ডেস্ক রির্পোট:- ‘নবকুমার পথ হারিয়ে বসে আছেন। তার পাশে কেউ নাই। জনমানবহীন যায়গা। এমন সময় ষোড়শী কপালকুন্তলা বনের বুক চিরে বেরিয়ে এসে পথ-হারা পথিককে জিজ্ঞাসা করেন, ‘পথিক! তুমি পথ হারাইয়াছ?’ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘কপালকু-লা’র নবকুমারের মতোই কি দেশের সর্ববৃহৎ এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল বিএনপি পথ হারাতে বসেছে? উত্তরাঞ্চল সফরে গিয়ে রংপুর টাউন হলে এক সন্ধ্যা আড্ডায় কপালকু-লার মতোই সাংস্কৃতির সংগঠন সাউন্ড টার্চের মাকসুদুল রহমান মুুকু প্রশ্ন করেন ‘বিএনপি কি পথ হারাতে বসেছে?’ তিনি রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী শহীদ আবু সাঈদের সহপাঠি আফিফাকে গান শেখাচ্ছিলেন।
তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ না থাকায় আলোচনা আছে বিএনপি নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসতে পারে। কিন্তু জামায়াত যেভাবে ভোটের প্রচারণা চালাচ্ছে, ডোর টু ডোর যাচ্ছে, নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা মসজিদ-মাদরাসা, ক্লাব-পাঠাগার এবং পাড়ামহল্লায় মুরুব্বীয়ানা দখল করছে বিএনপি তো কিছুই করছে না।’ এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে নিলফামারির জলঢাকায়। বাসদের (মাহবুব) সাবেক নেতা মশিউর রহমান জানান, ‘জামায়াত ব্যপক প্রচারণা চালালেও বিএনপির নেতারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে রয়েছেন। তারা কি করবেন কিছুই জানেন না’। রাজনীতি এবং ভোটের রাজনীতি এক নয়। নির্বাচন দরজায় কড়া নাড়ছে অথচ বিএনপির পলিসি মানুষ বুঝতে পারছে না। সারাদেশের মানুষ ভারত বিরোধী চেতনায় উদ্বুদ্ধ। অথচ বিএনপির নেতাদের কেউ কেউ সেই ভারতকে খুশি করছেন এমন বার্তা পাওয়া যাচ্ছে। বিএনপির নেতারা কি বুঝতে পারছেন না বর্তমান প্রেক্ষাপটে হিন্দুত্ববাদী ভারতের অনুকম্পা নিয়ে নির্বাচনে ভোট পাওয়া সম্ভব নয়?
মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ব্যপক সংখ্যক আসন পেলেও দলটি কখনোই গণমানুষের সংগঠন হতে পারেনি। হিন্দুত্ববাদী চিন্তা-চেতনা ও তথাকথিত প্রগতিশীল কোলকাতা কেন্দ্রিক চেতনার মানুষজন আওয়ামী লীগের ভোটার ছিলেন। কিন্তু বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠিত বিএনপি গণমানুষের দল হিসেবে পরিচিত। ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী বিএনপি সারাদেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠে। ১৯৮২ সালে ক্ষমতা হারানোর পর বিএনপি সাময়িক বিপর্যয়ে পড়লেও বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে দলটি ব্যপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ভারতীয় ষড়যন্ত্রসহ নানা ঘাতপ্রতিঘাতে জর্জরিত বিএনপি এখন দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক শক্তি। সাধারণ মানুষ মনে করছেন বর্তমানে বিএনপির সমপর্যায়ের কোনো রাজনৈতিক শক্তি নেই। কিন্তু দলটির কিছু কিছু নেতার ভাবখানা যেন নির্বাচন এখন কেবল ‘ফর্মালিটি’। তারা মন্ত্রী-এমপি হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। নির্বাচন হলেই ক্ষমতায় যাবেন; যেমনটা আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করেছিলেন এরশাদ পতনের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনের আগে। এতোদিন আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংক হিসেবে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের ধরা হতো। আর বিএনপির ভোট ব্যাংক হিসেবে তৌহিদী জনতা, ধর্মভীরু মুসলমান, মাদরাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থী, মসজিদের ইমাম, ওলামা মশায়েখ, মাজার-খানকা শরীফ কেন্দ্রীক পীর-মশায়েখ ও তাদের মুরিদ-অনুসারিদের। মাদরাসার