ট্রাম্পের ৫০ শতাংশ শুল্কারোপ: আতঙ্কে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ২৬ আগস্ট, ২০২৫
  • ১১ দেখা হয়েছে

ডেস্ক রির্পোট:- এক ভুতুড়ে নিরবতা তৈরি হয়েছে এন কৃষ্ণমূর্তির গার্মেন্ট কারখানায়। এটি ভারতের পোশাক রপ্তানির অন্যতম কেন্দ্র তিরুপ্পুরে অবস্থিত। মেঝেতে প্রায় ২০০টি ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেলাই মেশিনের মধ্যে কাজ করছে মাত্র কিছু লোক।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটা বৃহত্তম রিটেল (খুচরা) বিক্রেতার জন্য মৌসুমের শেষ অর্ডারের কাজ করছেন কর্মীরা। ওই অর্ডার শিশুদের পোশাক তৈরির।

ওই ঘরের এক প্রান্তে, নতুন ডিজাইনের জন্য কাপড়ের নমুনার স্তূপে ধুলো জমছে যার নেপথ্যে রয়েছে ভারতের ওপর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আরোপ করা ৫০ শতাংশ বাণিজ্য শুল্ক। এই শুল্ক বুধবার থেকে কার্যকর হওয়ার কথা।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক, চিংড়ি এবং রত্ন ও গহনাসহ বিভিন্ন পণ্যের প্রধান রপ্তানিকারক দেশ ভারত। বাণিজ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, রাশিয়ার তেল ও অস্ত্র কেনার জন্য ২৫ শতাংশ জরিমানাসহ এই চড়া শুল্ক চাপানোটা ভারতীয় পণ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারিরই সমান।

এই অনিশ্চিত পরিস্থিতি ব্যবসায়ী এবং তাদের জীবিকার উপর কীভাবে প্রভাব ফেলছে তা খতিয়ে দেখতে ভারতের প্রধান রপ্তানি কেন্দ্রগুলো ঘুরে দেখেছে বিবিসি সংবাদদাতারা।

‘টার্গেট’, ‘ওয়ালমার্ট’, ‘গ্যাপ’ এবং ‘জারা’-র মতো ব্র্যান্ডের জন্য ১৬ বিলিয়ন ডলার (১৬০০ কোটি ডলার) মূল্যের যে ‘রেডি-টু-ওয়্যার’ পোশাক রপ্তানি করে ভারত, তার তৃতীয়াংশ তৈরি হয় এই তিরুপ্পুরে। কিন্তু এই মুহূর্তে নিজেদের ভবিষ্যতে নিয়ে উদ্বিগ্ন এই শহর।

কৃষ্ণমূর্তি জানিয়েছেন, তার ক্লায়েন্টরা (গ্রাহকরা) সমস্ত অর্ডার বন্ধ করে দিয়েছে। তার কথায়, ‘সেপ্টেম্বরের পর থেকে আর কিছু করার থাকবে না।’

ব্যবসা বাড়ানোর পরিকল্পনা ছিল এই ব্যবসায়ীর। তার জন্য নতুন কর্মী নিয়োগও করেছিলেন। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে শুল্ক আরোপের পর সেই পরিকল্পনা তাকে স্থগিত রাখতে হয়েছে। নতুনভাবে নিযুক্ত ২৫০ জন কর্মীকে বসিয়ে রাখতে হয়েছে।

পরিস্থিতিকে আর বেগতিক করে তুলেছে এই ঘোষণার সময়। ক্রিসমাসের কথা মাথায় রেখে বার্ষিক রপ্তানির প্রায় অর্ধেক কাজই এই সময়ের মধ্যে হয়ে যায়।

এই পরিস্থিতিতে টিকে থাকার জন্য গার্মেন্টস তৈরির ইউনিটগুলোদেশীয় বাজার এবং দীপাবলির মৌসুমের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

তিরুপ্পুরের আরও একটা কারখানা ঘুরে দেখেছি আমরা। সেখানে অন্তর্বাস তৈরি করা হয়।

ওই কারখানায় প্রায় এক মিলিয়ন ডলারের (১০ লাখ ডলার) ইনভেন্টরি (মাল মজুত) রয়েছে যা আসলে মার্কিন স্টোরের জন্য বরাদ্দ ছিল। কিন্তু এখন এগুলো কেনার কেউ নেই।

ওই কারখানার মালিক শিবা সুব্রামণিয়ম বলেছেন, ‘আমরা আশা করেছিলাম ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি করবে। গত মাসে পুরো প্রোডাকশন চেন আটকে যায়। এইভাবে চলতে থাকলে কর্মীদের কীভাবে বেতন দেবো?’

