শিরোনাম

বিএনপির জন্য বার্তা,ডাকসু নির্বাচন নিয়ে সর্বত্রই চলছে বিচার-বিশ্লেষণ

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
  • ৭২ দেখা হয়েছে

ডেস্ক রির্পোট:- ইংরেজিতে একটি উক্তি রয়েছে, ‘নো দাই সেলফ’ (নিজেকে জানো)। গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসের এই উক্তি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের ফলাফল বিএনপিকে নিজের চিন্তা, অনুভূতি, বিশ্বাস, মূল্যবোধ, শক্তি ও দুর্বলতা গভীরভাবে উপলব্ধি এবং আত্ম-জ্ঞান অর্জনের সুযোগ করে দিয়েছে। আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রায় ৫ মাস আগে ব্যাপক জনপ্রিয় দলটির নীতি নির্ধারকদের ভাবনার দুয়ার ডাকসুর ভোট খুলে দিয়েছে। বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের গঠিত বিএনপি কোন পথে হাঁটবে সেটা তাদের নির্ধারণ করতে হবে।

‘যদি লক্ষ্য থাকে অটুট, বিশ্বাস হৃদয়ে, হবেই হবে দেখা, দেখা হবে বিজয়ে’। গানের এই লিরিকের অর্থ হলো, তোমার আকাক্সক্ষা-সংকল্প দৃঢ় থাকলে কোনো বাধাই তোমাকে তোমার লক্ষ্যে পৌঁছাতে বাধা দিতে পারবে না। আবার প্রবাদে রয়েছে, ‘বসে খেলে রাজার ভা-ার খালি হয়ে যায়’। কোনো কাজ না করে শুধুমাত্র খরচ করলে, সব থেকে বড় সম্পদও (ভা-ার) শেষ হয়ে যায়। এমনকি রাজার মতো ধনী ব্যক্তির সম্পদ ফুরিয়ে যায়। প্রথম প্রবাদটি যেমন ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রশিবির দেখিয়েছে; তেমনি দ্বিতীয় প্রবাদটি ছাত্রদল তথা বিএনপির জন্য যুতসই উদাহরণ হতে পারে। ডাকসু নির্বাচন সবার চোখ খুলে দিয়েছে। রাজনীতি হচ্ছে ক্ষমতা ভাগাভাগি, সম্পদ বণ্টন এবং সামাজিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ সংক্রান্ত কর্মকা-। এটা দলীয়-নির্দিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মধ্যে ক্ষমতা সম্পর্কের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ বিষয়ক কর্মকা-ের সমষ্টি। ছাত্রশিবির সেটা দেখিয়েছে। ‘ডাকসু নির্বাচন পক্ষপাতিত্ব হয়েছে বা প্রশাসনযন্ত্র শিবিরের পক্ষে কাজ করেছে’ নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করতে এসব অভিযোগ তুলে আত্মতৃপ্তি পাওয়া যেতে পারে; কিন্তু শিক্ষার্থীরা শিবির প্রার্থীদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছে অস্বীকার করার উপায় নেই। আবার ‘শিবির স্বাধীনতা বিরোধী’ আর ‘ছাত্রদল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি’ শিক্ষার্থীরা আমাদের ভোট না দিয়ে যাবে কোথায়’ এমন মানসিকতায় ছাত্রদলের ভরাডুবি ঘটেছে। শুধু কী তাই, ‘কাক যতই ময়ূরের পেখম পরে ময়ূর হওয়ার চেষ্টা করুক, সে কিন্তু কখনোই ময়ূর হতে পারেনা; তেমনি জাতীয়তাবাদী ধারা ও ইসলামী মূল্যবোধের দল যতই ‘প্রগতিশীল চেতনা’ ধারণ করুক তথাকথিত প্রগতিশীলদের মন পাবে না। ডাকসু নির্বাচন দেশের সবচেয়ে বৃহৎ ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল বিএনপির জন্য এটা বার্তা; বিএনপি সে বার্তা গ্রহণ করবে নাকি ‘জনগণ বিএনপিকে ভোট না দিয়ে যাবে কোথায়’ সে মানসিকতা ধারণ করে থাকবে সেটা বোঝা যাবে দলটির সামনের কর্মপন্থা ও গতি-নীতি-কৌশলে।

