মিরপুরে রাসায়নিক গুদামে বিস্ফোরণ, নিহত ১৬

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় বুধবার, ১৫ অক্টোবর, ২০২৫
  • ১৩ দেখা হয়েছে

ডেস্ক রির্পোট:- মিরপুরে একটি রাসায়নিক গুদামে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডে অন্তত ১৬ জন নিহত হয়েছেন। হতাহতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রাজধানীর মিরপুরে রূপনগরের শিয়ালবাড়ি এলাকায় এ অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটে।

মিরপুরে একটি রাসায়নিক গুদামে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডে অন্তত ১৬ জন নিহত হয়েছেন। হতাহতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রাজধানীর মিরপুরে রূপনগরের শিয়ালবাড়ি এলাকায় এ অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটে।

রাসায়নিক গুদামের আগুন রাস্তার উল্টো পাশে থাকা একটি ওয়াশিং প্লান্টে ছড়িয়ে পড়ে। নিহতদের সবাই এ কারখানা ভবনে কর্মরত শ্রমিক। তবে স্থানীয়দের অনেকে দাবি করেন এটি একটি পোশাক কারখানা।

ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে অংশ নেয়। গত রাতে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও ‘পুরোপুরি নির্বাপিত’ হয়নি বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষ। ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ক্রাইম সিন ও কেমিক্যাল ল্যাব বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি আগুন নিয়ন্ত্রণে ড্রোনসহ উন্নত প্রযুক্তির প্রয়োগ করেছে ফায়ার সার্ভিস। কারখানার ভবন ও রাসায়নিকের গুদাম কোনোটিরই অগ্নিনিরাপত্তা সনদ ছিল না বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক।

ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তর জানায়, বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে মিরপুরের রূপনগরে একটি রাসায়নিক গুদামে অগ্নিদুর্ঘটনার খবর আসে। তাৎক্ষণিক রওনা হয়ে প্রথমে চারটি ইউনিট বেলা ১১টা ৫৬ মিনিটে দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। পরে আগুনের ভয়াবহতা বিবেচনায় আরো আটটি ইউনিট অগ্নিনির্বাপণে যোগ দেয়। রাসায়নিক গুদামের পাশের কারখানা থেকে ১৬টি মরদেহ উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে পাঠানো হয়। তবে মরদেহগুলোর পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া গুরুতর দগ্ধ অবস্থায় আরো দুজনকে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে পাঠানো হয়েছে।

রাসায়নিকের টিনশেড গুদামটির মালিক ‘আলম সাহেব’ বলে জানিয়েছেন কয়েকজন স্থানীয়। তাদের দাবি, এ গুদামে লাগা আগুনের ধোঁয়া রাস্তার উল্টো পাশে থাকা পোশাক কারখানায়ও ছড়িয়ে যায়। সেই সময় সেখানে কাজ করছিলেন প্রায় শতাধিক শ্রমিক। অনেকে বের হয়ে যেতে পারলেও ভবনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় আটকা পড়া শ্রমিকরা দগ্ধ হন। পুরো এলাকা ঘিরে রাখেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। পাশাপাশি তৎপরতা দেখা যায় স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবীদেরও। গতকাল দুপুর থেকেই সেখানে নিখোঁজদের সন্ধান পেতে ভিড় করেন স্বজনরা। সন্ধ্যা ৭টার পরও ঘটনাস্থলে রাসায়নিকের তীব্র গন্ধ পাওয়া গেছে।

দুর্ঘটনাস্থলে আগুন নিয়ন্ত্রণ ও উদ্ধার অভিযানে অংশ নেন ফায়ায় সার্ভিস সদর দপ্তরের পরিদর্শক মো. আনোয়ার। রাত ৮টার দিকে তিনি বলেন, ‘আমরা গিয়ে দেখি সরু রাস্তার দুই পাশে দুটি ভবনে অগ্নিকাণ্ড। এর মধ্যে একটি ভবনে রাসায়নিক গুদাম আর উল্টো দিকের ভবনে ওয়াশিং প্লান্ট। ধারণা করছি অগ্নিকাণ্ডের আগে রাসায়নিক গুদামে বিস্ফোরণ হয়েছিল। বিস্ফোরণের ফলে রাসায়নিকের আগুন ও এর থেকে সৃষ্ট ধোঁয়া রাস্তার উল্টো দিকের ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। এতে ওই ওয়াশিং প্লান্টের শ্রমিকরা ধোঁয়া ও তাপে দগ্ধ হয়ে মারা যান। অতিরিক্ত বিষাক্ত গ্যাসের কারণে তারা ভবনের নিচে নামতে পারেননি। ছাদের দিকের দরজা তালাবদ্ধ থাকায় ওপরেও যেতে পারেননি। দ্বিতীয় তলা ও তৃতীয় তলায় কর্মরত শ্রমিকরা মারা গেছেন। মরদেহের অবস্থার কারণে ডিএনএ টেস্ট ছাড়া পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব নয়। রাসায়নিকের আগুন হওয়ায় সেখানে খুব সতর্কতার সঙ্গে সময় নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। এজন্য আগুন নিয়ন্ত্রণে কিছুটা সময় লাগছে।’

এদিকে দুর্ঘটনাস্থলে তাৎক্ষণিক ব্রিফিংয়ে আসেন ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘যারা শুরুতে আগুন নেভাতে এসেছেন, তারা রাসায়নিকের গুদাম ও পোশাক কারখানার দুই দিকেই আগুন দেখেছেন।’

কারখানার কারো সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়েছে কিনা—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যতটুকু জেনেছি, এটা আলম ট্রেডিং কেমিক্যাল ফ্যাক্টরি। কিন্তু এখন মালিকের কোনো মোবাইল ফোন অথবা মালিকের কোনো কর্মচারী-ম্যানেজার কাউকেই পাওয়া যাচ্ছে না। যতটুকু শুনেছি এ রাসায়নিক গুদামের অনুমোদন নেই। যাচাই করে তদন্তের পর বিস্তারিত বলতে পারব।’

অগ্নিকাণ্ডের খবরে নিখোঁজ শ্রমিকদের স্বজনরা ঘটনাস্থলে ভিড় করেন। মিরপুর-১ গুদারাঘাট এলাকার বাসিন্দা সুরমা বেগম বলেন, ‘দুই সপ্তাহ আগে আমার মেয়ে নার্গিস ওই তৈরি পোশাক কারখানায় অপারেটর হিসেবে চাকরি নিয়েছিল। বাসায়ই সেলাইয়ের কাজ শিখিয়েছি। এসএসসি পরীক্ষা শেষ করে বাসায় বসে না থেকে মেয়ে নিজেই খোঁজ করে এখানে চাকরি নেয়। এখন আমার মেয়ের কোনো সন্ধান পাচ্ছি না। সে বেঁচে আছে, নাকি মারা গেছে—সেটাও জানতে পারছি না।’ ভাইয়ের ছেলে রবিনের ছবি হাতে ঘটনাস্থলের এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করতে দেখা যায় নাসিমা আক্তারকে। তিনি বলেন, ‘এখানে জিএম ফ্যাশন নামে একটি কারখানায় কাটিং মাস্টার হিসেবে কাজ করছিল রবিন। তার কর্মক্ষেত্র ছিল পুড়ে যাওয়া ভবনের তৃতীয় তলায়।’

দুর্ঘটনাস্থলে খালিদ হাসান সাব্বিরকে খুঁজছিলেন তার মামাতো ভাই শাকিল আহমেদ। তিনি বলেন, ‘‌সাব্বির আরমান গার্মেন্টসের স্টোর ইনচার্জ ছিলেন। সাব্বিরের ফোন এখনো বাজছে। তবে কেউ ধরছে না।’ বন্ধু সারোয়ারের ছবি হাতে ঘুরছিলেন আমানুল্লাহ। তিনি আরো বলেন, ‘‌তার বন্ধু সেখানকার একটি ওয়াশিং ফ্যাক্টরিতে হেলপারের কাজ করতেন। আগুন লাগার পর থেকে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।’

আগুনে দগ্ধ হয়ে দুজন জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তারা হলেন মোহাম্মদ সুরুজ (৩০) ও মোহাম্মদ মামুন (৩৫)। বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আবাসিক চিকিৎসক ডা. শাওন বিন রহমান জানান, রূপনগরের এলাকা থেকে রাসায়নিক গুদামের আগুনের ঘটনায় আমাদের এখানে দুজন এসেছেন। তাদের মধ্যে একজন সুরুজ, অন্যজন মামুন। সুরুজের ২ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে ও মামুনের ইনহেলেশন (শ্বসন) ইনজুরি রয়েছে। তাদের দুজনকে অবজারভেশনে রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।

এদিকে রাসায়নিক গুদামের পাশের প্রতিষ্ঠানটির নাম শাহ আলী ওয়াশিং লি. বলে দাবি করেছে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)। আগুন লেগে হতাহতের ঘটনায় সংগঠনটি গভীর দুঃখ প্রকাশ করেছে। পাশাপাশি সংগঠনটি জানিয়েছে যে মিরপুরের শিয়ালবাড়িতে যে কারখানায় আগুন লেগেছে, তা বিজিএমইএর সদস্যভুক্ত কোনো পোশাক শিল্পপ্রতিষ্ঠান নয়, এটি একটি ওয়াশিং কারখানা।

আগুন লাগা রাসায়নিক গুদামটি কসমিক ফার্মা নামের একটি প্রতিষ্ঠানের বলে শুরুতে শোনা গেলেও পরবর্তী সময়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায় সেটি আলম ট্রেডার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানের দুই প্লট পরে কসমিক ফার্মার অবস্থান। এ প্রতিষ্ঠানের সিইও মনিরুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌আলম ট্রেডার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান এখানে রাসায়নিক মজুদ রাখে। প্রতিষ্ঠানটির সামনে কোনো সাইনবোর্ড নেই। ফলে অনেকেই দুই প্লট পাশে আমাদের সাইনবোর্ড দেখে ভেবেছে কসমিক ফার্মার রাসায়নিক গুদাম।’

অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। পাশাপাশি তিনি নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারগুলোর প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। শোকবার্তায় প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘‌এ দুর্ঘটনায় নিরীহ মানুষের মৃত্যু অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও হৃদয়বিদারক। আমরা এ শোকের সময়ে তাদের পরিবারের পাশে আছি।’ প্রধান উপদেষ্টা অগ্নিকাণ্ডে আহতদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করেন এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান ও প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানের নির্দেশ দেন।

গতকাল রাত সাড়ে ১১টায় ঘটনাস্থলে উপস্থিত সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল বলেন, ‘আমরা দেখতে পাচ্ছি অনেক জায়গায় অনুমোদনহীন কেমিক্যাল গোডাউন গড়ে উঠেছে। আপনারা সম্প্রতি টঙ্গীর ঘটনাটা দেখেছেন, যেখানে দুঃখজনকভাবে আমাদের তিনজন ফায়ার ফাইটার নিহত হয়েছেন।’ সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও নির্বাপিত হয়েছে এমনটা বলা যাবে না। এখানে বিভিন্ন কম্বিনেশনের প্রচুর কেমিক্যাল রয়েছে। কেমিক্যাল দুর্ঘটনা সময় নিয়ে ফেস করতে হয়ে। হয়তো কয়েকদিন সময় লাগতে পারে। কাল সকালে (আজ) বুয়েটের প্রতিনিধি দল আসবে। ওনাদের মাধ্যমেও আমরা বিষয়টি দেখব এবং তারপর পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেব।’বণিক বার্তা

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com
Website Design By Kidarkar It solutions