যে শার্ট মার্কিন বাজারে কিনতে হলে এক সময় ১০ ডলার দিতে হতো, ৫০ শতাংশ শুল্ক চাপানো হলে, তার দাম বেড়ে দাঁড়াবে ১৬.৪ ডলার। এই দাম চীন থেকে আসা ১৪.২ ডলার, বাংলাদেশ থেকে ১৩.২ ডলার বা ভিয়েতনামের ১২ ডলারে শার্টের দামের চেয়ে বেশি।

এমনকি এই শুল্ক যদি কমিয়ে ২৫ শতাংশও করা হয়, তাহলেও এই সেক্টরে এশিয়ার অন্যান্য ‘খেলোয়াড়দের’ তুলনায় ভারত প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে থাকবে।

বাণিজ্য শুল্কের এই আঘাতের কথা মাথায় রেখে সরকার কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। যেমন কাঁচামালের ওপর আমদানি শুল্ক স্থগিত করা হয়েছে। অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্য বিষয়ক আলোচনাও গতি পেয়েছে।

তবে অনেকে আশঙ্কা করছেন ইতোমধ্যে বেশ দেরি হয়ে গেছে এবং চড়া বাণিজ্য শুল্ক আরোপের ফলে ভারতের ওপর যে প্রভাব পড়তে পারে, তার তুলনায় এই পদক্ষেপ কিছুই না।

‘গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ’-এর অজয় শ্রীবাস্তব বলেন, ‘অনুমান করা যায় যে এবার মার্কিন ক্রেতারা মেক্সিকো, ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশের দিকে ঝুঁকবেন।’

প্রায় ১,২০০ কিলোমিটার (৭৪৫ মাইল) দূরে, মুম্বাইয়ের এক এক্সপোর্ট জোন-এ শত শত কর্মীরা হীরা পালিশ এবং প্যাকিংয়ের কাজে ব্যস্ত। ভারতের ১০ বিলিয়ন (১০০০ কোটি ডলার) ডলারের রত্ন ও অলংকার রপ্তানি বাণিজ্যেরই একটা অংশ এটা।

কিন্তু এখানকার জুয়েলারি ব্র্যান্ডগুলো সেপ্টেম্বর এবং অক্টোবর মাসে তাদের বিক্রির ওপর শুল্কের সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন।

এই সময় যখন তিন থেকে চার বিলিয়ন ডলার (৩০০-৪০০ কোটি ডলার) মূল্যের গয়না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়।

যুক্তরাজ্য এবং অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ভারতের নতুন বাণিজ্য অংশীদারিত্ব সুযোগ তৈরি করলেও, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিজেদের উপস্থিতি গড়ে তোলার জন্য বছরের পর বছর ধরে ব্যবসায়ীরা যে চেষ্টা চালিয়েছেন তা কয়েক মাসের মধ্যেই বিফলে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন করছেন ক্রিয়েশন জুয়েলারির মালিক আদিল কোতওয়াল। তার দোকানের ৯০ শতাংশ হীরার গয়না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি হয়।

মাত্র তিন থেকে চার শতাংশের মার্জিনে কাজ করেন তিনি। তাই ১০ শতাংশের অতিরিক্ত শুল্কও টিকিয়ে রাখা তার পক্ষে কঠিন।

কোতওয়াল বিবিসিকে বলেন, ‘এই শুল্ক কার পক্ষে বহন করা সম্ভব? এমনকি মার্কিন রিটেলারও (তা করতে) সক্ষম হবে না।’

তিনি প্রতিবেশী গুজরাত রাজ্যের সুরাট থেকে হীরা সংগ্রহ করেন। সুরাট হলো বিশ্বের হীরা কাটা ও পালিশের হাব।

বিশ্বব্যাপী চাহিদা হ্রাস এবং ল্যাব-উৎপাদিত হীরার সঙ্গে প্রতিযোগিতার কারণে শুল্ক আরোপের অনেক আগে থেকেই সেখানে একটা সংকট তৈরি হচ্ছিল। বর্তমান আবহে দ্বিগুণ ক্ষতির মুখে এই হাব।

মার্কিন গ্রাহকরা উধাও হয়ে গেছেন। এর ফলে প্রায় পাঁচ মিলিয়ন (৫০ লাখ) মানুষের রুজি রোজগারের উৎস ওই কারখানাগুলোতে মাসের মাত্র ১৫ দিন কাজ রয়ে গেছে। চুক্তিতে থাকা শত শত কর্মীকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ছুটিতে পাঠানো হয়েছে।

সুরাটের উপকণ্ঠে একটা আবছা আলোয় ভরা হীরা পলিশিং ইউনিটের ভেতরে ধুলোয় ঢাকা টেবিলের সারি। সেগুলো আর ব্যবহার হচ্ছে না। নীরবতা বিরাজ করছে সেখানে। কোথাও ভাঙা সিপিইউ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে।

একজন কর্মী বলেন, ‘এই জায়গাটা এক সময় গমগম করত। সম্প্রতি অনেক লোককে চাকরি থেকে সরানো হয়েছে। জানি না আমাদের কী হবে।’