যুগের পর যুগ ধরে বাংলাদেশের রাজনীতির শ্রোত দুই ধারায় প্রবাহিত। এক ধারায় তথাকথিত প্রগতিশীল, ভারতপ্রেমী; অন্যধারায় মধ্য পন্থার জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী। ভিতরে কিছু অতিবাম ও অতিডানপন্থী থাকলেও সেগুলোর সঙ্গে জনসম্পৃক্তা তেমন নেই। তবে ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে দেশের রাজনীতিতে নতুন চেতনার উদ্ভব ঘটেছে। মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারী সেজে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে দেশকে হিন্দুত্ববাদী ভারতের তাবেদারে পরিণত করা হয়েছিল। দীর্ঘ ১৮ বছর বাংলাদেশের প্রশাসনযন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ করতো দিল্লির সাউথ ব্লক। ফলে ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশে প্রগতিশীলতার অজুহাতে আকাশ সংস্কৃতির নামে হিন্দুত্ববাদী বিজাতীয় সংস্কৃতির ক্ষেত্রভূমিতে পরিণত করা হয়। কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষ এবং ছাত্র-জনতা, তরুণ-তরুণীরা হিন্দুত্ববাদের আগ্রাসন রাজপথে রক্তের বিনিময়ে প্রতিহত করেছে। ফ্যাসিস্ট হাসিনার বিরুদ্ধে এক দফার আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের শ্লোগান ছিল, ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার-রাজাকার; কে বলেছে কে বলেছে, স্বৈরাচার-স্বৈরাচার’।

যুগের চাহিদায় সোশ্যাল মিডিয়া এখন জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আফ্রিকার দেশ মিশরে আরব বসন্ত থেকে শুরু করে বিশ্বের দেশে দেশে আন্দোলন ও জনমত গঠনে সোশ্যাল মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশেও কোটা আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, অতিসম্প্রতি নেপালের জেন-জি আন্দোলন সোশ্যাল মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ রোল প্লে করেছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় তরুণ-তরুণীদের মতামতের দিকে দৃষ্টি দিলে বোঝা যায়, আওয়ামী লীগের পতনের মাধ্যমে বাংলাদেশে বাম ও বামঘেঁষা তথাকথিত গণতন্ত্রীদের চূড়ান্ত পরাজয় হয়েছে। বাংলাদেশের তরুণ সমাজ ইসলামবিদ্বেষ পছন্দ করে না। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় তো বটেই ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরাও শুক্রবার জুম্মার নামাজ পড়তে মসজিদে যান। এমনকি নারী স্বাধীনতা ও নারীর সমঅধিকারের নামে বামঘেঁষা গণতন্ত্রীদের মূল অস্ত্র নারীবাদও খোদ তরুণ নারীরাও পছন্দ করছে না। ফলে সেই বাম বা বামঘেঁষা লিবারেলিজমের বিপরীতে স্ট্যান্ড নিয়েই ডাকসু নির্বাচনে ছাত্র শিবির বিজয়ী হয়েছে। স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমানের হাতেগড়া দল বিএনপি এবং ছাত্রদলের বিগত দিনগুলোতে ভারতের দালাল আওয়ামী লীগের মতো স্বাধীনতা-মুক্তিযুদ্ধ এবং ’৭১ চেতনাকে ফেরি করার কি আছে? সবাই জানে বিএনপি মুক্তিযোদ্ধাদের দল। নতুন করে তথাকথিত প্রগতিশীলতার নামে মুক্তিযুদ্ধের এজেন্সি নেয়ার কিছু নেই। কাকের মতো ময়ূরপুচ্ছ লেজে লাগালেই কাক যেমন ময়ূর হয় না; তেমনি জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী জিয়াউর রহমান ও বেগম খালেদা জিয়ার বিএনপি তথাকথিত ‘প্রগতিশীল চেতনা’ ধারণ করলেই হিন্দুত্ববাদীদের আস্থা অর্জন করতে পারবে না। ডাকসু নির্বাচনে জিএস পদে ছাত্রদলের শেখ তানভীর বারী হামিম পেয়েছে ৫২৮৩ ভোট। আর একই পদে ছাত্র ইউনিয়নের মেঘমল্লার বসু পেয়েছে ৪৯৪৯ ভোট। সিপিবির ছাত্র সংগঠনের এ নেতা অসুস্থ হওয়ায় প্রচারণা চালাতে পারেননি এবং হুইল চেয়ারে করে ক্যাম্পাসে এসে ভোট দিয়েছেন। প্রচারণা ছাড়াই তিনি এ ভোট পেয়েছেন। এতে বার্তা পরিষ্কার বিএনপি যতই প্রগতিশীল হওয়ার চেষ্টা করুক না কেন তথাকথিত প্রগতিশীলদের আস্থা অর্জন করতে পারবে না। বরং ‘নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল’ প্রবাদের মতোই নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের বিকল্প হিসেবে তারা সিপিবির অঙ্গ সংগঠন ছাত্রশিবিরকে আস্থাশীল মনে করেন। ফলে তারা ছাত্র ইউনিয়ন প্রার্থীকে ভোট দেন। নির্বাচনী কৌশল এবং বিজয়ী হওয়ার দৃঢ়তায় ডাকসুতে শিবির ছাত্রীদের বড় সমর্থন পেয়ে গেছে। সামনে শিক্ষার্থী তথা তরুণ-যুবক সমাজের চাহিদা অনুযায়ী শিবির কাজ করতে পারবে কী না, সেটা সময় বলে দেবে। কিন্তু ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদলের বার্তা আগামী নির্বাচনের আগে বিএনপিকেও সুস্পষ্ট বার্তা দিয়েছে। ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশে যতই জনসমর্থন থাকুক না কেন ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসীদের উপেক্ষা করে তথাকথিত বাম এবং বামঘেঁষা লিবারেল চেতনা নিয়ে ও হিন্দুত্ববাদকে ধারণের রাজনৈতিক কৌশল নিলে আগামী নির্বাচনে সুবিধা করতে পারবে না। ডাকসু নির্বাচনে শিবিরের বিজয় এবং ছাত্রদলের লজ্জাজনক পরাজয়ের পর সোশ্যাল মিডিয়ায় নেটিজেনদের অনেকেই লিখেছেন, ‘মূল ধারার রাজনীতিতে বিএনপিকে আগামী নির্বাচনে ভোট পেতে হলে দলটিকে ইসলামপন্থী হতে হবে, প্রকাশ্যে ইসলামের জন্য কাজ করতে হবে এবং প্রকাশ্যে ইসলামবিদ্বেষের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে। তবেই তরুণ প্রজন্ম তাদের সমর্থন দিবে। নয়তো তাদের জন্য সামনে রাজনীতি করাও কঠিন।’

