
ডেস্ক রির্পোট:- গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে করা মামলার রায় ঘোষিত হবে আজ সোমবার। প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে হাসিনাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধীদের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড দাবি করা হয়েছে।
হত্যা, হত্যাচেষ্টা, নির্যাতন, ষড়যন্ত্র, উসকানি ও ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায় এই পাঁচটি অভিযোগে তাদের বিচার হয়েছে। গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত অপরাধের বিচারের ইতিহাসে এটাই প্রথম রায়। এ মামলায় চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন দোষ স্বীকার করে রাজসাক্ষী হয়েছেন, যা ২০১০ সালে ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর প্রথম কোনো অভিযুক্তের রাজসাক্ষী হওয়া।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, এই ঐতিহাসিক বিচারিক প্রক্রিয়া গোটা বিশ্ব যেন সরাসরি দেখতে পারে সেজন্য রায় সরাসরি সম্প্রচার করা হবে। ঢাকার বিভিন্ন স্থানে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বড় পর্দায়ও রায় দেখানো হবে।
প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার তামীম বলেন, ‘সোমবার রায়ের যে অংশ ট্রাইব্যুনাল পড়ে শোনাবেন, তা ট্রাইব্যুনালের অনুমতি সাপেক্ষে বাংলাদেশ টেলিভিশন সরাসরি সম্প্রচার করবে। আর বিটিভির মাধ্যমে দেশের অন্যান্য গণমাধ্যমও সেটি সরাসরি প্রচার করতে পারবে।’
বিচারপতি মো: গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ আজ এ মামলার রায় ঘোষণা করবেন। ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো: শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো: মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
গণ-অভ্যুত্থানের পর ২০২৪ সালের ১৪ আগস্ট হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ জমা পড়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায়। সংস্থাটি অভিযোগের তদন্ত শুরু করে। তদন্ত শেষে চলতি বছরের ১২ মে তদন্ত সংস্থা প্রধান প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে প্রতিবেদন জমা দেয়। এর ভিত্তিতে ১ জুন ট্রাইব্যুনালে হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান ও আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে প্রসিকিউশন। ওই দিনই ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ আমলে নেন। এরপর ১০ জুলাই তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।
গত ৪ আগস্ট রাষ্ট্রপক্ষের প্রথম সাক্ষী খোকন চন্দ্র বর্মণের সাক্ষ্যগ্রহণের মধ্য দিয়ে মামলার বিচারকাজ শুরু হয়। এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ মোট ৮১ জনকে সাক্ষী হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। তাদের মধ্যে আবদুল্লাহ আল-মামুন এবং মামলার তদন্ত কর্মকর্তাসহ মোট ৫৪ জন ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেন। পাশাপাশি দেশী-বিদেশী গণমাধ্যমে জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রকাশিত অডিও, ভিডিও এবং অন্যান্য প্রমাণ আদালতের কাছে উপস্থাপন করা হয়।
সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার আবেদন : মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় অভিযুক্তরা দণ্ডিত হলে তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে ভিকটিমদের পরিবারগুলোর মধ্যে বণ্টনের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ আবেদন জানিয়েছে প্রসিকিউশন। এ বিষয়ে গাজী মনোয়ার হোসেন তামীম বলেন, ট্রাইব্যুনালের আইনের বিধান অনুযায়ীই এই আবেদন করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘একটি জীবনের ক্ষতি কখনো পূরণ হয় না, তবে আর্থিক ক্ষতিপূরণ পরিবারগুলোকে আংশিকভাবে সহায়তা করতে পারে। যেহেতু আইনে রয়েছে, তাই আমরা দোষীদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার আবেদন করেছি। ন্যায়বিচারের স্বার্থে ট্রাইব্যুনাল যে আদেশ দেবেন, প্রসিকিউশন তা মেনে নেবে।
