্রে রক্ষাকারী বা প্রতিরোধী বিষয় হিসেবে গণ্য করা হয়। তা ছাড়া সামাজিক ও ধর্মীয় রীতিনীতি, অনুশাসন, ভালো বন্ধু, প্রতিবেশী ও সহকর্মীর সঙ্গে সামাজিক সুসম্পর্ক প্রভৃতি আত্মহত্যার প্রবণতা হ্রাসে সহায়তা করে। পাশাপাশি সুষম খাদ্য গ্রহণ, পর্যাপ্ত নিদ্রা, নিয়মিত শরীরচর্চা, ধূমপান ও মাদকাসক্তি থেকে দূরে থাকা তথা স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এবং শারীরিক ও মানসিক যেকোনো অসুস্থতায় যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা লাভের সুযোগ আত্মহত্যার প্রবণতা কমায়। সুতরাং শিক্ষার্থীদের হতাশা ও মানসিক অশান্তি থেকে উত্তরণের জন্য এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দ্রুত পেশাদার কাউন্সেলর নিয়োগ করা প্রয়োজন। আর তা সম্ভব হলেই শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার চেষ্টা চালানো কিংবা আত্মহত্যা করার প্রবণতা অনেকটাই কমে আসবে বলে আশা করা যায়।
সর্বোপরি শিক্ষার্থীসহ সবাইকেই জীবনের গুরুত্ব ও মূল্য সম্পর্কে বুঝতে হবে। তাদের বুঝতে হবে, জীবন একটিই এবং তা মহামূল্যবান। জীবন একবার হারালে আর কোনো কিছুর বিনিময়েই ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। শিক্ষার্থীসহ সবারই স্মরণে রাখা প্রয়োজন, জীবনকে যদি সুন্দরভাবে সাজানো যায়, তা হলে জীবনকে সুন্দরভাবে উপভোগও করা যায়। তাই সবার উচিত, আত্মহত্যার পথ পরিহার করে জীবনকে ভালোবাসতে শেখা; জীবনকে সুন্দরভাবে সাজাতে শেখা এবং জীবনকে সুন্দরভাবে উপভোগ করা।
লেখক: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, আইন বিভাগ
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি