টানা চারবার ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় সোমবার, ৮ জানুয়ারী, ২০২৪
  • ১৪৮ দেখা হয়েছে

ডেস্ক রির্পোট:- ক্ষমতার ধারাবাহিকতা বজায় থাকল। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয় পেয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। বিএনপিসহ সমমনা বিরোধীদের ভোট বর্জন আর যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের চোখরাঙানির মধ্যেও ভোট করে বিজয় ছিনিয়ে নিল দলটি। ফলে টানা চতুর্থ জয়ে আবার সরকার গঠন করতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ।

জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৯টি আসনে গতকাল রোববার দিনভর ভোট গ্রহণ করা হয়। বিকেল থেকে শুরু হয় গণনা। রাতে বেসরকারিভাবে ঘোষিত ফলাফল অনুযায়ী, নৌকা প্রতীকে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন ২২৩টিতে। তাঁদের পরে সবচেয়ে বেশি আসনে জিতেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। তাঁদের দখলে গেছে ৬২টি আসন। আর লাঙ্গল প্রতীকে জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা জিতেছেন ১১টি আসনে। আওয়ামী লীগের শরিক জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি ও কল্যাণ পার্টি ১টি করে আসন জিতেছে।

এই নির্বাচনে ভোট পড়ার হার তুলনামূলক কম। রাজধানীতে ভোটারের সারি সেভাবে চোখে পড়েনি। সেই তুলনায় ঢাকার বাইরে গ্রামাঞ্চলে মানুষের মধ্যে ভোট নিয়ে আগ্রহ ছিল। দিন শেষে নির্বাচন কমিশন বলেছে, সারা দেশে ভোট পড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ।

ভোটে আগ্রহের মতো এবার নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতাও অন্যবারের তুলনায় কম। যদিও ভোট চলাকালে কয়েকটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, সংঘর্ষসহ কিছু ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় দুজন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া ভোলার লালমোহনে শনিবার দিবাগত রাতে ভোটকেন্দ্রে দায়িত্ব পালনের সময় স্ট্রোকে মোস্তাফিজুর রহমান নামের এক সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তার মৃত্যু হয়েছে। চট্টগ্রাম-১০ আসনে নৌকা ও ফুলকপি প্রতীকের প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে দুজন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।

রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভোটকেন্দ্র এলাকায় ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনাও ঘটেছে। অনেক আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছাড়া অন্য প্রার্থীদের পোলিং এজেন্টের দেখা মেলেনি। কয়েকটি ভোটকেন্দ্র ঘুরে খোদ প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল নিজেই বিষয়টি স্বীকার করেছেন।

বেশ কিছু জায়গায় জাল ভোট, ব্যালটে সিল মারাসহ বিভিন্ন অভিযোগও উঠেছে। এর মধ্যে জোর করে ব্যালটে সিল মারার অভিযোগে নরসিংদী-৪ আসনের একটি কেন্দ্রের ভোট স্থগিত করেছে নির্বাচন কমিশন। কুমিল্লা-৪ আসনের একটি কেন্দ্রেও একই ঘটনা ঘটায় সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে অব্যাহতি এবং সিল মারা ব্যালট পেপারগুলো বাতিল করা হয়েছে।

ভোট গ্রহণ চলাকালে এজেন্টদের জোর করে কেন্দ্র থেকে বের করা, ব্যালটে সিল মারাসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলে ২৩ আসনে ৩০ জন প্রার্থী নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন। এ ছাড়া ফল প্রত্যাখ্যান করেছেন কয়েকজন।

এড়ানো যায়নি সহিংসতা
আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুরু থেকেই বলে আসছেন, নির্বাচনে কোনো ধরনের সহিংসতা চান না তিনি। তারপরও সহিংসতা ঠেকানো যায়নি। তফসিল ঘোষণার পর থেকে ভোটের আগপর্যন্ত সহিংসতায় নিহত হন ৮ জন। আর ভোটের দিনে সহিংসতায় ঝরেছে দুজনের প্রাণ। তাঁদের একজন মুন্সিগঞ্জে নিহত হয়েছেন, অপরজন কুমিল্লায়। এ ছাড়া দেশজুড়ে গুলি ও সহিংসতায় আহত হয়েছেন প্রায় দেড় শ জন। ভোটে অনিয়মের অভিযোগ তুলে কুমিল্লায় মহাসড়ক অবরোধ ও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। অনেক ভোটকেন্দ্র ও আশপাশের এলাকায় ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনাও ঘটেছে।

অনিয়মের যত অভিযোগ
নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুসারে, নির্বাচনে ২৯৯টি আসনে ভোটকেন্দ্র ছিল ৮২ হাজার ২৪টি। এগুলোর মধ্যে ১৪০টি কেন্দ্রে অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৪২ জনকে। তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে জাল ভোট দেওয়ার চেষ্টার সময়।

জোর করে ব্যালট পেপার ছিনতাই, হামলা ও ভাঙচুরের অভিযোগে নরসিংদী-৩ (শিবপুর) আসনের দুটি কেন্দ্র দুলালপুর ফাজিল মাদ্রাসা ও ভিটি চিনাদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র বাতিল করেছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। বেলা আড়াইটার দিকে কেন্দ্র দুটি বাতিল ঘোষণা করা হয়।

