
ডেস্ক রির্পোট:- মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প এক ঝটিকা কূটনৈতিক সফরে এশিয়ায় পৌঁছেছেন। তার এ সফরের মধ্যে রয়েছে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বহু প্রতীক্ষিত বৈঠক। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় হলো বাণিজ্য। বিশ্বের দুই বৃহত্তম অর্থনীতির মধ্যে বাণিজ্যিক উত্তেজনা আবারও তীব্র হয়ে উঠেছে। তেমনি এক প্রেক্ষাপটে মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে অবতরণ করেন ট্রাম্প। সেখানে রোববার শুরু হয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর সংস্থা আসিয়ানের সম্মেলন। এখান থেকে তার যাওয়ার কথা জাপান। শেষ পর্যায়ে যাবেন দক্ষিণ কোরিয়া। হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, সেখানে তার সঙ্গে শি জিনপিংয়ের বৈঠক হবে। তার এই সফরে ট্রাম্প ও অন্যা নেতারা কী জয়ের আশা করছেন, আর কোথায় রয়েছে ঝুঁকি? এ নিয়ে বিবিসি দীর্ঘ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে সাংবাদিক অ্যান্থনি জার্চার বলছেন, আমেরিকান ব্যবসার জন্য নতুন সুযোগ এনে দেয়া, অথচ যুক্তরাষ্ট্রের কোষাগারে শুল্ক রাজস্ব প্রবাহ বজায় রাখা-ট্রাম্পের এশিয়া সফরের প্রধান লক্ষ্য সম্ভবত এটিই। বিশ্ব বাণিজ্যের খেলায় অনেক খেলোয়াড় থাকলেও ট্রাম্পের সফলতা বা ব্যর্থতার কেন্দ্রবিন্দু হলো চীন। ২০১৯ সালের পর প্রথমবার ট্রাম্প ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বৈঠক নির্ধারণ করবে ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের বাকি সময়ে যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্ক কোন পথে যাবে। ট্রাম্প নিজেও স্বীকার করেছেন, চীনা পণ্যের ওপর কড়া শুল্ক আরোপ দীর্ঘমেয়াদে টেকসই নয়। আর যদিও তিনি প্রকাশ্যে বলেননি, যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদারের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ অর্থনৈতিক যুদ্ধ হলে তা হবে ভয়াবহ- শুধু যুক্তরাষ্ট্র বা চীনের জন্য নয়, বরং গোটা বিশ্বের জন্যও। যখনই দুই দেশ আলোচনায় অচলাবস্থায় পড়ে, মার্কিন শেয়ারবাজারে বড় পতন হয় – যা এই বাস্তবতাকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে কোনো চুক্তি সম্পন্ন করা এবং জাপানি বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে পারলে ট্রাম্প খুশি হবেন। কিন্তু তার মূল লক্ষ্য শি জিনপিংকে রাজি করানো, যেন চীন আবার আমেরিকান কৃষিপণ্য কেনা শুরু করে, বিদেশি কোম্পানির জন্য বিরল খনিজে প্রবেশাধিকার শিথিল করে, মার্কিন কোম্পানিগুলোর বাজারে প্রবেশের সুযোগ দেয় এবং একটি পূর্ণাঙ্গ বাণিজ্যযুদ্ধ এড়ায়। ট্রাম্পের ভাষায়, ‘এটাই আসল খেলা।’
শি জিনপিংয়ের দীর্ঘমেয়াদি খেলা: সাংবাদিক লরা বিকার বলছেন, ৩০ অক্টোবর দক্ষিণ কোরিয়ায় ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা হলে, শি জিনপিং চান যেন তাকেই দেখা যায় শক্তিশালী ও কঠিন আলোচক হিসেবে। তাই তিনি ব্যবহার করছেন চীনের বিরল খনিজ সম্পদের ওপর তার প্রভাব। এগুলো ছাড়া তৈরি করা যায় না সেমিকন্ডাক্টর, অস্ত্র ব্যবস্থা, গাড়ি কিংবা স্মার্টফোন। এটি আমেরিকার দুর্বল দিক, আর চীন সেটিই কাজে লাগাচ্ছে। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদ থেকে শিক্ষা নিয়েছেন শি। এবার বেইজিং মনে হয় শুল্কজনিত ক্ষতি সহ্য করতে প্রস্তুত। একসময় যুক্তরাষ্ট্র ছিল চীনের রপ্তানির পাঁচভাগের একভাগের বাজার, কিন্তু এখন সেই নির্ভরতা অনেক কমেছে। তবুও শির সামনে দ্বিধা, একদিকে
অ্যাক্টিভওয়্যার
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অর্থনৈতিক সংঘাত, অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ সংকট: তরুণ বেকারত্ব, রিয়েল এস্টেট সংকট, স্থানীয় সরকারের ঋণ এবং ভোক্তাদের ব্যয় না করার প্রবণতা। ওয়াশিংটন এই দুর্বলতাগুলো সম্পর্কে জানে। বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্প যদি উন্নত এআই চিপ রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা শিথিল করেন বা তাইওয়ানের সামরিক সহায়তা কমান, তবে চীন হয়তো কোনো চুক্তিতে রাজি হতে পারে। কিন্তু সেখানে পৌঁছানো সহজ হবে না।