রাজনীতি হচ্ছে কৌশলের খেলা। রাজনীতিতে জনসমর্থন, টাকা পয়সার প্রয়োজন আছে বটে কিন্তু সেটাই সবকিছু নয়। মানুষের মনন বোঝা এবং প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বিজয়ী হতে কৌশল অপরিহার্য। গাজীপুর আইনজীবী সমিতির নির্বাচনের চিত্র দেখা যাক। ওই জেলায় জামায়াত-শিবির খুবই দুর্বল। অথচ হাসিনা পালানোর পর গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে জামায়াত-শিবিরকে ছায়া দিয়েছে। জাহাঙ্গীর হুংকার দিচ্ছে জামায়াতের ছায়াতলে থেকে। ফলে গত ৩০ মে গাজীপুর আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে জাহাঙ্গীরের বদৌলতে সভাপতি-সম্পাদকসহ ৫ পদে জামায়াত সমর্থিত প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন। এটা হচ্ছে রাজনীতির কৌশল এবং লেনদেন। ডাকসু নির্বাচনে এমন কোনো কৌশল নেই যা শিবির গ্রহণ করেনি। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারণা, রাজনৈতিক কৌশল, গ্রামে গ্রামে গিয়ে ভোটারদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ ও সহায়তা, কোচিং সেন্টারে শিক্ষার্থী ভোটারদের ব্রেন ওয়াশ, নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের ভোটারদের ক্যাম্পাস ও হলে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা, নারী শিক্ষার্থীর বান্ধব পরিবেশ, প্রশাসনযন্ত্রকে নিজেদের বলয়ে নেয়া, নতুন ভোটারদের নিজেদের পক্ষে টানতে আর্থিকসহ সার্বিক সহায়তা এমন কাজ নেই যা শিবির করেনি। এমনকি জুলাই চেতনাকে ভালভাবেই নির্বাচনী প্রচারণায় কাজে লাগিয়ে শিক্ষার্থীদের মন জয় করেছে। নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের ভোটারদের আগামী দিনে ছায়াদিয়ে নিরাপত্তা দেয়ার নিশ্চয়তা দিয়ে ভোটকেন্দ্রে এসেছে। নারী শিক্ষার্থীরা যা চায় সেটার নিশ্চয়তা দেয়ার বার্তা দিয়েছে। বিশেষ করে এনজিও কাম রাজনৈতিক দল জামায়াতের সহযোগী সংগঠন শিবির নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার সব ধরনের চেষ্টা করেছে। লক্ষ্য অটুট এবং মনে বিশ্বাস রেখেই দৃঢ়তার সঙ্গে সবধরনের কৌশল গ্রহণ করে প্রচারণায় করায় নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিবিরের পক্ষে কাজ করেছে, নির্বাচনে সূক্ষ্ম কারচুপি হয়েছে ইত্যাদি বলে ছাত্রদল সান্ত¦না পুরস্কার পেতে পারে; কিন্তু নির্বাচন নিরপেক্ষ হয়েছে এবং শিক্ষার্থীরা লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দিয়েছে এ বাস্তব চিত্র দেশবাসী দেখেছে। সেখানে পরাজিত প্রার্থীরা নিজেদের ব্যর্থতার দায় অন্যের ঘাড়ে দিতে চাইলেও শিক্ষার্থীদের ‘স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দেয়া’ দৃশ্য কি মিথ্যা হয়ে যাবে?