তামীম জানান, এই মামলায় শেখ হাসিনা এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড চাওয়া হয়েছে। মামলার আরেক অভিযুক্ত হলেন সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, যিনি পরে রাজসাক্ষী হয়েছেন। তামীম আরো বলেন, প্রসিকিউশন বিশ্বাস করে যে এ মামলায় আনা পাঁচটি অভিযোগই তারা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন। এর আগে ১৩ নভেম্বর চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আমরা সর্বোচ্চ শাস্তি আদালতের কাছে প্রেয়ার করেছি। আদালত তার সুবিবেচনা প্রয়োগ করবেন এবং আমাদের পক্ষ থেকে প্রেয়ার হচ্ছে যে এই অপরাধের দায়ে আসামিদের যেন সর্বোচ্চ সাজা দেয়া হয়।
মামলার রায় কিভাবে কার্যকর হবে : মামলার রায় কার্যকর করার বিধান প্রসঙ্গে তামীম বলেন, গণ-অভ্যুত্থানের আগে, শেখ হাসিনার শাসনামলে এই ট্রাইব্যুনালের কয়েকটি রায়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার পরে কিভাবে তা কার্যকর করা হবে সেটিও রায়ে উল্লেখ করে দেওয়া হয়েছে। ‘মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পরে আবার বলে দিয়েছেন যেন ফায়ারিং স্কোয়াডে এক্সিকিউট করা হয়। এ রকম কিছু জাজমেন্ট এই ট্রাইব্যুনালে ইতঃপূর্বে আছে। সেটা অপরাধের গ্র্যাভিটি বা গভীরতা বোঝাতে গিয়ে ওনারা বুঝিয়েছেন।
তবে গণ-অভ্যুত্থানের পরে পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর হিসেবে তামীম এখনো এ ধরনের কোনো আবেদন করেননি বলে জানান। অপরাধের গভীরতার ওপর নির্ভর করে মৃত্যুদণ্ড অথবা বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড দেয়ার বিষয়টি ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের এখতিয়ার বলে উল্লেখ করেন এই প্রসিকিউটর।
সংগঠনকে শাস্তির বিধান : এ ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে আইনের সংশোধনী এনে সংগঠনকে শাস্তি দেয়ার বিধান যুক্ত করেছে। এই আইনে কোনো রাজনৈতিক দল, অঙ্গসংগঠন বা সমর্থক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিচার করার এখতিয়ার থাকলেও সাজার বিধান ছিল না। অন্তর্বর্তী সরকার গত ১০ মে ওই আইনে দণ্ড বা সাজার বিধান যুক্ত করে সংশোধনী এনে প্রজ্ঞাপন জারি করে। ওই সংশোধনীর ফলে ট্রাইব্যুনাল এখন সংগঠনের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা, কার্যক্রম স্থগিত, নিষিদ্ধ বা সাময়িক নিষিদ্ধসহ নানা ধরনের শাস্তি দিতে পারবে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন সংশোধন করে জারি করা অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, এই আইন বা প্রযোজ্য অন্যান্য আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, যদি ট্রাইব্যুনালের কাছে প্রতীয়মান হয় যে, কোনো সংগঠন এই আইনের ৩ ধারা উপধারা (২)-এর অধীন কোনো অপরাধ সংঘটন করেছে, আদেশ দিয়েছে, চেষ্টা করেছে, সহায়তা করেছে, উসকানি দিয়েছে, মদদ দিয়েছে, ষড়যন্ত্র করেছে, সহযোগিতা করেছে অথবা অন্য যেকোনোভাবে সেই অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করেছে, তবে ট্রাইব্যুনালের ক্ষমতা থাকবে সংগঠনটির কার্যক্রম স্থগিত বা নিষিদ্ধ করার, সংগঠনের নিষিদ্ধ ঘোষণার, এর নিবন্ধন বা লাইসেন্স স্থগিত অথবা বাতিল করার এবং এর সম্পত্তি জব্দ করার। একই সাথে আইনে ‘সংগঠন’ শব্দটির সংজ্ঞায়ন করা হয়েছে। এই আইনের আওতায় সংগঠন বলতে যেকোনো রাজনৈতিক দলকেও বোঝাবে। পাশাপাশি দলের অধীনস্থ, সম্পর্কিত বা সংশ্লিষ্ট কোনো সংগঠন অথবা গোষ্ঠীকে বোঝাবে।

এক নজরে মামলার পাঁচ অভিযোগ—–