এদিকে নরসিংদী-৪ (মনোহরদী-বেলাব) আসনে বেলাব উপজেলার সল্লাবাদ ইউনিয়নের ইব্রাহিমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে জাল ভোট দেওয়ার কারণে ভোট গ্রহণ বাতিল করা হয়েছে। বিষয়টি জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা ড. বদিউল আলম নিশ্চিত করেছেন। স্থানীয় সূত্র বলেছে, নৌকার প্রার্থীর পক্ষে জোর করে কেন্দ্রে ঢুকে ১২টি বইয়ে নৌকার সিল মারেন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূনের ছেলে মঞ্জুরুল মজিদ মাহমুদ সাদী।

এ ছাড়া ব্যালটে সিল মারা, পোলিং এজেন্টদের বের করে দেওয়াসহ নানা ঘটনাও ঘটেছে। চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) আসনে নৌকার প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে ৫০টি কেন্দ্র থেকে প্রায় ৩০০ এজেন্টকে মারধর করে বের করে দেওয়ার অভিযোগ করেছেন ঈগল প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী হুইপ সামশুল হক চৌধুরী। তিনি বলেছেন, ‘পটিয়া আসনে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না। এ ধরনের নির্বাচন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও চাননি, প্রধান নির্বাচন কমিশনারও চাননি।’

সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের কলাবাড়ী উচ্চবিদ্যালয়ের ভোটকেন্দ্রে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে জাল ভোট দিতে সুযোগ দেওয়ার জন্য প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে চাপ ও হুমকি দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মো. নজরুল ইসলাম নিজেই সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগটি করেন।

প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
নাটোর-৪ আসনে বড়াইগ্রামের জোয়াড়ী ইউনিয়নের ভবানীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ব্যালটে প্রকাশ্যে নৌকায় সিল মারায় সহযোগিতা করার অভিযোগে এক সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে আটক করা হয়েছে। সাতক্ষীরা-১ আসনে তালার মানিকহার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে জাল ভোট দেওয়ার ঘটনায় একজন সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তাসহ তিনজনকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

জামালপুর-২ ইসলামপুর আসনে কুলকান্দি ইউনিয়নের একটি কেন্দ্রে ২৫ হাজার টাকা নেওয়ার সময় হাতেনাতে ধরে সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা আইয়ুব আলীকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছেন স্থানীয়রা। ময়মনসিংহ-১০ (গফরগাঁও) আসনে প্রকাশ্যে সিল মারা এবং নৌকার পক্ষে কাজ করায় কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তাসহ তিনজনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।

অনেক চোখরাঙানি উপেক্ষা করে ভোট
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ শরিক ও সমমনা বিরোধী দলগুলো দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে। তফসিল ঘোষণার পর থেকে তারা ভোট বর্জনের আহ্বান জানিয়ে লাগাতার কর্মসূচি দিচ্ছে। এসব কর্মসূচির মধ্যে দেশজুড়ে দুই শতাধিক যানবাহনে আগুন দেওয়াসহ বিভিন্ন যানবাহন ভাঙচুর করা হয়েছে। বেশ কয়েকটি ট্রেনেও আগুন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে গত ১৩ ডিসেম্বর গাজীপুরের শ্রীপুরে কাটা রেললাইনে লাইনচ্যুত হয় মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনের সাতটি বগি, প্রাণ যায় একজনের। এরপর ১৯ ডিসেম্বর রাজধানীর তেজগাঁওয়ে একই ট্রেনে আগুনে মা-সন্তানসহ চারজন নিহত হন। এরপর গত শুক্রবার রাতে আগুনে পোড়ে বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনের চারটি বগি। প্রাণ যায় চারজনের।

এই অবস্থায় এবারের জাতীয় নির্বাচন অনেকটাই আন্তর্জাতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ভোটের আগে দফায় দফায় বৈঠক করেছেন দলগুলোর সঙ্গে। বাংলাদেশ সফরে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক প্রতিনিধিদল। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, ইউরোপীয় ইউনিয়নও ছিল তৎপর। এই তৎপরতার মধ্যেই গত সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে যুক্তরাষ্ট্র জানায়, তারা বাংলাদেশের জন্য ঘোষিত ভিসানীতি প্রয়োগ করতে শুরু করেছে। এর আগে গত বছরের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি ঘোষণা করে।

এই অবস্থার মধ্যেই গত নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র নতুন শ্রমনীতি ঘোষণা করে। সেই ঘোষণার পর বাংলাদেশের পোশাক খাত নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়; পাশাপাশি নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কাও তৈরি হয়। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সংগঠন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মিত্ররাও অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলে এসেছে। চীনও বসে ছিল না। আর ভারত তো বরাবরই বড় ফ্যাক্টর বাংলাদেশের রাজনীতিতে।

সব সমালোচনার জবাব
তবে ভোটের সকালে রাজধানীতে নিজের ভোট দিয়ে কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে সব সমালোচনার জবাব দিয়ে দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ‘আর কে কী করবে, না করবে; এটা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই।’ নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন সমালোচনা হচ্ছে—এ নিয়ে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে কে কী বলল, সেটা নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন না। কারণ, বাংলাদেশ একটা সার্বভৌম রাষ্ট্র। আর জনগণ আমাদের মূল শক্তি।’আজকের পত্রিকা

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com
Website Design By Kidarkar It solutions