সোশ্যাল মিডিয়ায় নেটিজেনদের অনেকেই লিখেছেন, বিএনপিকে রাজনৈতিক কৌশল পরিষ্কার করতে হবে। শুধু কথামালা, বক্তৃতা-বিবৃতি, দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানালেই নির্বাচনের জন্য মুখিয়ে থাকা জনগণ ভোট যেমন দেবে না; তেমনি আওয়ামী লীগের পালানোর মধ্যদিয়ে মুু্িক্তযুদ্ধের তথাকাথিত চেতনা বিক্রি জনগণ পছন্দ করছে না। মুক্তিযুদ্ধ, ’৭১ এর চেতনা, স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব সবার কাছে দামী। কিন্তু ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের মতো ‘চেতনার ব্যাপারী’ চর্চা মানুষ পছন্দ করছে না। কারণ এতোদিন চেতনার ব্যাপারীদের হাতে মানুষ প্রতারিত হয়েছে; তিনটি জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিতে পারেনি। ফলে মানুষ যেমন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীদের পছন্দ করে না; তেমনি চেতনার ব্যাপারীগিরিও পছন্দ করছেন না। ’৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং ২০০৮ সালে চট্টগ্রামে অখ্যাত প্রার্থী ড. হাছান মাহমুদের বিজয়ী হওয়ার কথা মনে আছে? এরশাদের পতনের পর পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাচ্ছে নিশ্চত হয়েই ভাবী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোন নেতাকে কোন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেবেন তার খসড়া তৈরি করেন, টাকার বিনিময়ে মন্ত্রণালয় কেনাবেচা পর্যন্ত হয়। বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে বিএনপি ১০ আসন পাবে না এমন দম্ভোক্তি করেন হাসিনা। ভোটের ফল প্রকাশের পর বিএনপি বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় গেছে। বিপুল জনসমর্থন ও জনপ্রিয়তা দাবিদার আওয়ামী লীগকে সংসদে বিরোধী দলে বসতে হয়। আবার ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন? চট্টগ্রাম-৭ আসনে বিএনপি প্রার্থী সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিপরীতে প্রার্থী হন আওয়ামী লীগের সভাপতির অফিস কর্মচারী ড. হাছান মাহমুদ। অপরিচিত হাসান মাহমুদ প্রার্থী হওয়ায় সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বক্তব্য ‘ওই ছোকরাকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করছি না, মানুষের কাছে আমার যাওয়ার দরকার নেই, মানুষ আমাকে ভোট না দিয়ে যাবে কোথায়?’ মন্তব্য করেন। নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায় সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরী ৭২ হাজার ভোট পেয়েছেন আর অখ্যাত হাছান মাহমুদ এক লাখ ১১ হাজার ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগ পালিয়েছে অতএব আসন্ন নির্বাচনে বিএনপির বিজয় সুনিশ্চিত এবং জনগণ বিএনপিকে ভোট দেয়ার জন্য মুখিয়ে রয়েছে এমন চিন্তা করা বোকার স্বর্গে বসবাসের নামান্তর। ডাকসু নির্বাচন সে বার্তা দিয়েছে।
ফ্যাসিস্ট হাসিনা রেজিমে বিএনপির নেতাদের বিরুদ্ধে লাখ লাখ মামলা হয়েছে। জুলুম-নির্যাতন, খুন-গুমের শিকার হয়েছেন বিএনপির নেতারা। দলটির বহু নেতা ব্যবসা খুইয়েছেন, চাকরি খুইয়েছেন। বছরের পর বছর ঘরে ফিরতে পারেননি।

