
রাঙ্গামাটি:- বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের সহযোগিতায় প্রোগ্রেসিভ’র আয়োজনে চাকমা সার্কেল চীফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়’র সভাপতিত্বে রাঙ্গামাটি শহরের আশিকা কনভেনশন হলরুমে পার্বত্য চট্রগ্রামের প্রথাগত আইনসমূহকে জেন্ডার সংবেদনশীল করার জন্যে পার্বত্য চট্রগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ এবং সার্কেল চীফের সাথে জাতীয় পর্যায়ের সংলাপ অনু্ষ্ঠিত হয়।
সংলাপে উপস্থিত ছিলেন- নিরূপা দেওয়ান, এ্যাডভোকেট চঞ্চু চাকমা, এ্যাডভোকেট ভবতোষ দেওয়ান, ইখিন চৌধুরী, শান্তি বিজয় চাকমা, এ্যাডভোকেট সুষ্মিতা চাকমা, সুচরিতা চাকমা, টুকু তালুকদার, থোয়াই মং মারর্মা এবং রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলার হেডম্যান, কার্বারি, উকিল, সাংবাদিক, এনজিও কর্মী, স্থানীয় বিভিন্ন কর্ম এলাকার ইয়থ গ্রুুপ সদস্যসহ আরো অনেকে।
সংলাপে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার সিএইচটি নারী হেডম্যান নেটওয়ার্কের সাধারণ সম্পাদক ইখিন চৌধুরী বলেন, পার্বত্য অঞ্চলে প্রথাগত আইনের কারণে নারীদের অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। কোনো হেডম্যান মারা গেলে প্রথাগত আইনে তার ছেলে হেডম্যান হওয়ার ক্ষেত্রে ছেলেরা অগ্রাধিকার পান। তিন পার্বত্য জেলায় নারীরা ভীষণভাবে উপেক্ষিত। উত্তরাধিকার সূত্রে তারা সম্পত্তির মালিক হতে পারেন না। বাবা মারা গেলে ওই সম্পত্তির মালিক হচ্ছেন ছেলেরা। আবার কারও ছেলে সন্তান না থাকলে সম্পত্তি পাচ্ছেন ভাইয়ের ছেলেরা।এক্ষেত্রে আমরা মেয়েরা পিছিয়ে আছি। আমাদের সব যোগ্যতা থাকার পরেও আমাদের সমাজের কাছে বারবার পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এটা আমাদের ভেবে দেখার দরকার আছে। এছাড়াও দেশের আইনের সাথে আমাদের প্রথাগত আইনের অনেক পার্থক্য দেখা যায়। এসব নিয়ে কাজ করলে আমাদের পার্বত্য অঞ্চলের নারীরা বৈষম্য থেকে মুক্তি পাবে।
এ্যাডভোকেট সুষ্মিতা চাকমা বলেন, আমাদের পার্বত্য অঞ্চলের প্রথাগত আইনের সাথে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অনেক আইনের গরমিল রয়েছে। আমাদের আইনগুলো অনেক পুরাতন হলেও যুগের সাথে তালমিলিয়ে এসব আইনের কোনো ধরনের পরিবর্তন করা হয়নি। এখানে নারীরা অনেক বেশি পিছিয়ে রয়েছে। অনেক বৈষম্য আমরা এখানে দেখতে পাই। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নারী কমিশন করলেও সেখানে উল্লেখযোগ্য কোন নারী অধিকারের কথা বলা হয়নি বা বলার সুযোগ পাওয়া যায়নি। তাই এসব বিষয়ে অগ্রগতি আনতে হলে আমাদের সচেতনতার সাথে কাজ করা লাগবে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরুপা দেওয়ান বলেন, সার্বজনীনভাবে যেখানে নারীদেরকে সমঅধিকার দেয়ার পাশাপাশি তাদেরকে বৈষম্যমূলক পরিস্থিতি থেকে মুক্তি দিতে কাজ করছে সবাই, ঠিক সেখানেই পাহাড়ি পুরুষরা তাদের নারীদেরকে প্রচলিত আইন আর প্রথাগত নিয়ম এই দুই দ্বন্দ্বের মাঝে পিষ্ট করছেন। কিন্তু পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সমাজ ব্যবস্থা এবং তাদের রীতিনীতি অনুযায়ী পুরুষতান্ত্রিকতার বেড়াজাল ডিঙ্গিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নারীরা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। পাহাড়িদের প্রথাগত রীতিনীতি এবং পদ্ধতিগত ঐতিহ্য নারীদের আরো পিছিয়ে দিচ্ছে।