এই ইউনিটটা তৈরি করেছিলেন শৈলেশ মাঙ্গুকিয়া। এক সময় ৩০০ জন কর্মী নিযুক্ত করেছিলেন তিনি। সেই সংখ্যা এখন কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৭০ জনে। প্রতি মাসে পালিশ করা হীরার সংখ্যা ২০০০ থেকে কমে এখন ৩০০-এ এসে ঠেকেছে।

স্থানীয় ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের একজন ভাবেশ টাঙ্ক। তিনি বলেছেন, এখানকার কর্মীদের ‘মজুরি কমেছে, তাদের জোর করে ছাড়ানো হচ্ছে। তাদের মাসিক আয় কমছে।’

এর প্রভাব পড়েছে চিংড়ি চাষের ক্ষেত্রেও। যারা চিংড়ির চাষ করেন, মার্কিন শুল্কের আরোপের পর তাদের অনেকেই অন্য দিকে ঝুঁকছেন।

ভারত বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম চিংড়ি রপ্তানিকারক দেশ এবং তাদের কাছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রধান বাজারের একটা।

অন্যান্য শুল্ক মিলিয়ে চিংড়ির ওপর মোট শুল্ক এখন ৬০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। প্রথম দফায় শুল্ক প্রথম ঘোষণার পর চিংড়ির দাম প্রতি কেজি ০.৬২ থেকে ০.৭২ ডলার কমেছে।

শুধু তাই নয়, বাণিজ্য শুল্ক ৫০ শতাংশ কার্যকর হলে ওই মূল্য আরও কমবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

থোটা জগদীশ নামে একজন রপ্তানিকারক বিবিসিকে বলেছেন, ‘ক্রিসমাস এবং নতুন বছরের বিক্রির জন্য প্রস্তুত মার্কিন ক্রেতাদের কাছে এটা শীর্ষ মৌসুম। সবে চাষিরা নতুন চক্র শুরু করেছেন। তার মাঝে ট্রাম্পের এই শুল্ক বড় ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। আমরা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না।’

হ্যাচারি অপারেটররা জানিয়েছেন, এই কারণে তারা চিংড়ির লার্ভা উৎপাদনও উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দিয়েছে।

বীরভসরম শহরের শ্রীমাননারায়ণ হ্যাচারিজের এম এস ভার্মা বলেন, ‘আগে আমরা বছরে গড়ে ১০০ মিলিয়ন (১০ কোটি) চিংড়ির লার্ভা উৎপাদন করতাম। এখন আমরা ৬০-৭০ মিলিয়ন (ছয়-সাত কোটি)-এও পৌঁছতে পারছি না।’

এর ফলে প্রত্যক্ষভাবে অর্ধ মিলিয়ন (পাঁচ লাখ) চিংড়ি চাষি এবং পরোক্ষভাবে আরও ২.৫ মিলিয়ন (২৫ লাখ) চাষির জীবিকার ওপর প্রভাব পড়তে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে।

যে দেশে ইতোমধ্যে কর্মসংস্থান তৈরির সমস্যার সঙ্গে লড়ছে, সেখানে এই পরিসংখ্যান কিন্তু উদ্বেগজনক।

আপাতত ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অচলাবস্থা অব্যাহত রয়েছে। বাণিজ্য শুল্কের বিষয়ে আলোচনার পরিবেশ বিগত সপ্তাহগুলোতে উল্লেখযোগ্যভাবে খারাপ হয়েছে।

চলতি সপ্তাহে দিল্লিতে শুরু হতে যাওয়া সর্বশেষ দফার বাণিজ্য বিষয়ক আলোচনা বাতিল করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

মার্কিন কর্মকর্তারা ভারতের আরও সমালোচনা করেছেন। তাদের অভিযোগ, ভারত বেইজিংয়ের সঙ্গে ‘ঘনিষ্ঠতা’ বাড়াচ্ছে এবং রাশিয়ার জন্য ‘লন্ড্রোম্যাট’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ ভারত রাশিয়ার ইশারা অনুযায়ী চলছে বলে বোঝাতে চেয়েছেন তারা।

এশিয়া গ্রুপের অ্যাডভাইজরি নামক সংস্থার তরফে গোপাল নাদুর বিবিসিকে বলেন, ‘ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনার ভবিষ্যৎ এখন নির্ভর করছে ট্রাম্প প্রশাসনের অগ্রাধিকার, অভ্যন্তরীণ অগ্রাধিকার এবং রাশিয়া ও চীনের সম্পর্কিত বিষয়গুলোর ওপর।’

‘ভারতের নীতিনির্ধারক এবং ব্যবসায়ী নেতাদের কাছে এই মুহূর্তে উপায় হলো আত্মনির্ভরতা বাড়ানো, বৈচিত্র্যময়তা আনা এবং সব রকম উপায়কে কাজে লাগানো।’ সূত্র: বিবিসি বাংলা

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com
Website Design By Kidarkar It solutions