‘শান্তি’ অনুষ্ঠানে নায়কের ভূমিকায় ট্রাম্প: বিবিসির দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সংবাদদাতা জোনাথন হেড বলেন, মালয়েশিয়া সফরে ট্রাম্পের আগ্রহ মূলত একটি অনুষ্ঠানে কেন্দ্রীভূত, যা কেবল তার জন্যই আয়োজন করা হয়েছে। সেখানে থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া এক প্রকার ‘শান্তি চুক্তি’ স্বাক্ষর করছে। দুই দেশের মধ্যে সীমান্তবিরোধ এখনো পুরোপুরি মেটেনি, তবে সামরিকীকরণ হ্রাসে তারা অগ্রগতি দেখিয়েছে। জুলাই মাসে যখন তারা একে অপরকে বোমা মারছিল, তখন ট্রাম্প শুল্ক আলোচনা বাতিলের হুমকি দেন। আর সেটিই সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধবিরতি আনতে বাধ্য করেছিল। অন্য আসিয়ান সদস্য রাষ্ট্রগুলোও চায়, ট্রাম্পের উপস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করবে। আলোচ্যসূচিতে রয়েছে আরও একটি জ্বলন্ত ইস্যু মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ।
সাংবাদিক সুরঞ্জনা তেওয়ারি বলেন, বিশ্বের শিল্প উৎপাদনের বড় অংশই এশিয়ায়। আর এই দেশগুলো ট্রাম্পের শুল্ক চাপ থেকে মুক্তি চায়। অনেকে চুক্তি নিয়ে আলোচনায় আছে। কেউবা সমঝোতায় পৌঁছেছে। কিন্তু এখনো কেউ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাক্ষর করেনি। চীন-ট্রাম্প বৈঠক অগ্রগতির ইঙ্গিত দিচ্ছে। কিন্তু শি-ট্রাম্পের সামনে অনেক জটিল
বিষয় আছে। তার মধ্যে অন্যতম শুল্ক, রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ এবং মূল প্রতিযোগিতা: এআই ও উন্নত প্রযুক্তিতে নেতৃত্ব। এই উত্তেজনা কমলে অন্য দেশগুলোও স্বস্তি পাবে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সবচেয়ে বেশি চাপে। তারা যেমন মার্কিন ইলেকট্রনিক সরবরাহ শৃঙ্খলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ, তেমনি চীনের বাজারের ওপরও ব্যাপক নির্ভরশীল। গত এক দশকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি দ্বিগুণ হয়েছে। কিন্তু ১০ ভাগ থেকে ৪০ ভাগ পর্যন্ত শুল্ক ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডের শিল্পকারখানাগুলোকে বিপর্যস্ত করতে পারে। এটি মার্কিন কোম্পানিকেও আঘাত করতে পারে, যেমন মাইক্রন টেকনোলজি, যার মালয়েশিয়ায় কারখানা রয়েছে। শুধু গত বছরই মালয়েশিয়া যুক্তরাষ্ট্রে ১০ বিলিয়ন ডলারের সেমিকন্ডাক্টর রপ্তানি করেছে।
জাপানের নতুন প্রধানমন্ত্রীর জন্য আগাম পরীক্ষা: জাপান সংবাদদাতা শাইমা খলিল বলছেন, ট্রাম্প জাপানের নতুন প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচিকে ‘অসাধারণ শক্তি ও প্রজ্ঞার নারী’ বলে প্রশংসা করেছেন। এ সপ্তাহে তার নেতৃত্বের প্রথম বড় পরীক্ষা- ট্রাম্পের সঙ্গে কার্যকর সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং পরিবর্তনশীল বিশ্বে জাপানের অবস্থান নিশ্চিত করা। তিনি সংসদে প্রথম ভাষণেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন জাপানের প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়ানোর- যা বোঝায়, ওয়াশিংটনের সঙ্গে নিরাপত্তা দায় ভাগাভাগিতে তার আগ্রহ আছে। ট্রাম্পও বারবার জাপানের কাছ থেকে মার্কিন সেনা মোতায়েনের ব্যয় বাড়ানোর দাবি করেছেন। বর্তমানে জাপানে ৫৩,০০০ মার্কিন সেনা অবস্থান করছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে সবচেয়ে বড় সংখ্যা। উভয় পক্ষই আগের সরকারের আলোচ্য শুল্কচুক্তি সম্পন্ন করতে চায়, যা জাপানের গাড়ি কোম্পানিগুলোর জন্য উপকারী। যুক্তরাষ্ট্রে গাড়ি আমদানির শুল্ক ২৭.৫ ভাগ থেকে কমিয়ে ১৫ ভাগ করা হবে। ফলে চীনা প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় তারা প্রতিযোগিতায় সুবিধা পাবে। জাপান যুক্তরাষ্ট্রে ৫৫০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যা ওষুধ ও সেমিকন্ডাক্টর সরবরাহ শৃঙ্খল মজবুত করবে।
শুল্ক আলোচনা ও কিম জং উন প্রসঙ্গ: দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট লি জে মিয়ংয়ের মূল চিন্তা ট্রাম্পের শুল্কনীতি। তবে হঠাৎই আলোচনা ছাপিয়ে গিয়েছে গুজব- ট্রাম্প নাকি উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের সঙ্গে সীমান্তে দেখা করতে পারেন। আগস্টে লি হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পকে ‘শান্তির দূত’ হিসেবে প্রশংসা করেন। আর ট্রাম্পও কিমের সঙ্গে আরেকটি বৈঠকের ধারণায় উৎসাহ দেখান। কিমও গত মাসে বলেছেন, তিনি ট্রাম্পকে ‘স্নেহভরে স্মরণ করেন’। বিশ্লেষকরা বলছেন, কিম চাইছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকের মাধ্যমে তার পারমাণবিক কর্মসূচির বৈধতা প্রতিষ্ঠা করতে। যদিও এমন কোনো বৈঠক এখনো নির্ধারিত নয়।