শিক্ষক, মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনরা নানান মাজহাবে বিভক্ত থাকলেও নির্বাচনে বিএনপির পক্ষ্যে ঐকবদ্ধ্য হয়ে প্রচারণা চালাতেন। এই ধারার মানুষজন আগে থেকেই হিন্দুত্ববাদী ভারতের আগ্রাসন বিরোধী হিসেবে পরিচিত। এখন দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দল ও শক্তি ভারত বিরোধী চেতনা ধারণ করেন। কারণ মানুষ মনে করে দিল্লি নানাভাবে শেখ হাসিনাকে সহায়তা করে ১৫ বছর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় রেখেছিল। নির্বাচনের নামে প্রহসন করে জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়ে আওয়ামী লীগ মানুষের উপর জুলুম-নির্যাতন-হামলা-মামলা, খুন গুম খেলায় মেতে উঠেছিল। ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে শত শত মানুষ হত্যার কারণে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত শেখ হাসিনাকে যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের কোনো দেশই আশ্রয় দেয়নি। এমনকি বড় বড় দেশগুলো সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। জাতিসংঘের হিসেবে ১৪শ মানুষকে খুন করলেও হাসিনাকে ভারত আশ্রয় দিয়েছে। এতো বিপুল সংখ্যা মানুষ হত্যা করেও আওয়ামী লীগ ও দলটির নেত্রী শেখ হাসিনা সামান্যতম অনুশোচনা এবং ভুল স্বীকার করেনি; বরং দিল্লিতে নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে হুমকি ধমকি দিয়ে যাচ্ছে। যার জন্য দেশের মানুষের মাইন্ডসেট হয়ে গেছে ভারত বিরোধী শক্তির পক্ষ্যে। অথচ জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী বিএনপির কিছু গুরুত্বপূর্ণ নেতার কর্মকা- ভারত ও হাসিনার অলিগার্ক ব্যবসায়ীদের খুশি করার চেষ্টার মতোই। দলটির একাধিক গুরুত্বপূর্ণ নেতা ভোট ব্যাংক হিসেবে পরিচিত আলেম সমাজের প্রতিনিধি ও ইসলামী ধারার দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে ফটো সেশন করছেন বটে; পরবর্তীতে খবর রাখেননি। এমনকি হাসিনাকে ১৫ বছর ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে যে ব্যবসায়ী নামের মাফিয়াচক্র সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে; অভ্যুত্থান ঠেকাতে অর্থ ঢেলেছে; প্রচারণা চালিয়েছে তাদের সঙ্গে বিএনপির কিছু গুরুত্বপূর্ণ নেতা সকাল-বিকেল দেখাসাক্ষাৎ করছেন। যা ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া, গণঅভুত্থান আন্দোলনে অংশ নেয়া এবং আওয়ামী লীগ রেজিমে আর্থিক ক্ষতি-জুলুম নির্যাতনের শিকার মানুষ পছন্দ করছে না। অথচ বিএনপি কি সে পথেই হাটছে?
জাতিসংঘের অধিবেশনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে নিউইয়ুর্ক গেছেন বিএনপি-জামায়াত-এনসিপির নেতারা। বিমানবন্দর থেকে জামায়াত নেতা নির্বিঘেœ বের হয়ে গেলেও বিএনপির মহাসচিব ও এনসিপি নেতারা ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের বাহিনীর আক্রমণের শিকার হন। এ নিয়ে নেট দুনিয়ায় তোলপাড় চলছে। বিএনপি মহাসচিবকে থাপ্পর দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা ও এনসিপির সাধারণ সম্পদকের পিঠে ডিম ছোঁড়ার ঘটনায় সোশ্যাল মিডিয়ায় বিতর্ক হচ্ছে। তারও চেয়ে বেশি বিতর্ক হচ্ছে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ভারতীয় গণমাধ্যমকে দেয়া বক্তব্য নিয়ে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ গণমাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দেখার সময় না থাকলেও মির্জা ফখরুল ইসলাম ভারতের ‘এই সময়’ নামের অখ্যাত গণমাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সেখানে বেশ কিছু প্রশ্নের সাবলীল জবাব দেন। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে প্রশ্ন করা হয়, আওয়ামী লীগ কি আগামী ভোটে অংশ নিতে পারবে? জাসদ বা ওয়ার্কার্সা পার্টির মতো তাদের শরীকরা? জবাবে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘আমরা বলছি আওয়ামী লীগ ও তাদের শরিকরা সবাই, এমনকি জাতীয় পার্টিও নির্বাচনে অংশ নিক। একটা সুষ্ঠু ও অবাধ ভোট হোক। এ জন্য অনেকে আমাকে ভারতের এজেন্ট, আওয়ামী দালাল বলে গালাগাল দিচ্ছে, —’। অপর এক প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘ভারত মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী। সেই সময়ে কোটি মানুষকে আশ্রয় দিয়েছে ভারত। ভৌগলিক ভাবেও বাংলাদেশের তিন দিকে ভারত, একদিকে সাগর। সুতারাং ভারতের প্রভাব বাংলাদেশে থাকবেই,—’। আরেক প্রশ্নের জবাবে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘—আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ক্ষোভের পাহাড় তীব্র ভারত-বিরোধিতায় পর্যবসিত হচ্ছে। তবে বিএনপির পক্ষে আমি আশ্বাস দিচ্ছি জামায়াতকে আর সুবিধা দিতে দেব না। ভারত সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখুক। আমরা কোলকাতা যাব, কলেজ স্ট্রিট থেকে কত বই কিনেছি। আবার সেই সুযোগ পাব। সিনেমা থিতয়েটার দেখবো। মানুষে মানুষে অবাধ যোগাযোগ হবে। ভিসা পক্রিয়া সাবলীল হবে। ভারতীয়রাও বাংলাদেশে স্বাগত। ভুল বোঝাবুঝির অবসান হোক’।
দেশের মানুষ যখন গণহত্যাকারী হাসিনার বিচারের দাবিতে সোচ্চার, আওয়ামী লীগের বিচারের দাবিতে একাট্ট এবং অন্তর্বর্তী সরকারও চায় না মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ থাকুক; তখন দেশের সর্ববৃহৎ দল বিএনপির মহাসচিবের আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ দেয়ার প্রত্যাশা ভোটারদের কি বার্তা দিচ্ছে? ভারত মুক্তিযু্েদ্ধ সহযোগিতা করেছে নিজেদের স্বার্থেই। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ থেকে বিপুল সম্পদ লুট করে নিয়ে যাওয়ার প্রতিবাদ করায় মেজর জলিলকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগের বয়ান ‘মুক্তিযুদ্ধে এক কোটি শরণার্থীকে ভারত আশ্রয় দিয়েছিল’ এখন বিএনপির মহাসচিবের মুখে কেন? কোলকাতার কলেজ স্ট্রিটে বই কেনা, সিনেমা থিয়েটার দেখা একান্তই ব্যাক্তিগত বিষয়। কিন্তু ২০০৭ সালে ইঙ্গো-মার্কিন এজেন্ডায় ওয়ান ইলেভেনের মাধ্যমে ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিনের ক্ষমতা দখল, পরবর্তীতে পিলখানায় সেনা হত্যাকা- থেকে শুরু করে ২০১৪ সালে নির্বাচনের আগে সুজাতা সিংয়ের এরশাদকে ভয় দেখিয়ে নির্বাচনে আনা, ’১৮ সালের রাতের ভোট, ’২৪ সালের ডামি প্রার্থীর ভোট এমনকি ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানের পর অপরাধী হাসিনা ও হাজারো হত্যামামলার আসামী আওয়ামী লীগের নেতাদের আশ্রয় দেয়ার পর বাংলাদেশে জুডিশিয়াল ক্যু, সামরিক ক্যু, সংখ্যালঘু নির্যাতন, পাহাড়ে অশান্তি, গ্রার্মেন্টসে বিশৃংখলা এমনকি আনসার দিয়ে সচিবালয় অবরুদ্ধ করার মাষ্টারমাই- নরেন্দ্র মোদীর ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ভুল বোঝাবুঝি? ত্রায়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকী মাত্র চার মাস। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ভোটারদের কি বার্তা দিচ্ছেন? দেশের সকল রাজনৈতিক দল, শক্তি এবং মানুষ যখন নির্বাচনের মাধ্যমে ভারতের দালালদের প্রতিহতের ঘোষণা দিচ্ছেন; তখন মির্জা ফখরুলের এমন বক্তব্য কি দেশের জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী ভোটারদের বিক্ষুব্ধ করে তুলছে না? অবশ্য বিএনপির একাধিক নেতা এ নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তারা বলছেন, ভারতের গণমাধ্যমে দেয়া মির্জা ফখরুলের দেয়া বক্তব্য তার নিজের বিএনপির নয়। বিএনপি এদেশের জনগণের দল এবং জনগণই বিএনপির রাজনৈতিক শক্তি।
ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানের আন্দোলন ঠেকানোর চেষ্টায় গণহত্যা করে শেখ হাসিনা পালানোর পর আওয়ামী লীগের ভোটের পারদ নীচে নেমে গেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে দলটির ভোটের সংখ্যা এখনো মোট ভোটের ২০ থেকে ২৫ শতাংশ হবে। সেই ভোট বগলদাবা করতে প্রকাশ্যে ভারতের বিরোধিতা করলেও জামায়াত এবং ইসলামী আন্দোলন সংখ্যানুপাতিন পদ্ধতির (পিআর) নির্বাচনের দাবি করছে। কিন্তু ক্যালেন্ডারের পাতা পিছনের দিকে ঘুড়িয়ে ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সালের নির্বাচনী ফলাফলের দিকে তাহালে দেখায় যায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভোট ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করে। হিন্দু সম্প্রদায়ের রিজার্ভ ভোটসহ আওয়ামী লীগ তথাকথিত প্রগতিশীল ব্যক্তি, হিন্দুত্ববাদী সংস্কৃতিসেবী, বাম ঘরানা চেতনাধারীদের ভোট পায়। আর জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী মানুষ বিএনপিকে ভোট দেয়। দেশে বহু ইসলামী ধারার রাজনৈতিক দল, ইসলামী ধারার সংগঠন, শতাধিক পীরের লাখ লাখ ভক্ত মুরিদান রয়েছে। পীর-মাশায়েখদের অনুসারীদের ভোট বিএনপির বাক্সে যায়। শুধু তাই নয়, চরমোনাই পীর, আটরশির পীরসহ কয়েকজন পীর নিজেদের নেতৃত্বে রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন। ওই সব পীরের সারাদেশে হাজার হাজার লাখ লাখ ভক্ত-অনুসারী রয়েছেন। নির্বাচনের সময় দেখা যায় ওই পীরদের অনুসারি মুরিদ-জাকেরান-আশেকান ভোটারগণ বিএনপিকেই ভোট দিয়ে থাকেন। বিগত নির্বাচনগুলোর চিত্র এ বার্তা দেয়। কারণ একটি নির্বাচনী আসনে আটরশির পীরের মুরিদান-ভক্ত অনুসারির সংখ্যা কমবেশি ৩০ থেকে ৪০ হাজার। ওই পীরগণ এলাকায় গিয়ে ইসলামী জলসা করলে এ চিত্র দেখা যায়। কিন্তু নির্বাচনে দেখা যায় পীরের দলের প্রার্থী এক থেকে দুই হাজার ভোট পেয়েছেন। বাকী ভোট বিএনপির বাক্সে যায়। সারাদেশে লাখ লাখ কৃষক-শ্রমিক-ক্ষেতমজুর-রিক্সাচালক-মুটে মজুর পীরের মুরিদান। তারা নিজ নিজ পীরদের অনুসরণ ও অনুকরণ করেন। নির্বাচনে হিন্দুত্ববাদী ভারতের তাবেদার আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিপক্ষে শক্তিশালী বিএনপির প্রার্থীকে ভোট দেন। কিন্তু তাদের পীরদের নিয়ে কটুকথা সহ্য করেন না, আহতবোধ করেন। কিন্তু বিএনপির কয়েকজন নেতা পীরদের যে ভাষায় গালাগালি করছেন, পীরদের বিরুদ্ধে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করছেন তাতে ওই পীরদের মুরিদান বিএনপির রিজার্ভ ভোটারগণ ভালভাবে নিচ্ছেন না। আর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বি পীরদের গালাগালি করলে বিএনপির ভোট বাড়বে এমন ভাবনাও অমুলক।
প্রধান উপদেস্টা গত ৫ আগস্ট ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচনের ঘোষণা দেয়ার পর জামায়াত তিনশ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। দলটির প্রার্থীরা নির্বাচনী প্রচারণায় নেমে পড়েছে। দলটির প্রার্থীরা জুলাইয়ের শহীদ আবু সাঈদ-ম্গ্ধুদের নাম পোস্টারে লিখে ভোট প্রার্থনা করছে। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের দাবির পাশাপাশি ভারত বিরোধী ধোঁয়া তুলে প্রচারণা চালাচ্ছে। অথচ ভারত বিরোধী মূল রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে পরিচিত জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী বিএনপির নেতাদের কেউ ভারত তোষণ করছে; কেউ হাসিনার অলিগার্ক হিসেবে পরিচিত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে উঠাবসা করছেন। পর্দার আড়ালে অনেকেই আওয়ামী লীগ অনুসারি ব্যবসায়ীদের প্রশ্রয় দিয়ে সহায়তা নিচ্ছেন এবং মৃত্যুর পরও হাসিনার সঙ্গে থাকার ঘোষণা দেয়া ব্যবসায়ীর সঙ্গে দহরম মহরম করছেন এবং এস আলমের মতো রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটকারী ব্যবসায়ীদের প্রোটেকশন দিচ্ছেন। এ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় তীব্র প্রতিবাদ-বিতর্ক চলছে। নেটিজেনদের অনেকেই বলছেন, আগামী নির্বাচনের খরচের জন্য দলটির দু’চারজন নেতা এমন কা- করছেন। প্রশ্ন হচ্ছে ’৯১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হতে প্রচুর টাকা খরচ করতে হয়েছিল? ওই সময় কি বিএনপির নেত্রীর হাতে তেমন অর্থ ছিল? জনগণের ভোট পেতে কি আওয়ামী লীগের অলিগার্ক ব্যবসায়ীদের লুটের টাকার প্রয়োজন আছে? বিএনপির কিছু নেতা বিদেশী রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে বৈঠকের খবর প্রচার করে বোঝাচ্ছেন বিদেশীরা বিএনপির সঙ্গে রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে বিদেশীরা কি নির্বাচনের ফলাফলে প্রভাব ফেলতে পারবে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক দীর্ঘ ৫ বছর নির্বাচনের দাবি করলেও আওয়ামী লীগকে কি নিরপেক্ষ নির্বাচন দিতে বাধ্য করতে পেরেছে?
প্রশাসনের পরতে পরতে জামায়াত ঢুকে গেছে। গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো জায়ায়াত অনুসারিরা বসে প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করছে। অথচ বিএনপির তৃর্ণমূল পর্যায়ের নেতাদের চাঁদাবাজ প্রচার করে বিএনপির নামের সঙ্গে ‘চাঁদাবাজ ট্যাগ’ দেয়া হচ্ছে। মাঠ পর্যায়ের কয়েক হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজীর অভিযোগে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। তৃর্ণমূল নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে অথচ কেন্দ্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে যারা হাসিনার অলিগার্ক বিতর্কিত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ছেন তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না। মাথার পচন (কেন্দ্রীয় নেতা) রোধে ওষুধের ব্যবহার না করে লেজে (তৃর্ণমূল) ঘায়ে মলম লাগালে কি রোগ ভাল হয়ে যায়? বিভিন্ন ইসলামী ধারার দল, সংগঠন এবং মাজার-খানকার নেতা-ইসলামী স্কলারদের অভিযোগ, বিএনপির নেতাদের কেউ কেউ তাদের সঙ্গে বৈঠক করে আগামী নির্বাচনের সঙ্গে রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফটো সেশন করেছেন। সে ছবি গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচারও হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে কোনো খবর রাখেননি এবং যোগাযোগও করেন না। ফলে ছোট দল ও ক্ষুদ্র শক্তি হওয়ায় আমরাও নিজেরা বৃহৎ দল বিএনপির সঙ্গে নিজ থেকে যোগাযোগ করতে পারছি না। প্রশ্ন হচ্ছে বিএনপি কোন পথে যাবে? ভোট ব্যাংকের দিকে নাকি অন্যদিকে? ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশে বিএনপির সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক শক্তি। সে দলটির জাতীয়তাবাদী চেতনা ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ছে না। অথচ দলটির মহাসচিব ভারতের সঙ্গে ভুল বুঝাবুঝির অবসান করতে এবং গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে ফিরিয়ে আনার কথা বলছেন। প্রশ্ন হচ্ছে বিএনপির এই নেতারা কি চাচ্ছেন। দেশের মানুষ বিএনপির ধানের শীষে ভোট দেয়ার জন্য মুখিয়ে রয়েছে। বিএনপির নেতারা সে ভোটারদের কাছে টানবেন নাকি দূরে ঠেলে দেবেন সে কৌশল নিতে হবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ভোটাররা বিএনপিকে ভোট দেয়ার জন্য অপেক্ষা করলেও সে ভোট পেতে বিএনপিকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, ভারত বিরোধী ইসলামী চেতনার মানুষের মনন বুঝতে হবে। ‘নির্বাচন হলেই ক্ষমতায় যাব’ এমন মানসিকতা নিয়ে নির্বাচনে গেলে কাজী নজরুল ইসলামের লেখা ফিরোজা বেগমের কালজয়ী গান ‘পথহারা পাখি কেঁদে ফিরি একা/ আমার জীবনে শুধু আঁধারের লেখা’ পরিণতি হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।