প্রোগ্রেসিভ’র নির্বাহী পরিচালক সুচরিতা চাকমা বলেন, সব ক্ষেত্রে নারীদের বঞ্চিত করা হয়েছে। নারীদের ব্যক্তিগত জীবন, বৈবাহিক জীবন, সম্পত্তির উত্তরাধিকার কোনো ক্ষেত্রেই সার্বিকভাবে তাদের মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। কারণ পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান সার্কেল চীফ, হেডম্যান, কার্বারি যাদের ওপর পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত পাহাড়িদের সামাজিক বিচার, মৌজা সার্কেলের ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনাসহ খাজনা আদায়ের দায়িত্ব অর্পিত। এ প্রতিষ্ঠানগুলো পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত। তারা কি নিজেদের স্বার্থেই তাদের নারী সমাজকে বন্দী করে রাখছে? তিনি সবার কাছে এই প্রশ্ন রেখে বক্তব্য শেষ করেন।
চাকমা সার্কেল চীফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় বলেন, প্রচলিত আইন আর প্রথাগত নিয়মের বেড়াজালে আটকা পড়ে প্রধান ৬টি চ্যালেঞ্জ নিয়ে তিন পার্বত্য জেলায় বসবাস করছেন পাহাড়ি নারীরা। এগুলো হচ্ছে বৈষম্যমূলক আচরণ, সম্পত্তির উত্তরাধিকার, বিবাহ বিচ্ছেদ, সন্তানের অভিভাবকত্ব, ভরণপোষণ ও নির্যাতন। সমতলের অন্যান্য সম্প্রদায়ের নারীরা পিতা বা স্বামীর সম্পত্তির উত্তরাধিকার, বিবাহ সংক্রান্ত প্রমাণপত্র এবং অন্যান্য সামাজিক অধিকার যথাযথভাবে পেলেও পাহাড়ি নারীরা তাদের এ জাতীয় অধিকার থেকে অনেকটা বঞ্চিত হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, এসব নিয়ে আমাদের আরো কাজ করতে হবে। আমাদের প্রথাগত আইনকে বাদ দেওয়া যাবেনা আবার একদম চরমভাবে আইনের প্রয়োগ করলেও আধুনিকতার সাথে খাপ খাওয়া যাবেনা। তাই সচেতন নারী সমাজকে পার্বত্য অঞ্চলের এসব অসামঞ্জস্য আইন নিয়ে কাজ করার আহবান জানান। প্রথাগত আইন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের সাথে সামঞ্জস্য করতে না পারলে পার্বত্য অঞ্চলের নারীরা আরো পিছিয়ে পড়বে বলে তিনি আশংকা প্রকাশ করেন।
সংলাপে তিনটি বিষয় চিহ্নিত করে মন্তব্য রাখা হয়। এক. ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন আইন অনুসারে অত্র অঞ্চলে উপজাতিদের প্রচলিত প্রথা ও আইন নারীদের সম্পত্তি ও উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করে, যা তাদের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করে, উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তির ওপর তাদের অধিকার থাকে না। দুই. পার্বত্য চট্টগ্রামে নারীরা তাদের সংস্কৃতি ও কর্মে শক্তিশালী হলেও, প্রথাগত বৈষম্য ও সহিংসতা তাদের সমমর্যাদা অর্জনের পথে বড় চ্যালেঞ্জ মর্মে প্রতীয়মান। চার. পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি গোষ্ঠী একদিকে ১৯০০ সালের শাসন আইন বলবৎ চায়, আবার অত্র অঞ্চলে নারীদের সমতলের ন্যায় পূর্ণ অধিকার চায়, যা সাংঘর্ষিক।