গ্রাম ছেড়ে এবং এক শহর ছেড়ে অন্য শহরে গিয়ে সিএনজি, রিক্সা চালিয়েছেন শিক্ষিত ছেলেরা; পুলিশী গ্রেফতার এড়াতে রাস্তার পাশে ঘুমিয়েছেন, মাঝনদীতে নৌকায় ঘুমিয়েছেন, ধানক্ষেত-পাটক্ষেত-জঙ্গলে বসে রাত কাটিয়েছেন। ভয়াবহ জুলুম নির্যাতনের শিকার হয়েছে বিএনপি। অন্যদিকে জামায়াত নিষিদ্ধ করা এবং জুলুম নির্যাতনের শিকার হলেও দলটির বহু নেতা আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে সমঝোতা করে ব্যবসায় বাণিজ্যের ভাগ-বাটোয়ারা দিয়ে নিজেদের টিকিয়ে রাখেন। ইসলামী আন্দোলন বছরের পর বছর হাসিনার ও তার পিতার গুণগান করে রাজনীতিতে দলের প্রসার বাড়িয়েছেন। অনেকেই বলছেন ভারতের নীল নকশা অনুযায়ী আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনে ইসলামী আন্দোলন ও জামায়াত সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) নির্বাচন দাবি করছেন। এসব অভিযোগের পক্ষে যুক্তি আছে কিন্তু ইসলামী আন্দোলনের নেতারা এখন যে বিএনপির বিরুদ্ধে চাঁদাবাজীর অভিযোগ তুলে চিৎকার করছে; সেটাকে কি উড়িয়ে দেয়া যায়? বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়া ঠেকাতে পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের দাবিতে জামায়াত-ইসলামী আন্দোলন একাট্টা হয়ে দলটির ইমেজ ক্ষুণœ করতে চাঁদাবাজী অভিযোগ জোরেশোরে প্রচার করছে। বিএনপির নামের সঙ্গে ‘চাঁদাবাজ’ ট্যাগ দিচ্ছে। কিন্তু জুলাই অভ্যুত্থানের পর প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে জামায়াত অনুসারীরা। স্বাস্থ্য সেক্টর জামায়াতের নিয়ন্ত্রণে। শিক্ষা সেক্টর জামায়াতিকরণ হয়ে গেছে। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরগুলোর হর্তাকর্তা পদে জামায়াতের চেতনাধারীরা বসে গেছেন। অতীতে যারা হাসিনার অলিগার্ক হিসেবে মুজিব বন্দনায় মদমত্ত ছিলেন জুলাই অভ্যুত্থানের পর তাদের কেউ কেউ মুজিবকোর্ট খুলে গিরগিটির মতো রং বদলিয়ে জামায়াতের আনুগত্যে পদ-পদবিতে রয়েছেন। জামায়াত-ইসলামী আন্দোলন বিএনপিকে ‘চাঁদাবাজ’ ট্যাগ দিচ্ছে অথচ বিএনপির দায়িত্বশীলরা প্রশাসনে জামায়াতিকরণ দেখেও নীরবতা পালন করছেন। নির্বাচন কমিশন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে।

আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি প্রথমার্ধে নির্বাচন হবে। বিএনপির বেশির ভাগ নেতাই মনে করছেন প্রার্থী হতে পারলেই এমপি-মন্ত্রীত্ব সুনিশ্চিত। সে কারণে দলীয় মনোনয়ন পেতে দৌড়ঝাপ করছেন এবং নিজেদের মধ্যে বিরোধে জড়াচ্ছেন। আবার শরীক দলের যারা বিএনপির থেকে মনোনয়ন পেতে পারেন তারাও নিজেদের নিরপেক্ষতা জাহির করতে তথাকথিত প্রগতিশীল কথাবার্তার ঝড় তুলছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের পতনের মাধ্য দিয়ে দেশে তথাকথিত প্রগতিশীল তথা ইসলাম বিদ্বেষী রাজনীতির কবর হয়ে গেছে। মুসলমানের দেশে ইসলামী চেতনা কর্পেটের নীচে চাপা দিয়ে রেখে নির্বাচনে গেলে কি পরিণতি হয় তার প্রমাণ ডাকসু নির্বাচন। তরুণ প্রজন্ম রাজনীতিতে ইসলাম বিদ্বেষ পছন্দ করে না। বাংলাদেশে ইসলামী চেতনার ভোটার ও রাজনৈতিক শক্তিকে উপেক্ষা করে তথাকথিত প্রগতিশীলতার জার্সি পরার নির্বাচনী কৌশল কি সাফল্য দেবে? ’৯৬ সালে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার জন্য শেখ হাসিনাকে মাথায় পট্টি বাঁধতে হয়েছিল। আলেম সমাজ, ইসলামী চেতনায় বিশ্বাসী ভোটারদের উপেক্ষা করে নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এমন নজীর নেই। ফলে ‘বড় দল অন্যের সহায়তার প্রয়োজন নেই’ এবং আওয়ামী লীগ পালিয়েছে এখন জনগণ বিএনপিকে ভোট না দিয়ে যাবে কোথায়’ এমন মানসিকতা পরিহার করা অপরিহার্য। সম্প্রতি ইসলামী ধারার কয়েকটি দলের নেতার সঙ্গে আলাপের সময় নির্বাচন প্রসঙ্গ উঠতেই আক্ষেপ করে বললেন, ‘আমরা ছোট দল ইসলামী চিন্তা চেতনার বাইরে যাব না। যুগের পর যুগ ধরে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে এবং বিএনপির পক্ষে থাকি। কিন্তু ছোট দল হিসেবে বিএনপিকে বলতে পারিনা আপনারা আসুন-বসুন। বড় দল হিসেবে বিএনপি আমন্ত্রণ জানালে তাদের সঙ্গে আলোচনা হতে পারে এবং অতীতে সেটা হয়েছে। কিন্তু বিএনপি তথাকথিত প্রগতিশীল চেতনা ধারণ করলে আমরা তাদের আহবানে সাড়া দিতে পারবো না। ইসলামী চেতনার বাইরে যাব না। বড় দল হওয়ায় ওরা ছোট দলকে পাত্তাই দিচ্ছে না’।

কবি হরিশচন্দ্র মিত্র লিখেছেন, ‘আপনারে বড় বলে, বড় সেই নয়; লোকে যারে বড় বলে বড় সেই হয়, বড় হওয়া সংসারেতে কঠিন ব্যাপার, সংসারে সে বড় হয়, বড় গুণ যার’। ডাকসু নির্বাচন বিএনপির চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে তথাকথিত প্রগতিশীলতা, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের মতো চেতনা বিক্রী’র রাজনীতি এখন আর চলবে না। অবশ্য ‘বড় দল হলেই নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া যাবে না’ এমন বক্তব্য দিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি উপলব্ধি করেছেন জনগণের কাছে যেতে হবে এবং তাদের মনন বুঝে কাজ করতে হবে। সম্প্রতি দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে দেয়া তারেক রহমানের একটি বক্তব্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। দলের নেতাকর্মীদের সতর্ক করে তিনি বলেছেন, ‘আমাদের অনেকেই মনে মনে তৃপ্তিবোধ করেন বিএনপি বড় দল। জনগণ যদি মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে দল যতই বড় হোক না কেন আপনার-আমার কিছ্ইু করার থাকবে না। আমি কয়েক মাস ধরে বলছি আপনারা যত সহজ ভাবছেন সামনের নির্বাচন এতো সহজ নয়। আমাদের নেতাকর্মীরা বিএনপিকে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে নিয়ে গেছেন। তারপরও বিএনপির মতো বড় দল নেই এ নিয়ে বড়াই করার কিছু নেই। রাজনীতি ও নির্বাচনে জনগণ ফ্যাক্টর। জনগণই সব, জনগণ আমাদের শক্তি। ৫ আগস্ট জনগণ দেখিয়ে দিয়েছে তারা কি করতে পারেন। আমরা যদি ভুল করি জনগণ আবার একটা কিছু দেখিয়ে দেবে, তখন পস্তাতে হবে’।ইনকিলাব

 

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com
Website Design By Kidarkar It solutions