প্রথম অভিযোগ, রাজাকারের বাচ্চা বলে হত্যার উসকানি : ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ ও ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ উল্লেখ করে উসকানিমূলক বক্তব্য দেন শেখ হাসিনা। তার ওই উসকানিমূলক বক্তব্যে উৎসাহিত হয়ে আসাদুজ্জামান খান কামাল, চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনসহ সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্ররোচনা, সহায়তা ও সম্পৃক্ততায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও সশস্ত্র আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ব্যাপক হারে পদ্ধতিগতভাবে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর হামলা-আক্রমণ করে। তাদের গুলি ও হামলায় প্রায় দেড় হাজার ছাত্র-জনতা নিহত হন। আহত হন প্রায় ২৫ হাজার মানুষ।
দ্বিতীয় অভিযোগ, প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার : হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের নির্মূল করার নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপি তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মাধ্যমে সেই নির্দেশ কার্যকর করেন। ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য এ এস এম মাকসুদ কামাল এবং ১৮ জুলাই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র ফজলে নূর তাপসের সাথে কথা বলেন শেখ হাসিনা। দু’জনের সাথে কথোপকথনের পৃথক অডিও রেকর্ড থেকে জানা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট বাহিনীগুলোকে মারণাস্ত্র ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা নিজেই।
শেখ হাসিনার সেই নির্দেশ তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপির মাধ্যমে সব বাহিনীর কাছে পৌঁছে দেয়া হয়। পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ও তার অন্যান্য অঙ্গসংগঠন এবং ১৪ দলীয় জোটের নেতাকর্মীদের কাছেও এই নির্দেশ পৌঁছে যায়। সেই নির্দেশের আলোকে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়। এসব হত্যাকাণ্ডের সর্বোচ্চ দায় বা সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটি শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান ও মামুনের ওপর বর্তায়।
তৃতীয় অভিযোগ, আবু সাঈদ হত্যা : ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরে তার ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন চারবার পরিবর্তন করা হয়। এ ঘটনার দায় চাপিয়ে নিহত আবু সাঈদের সহপাঠীদের আসামি করে মামলাও করে পুলিশ। সুপিরিয়র কমান্ডার হিসেবে শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের নির্দেশে এই হত্যা, তথ্য গোপন, আলামত নষ্ট এবং পাল্টা মিথ্যা মামলা করা হয়। এর মাধ্যমে এই তিন আসামি মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন।
চতুর্থ অভিযোগ, চানখাঁরপুলে আনাসসহ ছয় হত্যা : গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার এক দফা বাস্তবায়নের দাবিতে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে যোগ দিতে আসার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন চানখাঁরপুল এলাকায় শাহরিয়ার খান আনাসসহ (শহীদ আনাস) ছয়জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সুপিরিয়র কমান্ডার হিসেবে এ ছয়জনকে হত্যার নির্দেশ দিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন।
পঞ্চম অভিযোগ, আশুলিয়ায় মরদেহ পোড়ানো : গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতা এক দফা বাস্তবায়নের দাবিতে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে যোগ দিতে আসার সময় ঢাকার অদূরে আশুলিয়ায় ছয়জন আন্দোলনকারীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। জঘন্য এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ধামাচাপা দিতে তাদের লাশ পুড়িয়ে ভস্মীভূত করে আশুলিয়া থানা পুলিশ। এ ঘটনার নির্দেশদাতা হিসেবে শেখ হাসিনাসহ তিন আসামি মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন।