অদিতি করিম:- জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। নানা সংশয় সন্দেহের পরও অন্তর্বর্তী সরকারের সব পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঘোষিত সময়সূচির মধ্যে নির্বাচন হবেই। এই নির্বাচনের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও ইতিবাচক আগ্রহ লক্ষণীয়। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচন এবং একটি গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে বেশ তৎপর।
মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বিএনপি ছাড়াও অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর নিয়মিত বৈঠক হচ্ছে। এসব বৈঠক যে নির্বাচনকেন্দ্রিক তা সহজেই বোঝা যায়। আগামী নির্বাচন বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে দীর্ঘ ১৫ বছরের অপশাসনের পর এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশে একটি গণতান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থা চালু হবে, জবাবদিহি এবং স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠিত হবে—এটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা।
দুর্নীতিমুক্ত একটি বাংলাদেশ বিনির্মাণের কাজ শুরু হবে, এটি সবাই প্রত্যাশা করে। তবে মনে রাখতে হবে, আমাদের কাঙ্ক্ষিত নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে আগামী নির্বাচন হবে সূচনামাত্র। নির্বাচনের পরই শুরু হবে রাষ্ট্র মেরামতের আসল কাজ। সে ক্ষেত্রে ’২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের মতোই রাজনৈতিক দলগুলোকে কিছু মৌলিক বিষয়ে একমত থাকতে হবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মত ও পথের পার্থক্য থাকবে। যেমন—বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে বিরোধ রয়েছে। জুলাই সনদ নিয়ে বিএনপির সঙ্গে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মতপার্থক্য রয়েছে। কিন্তু মৌলিক প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য জরুরি। না হলে আবার আমরা সেই তিমিরেই চলে যাব।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত এক বছরে বাংলাদেশের যে সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচিত হওয়ার কথা ছিল, তা হয়নি। বরং আমরা নতুন শঙ্কার মধ্যে প্রবেশ করেছি। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সংকট হিসেবে সামনে এসেছে সন্ত্রাস এবং চাঁদাবাজি। এই চাঁদাবাজির কারণে মব সন্ত্রাস হচ্ছে। সারা দেশে আমরা দখল বাণিজ্য দেখছি। লুটপাট, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটছে। চাঁদাবাজি যেন একটি মহামারির মতো সারা দেশকে গ্রাস করে ফেলছে। আমরা যদি এই চাঁদাবাজি প্রতিরোধ করতে না পারি, তাহলে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন বিলীন হয়ে যাবে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিভিন্ন সময় চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলছে। বিএনপির পক্ষ থেকে বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীকে সন্ত্রাস এবং চাঁদাবাজির অভিযোগে বহিষ্কার করা হয়েছে। এনসিপি ও জামায়াতও চাঁদাবাজির অভিযোগে কয়েকজনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। কিন্তু এসব শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পরও চাঁদাবাজি বন্ধ হয়নি। বন্ধ হয়নি মব সন্ত্রাস, দখল বাণিজ্য। চাঁদাবাজির ব্যাপকতা এমন হয়েছে যে রাস্তার ফুটপাত থেকে শুরু করে করপোরেট হাউস পর্যন্ত এর দৌরাত্ম্য এখন বিস্তৃত। বিভিন্ন রাজনৈতিক পরিচয়ের ব্যক্তিরা বিভিন্ন অফিস-আদালতে গিয়ে এখন প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি করছে। চাঁদা না দিলেই সেখানে শুরু হচ্ছে মব সন্ত্রাস। মিথ্যা হয়রানিমূলক হত্যা মামলা দায়ের করা হচ্ছে। নানা রকমভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। চাঁদা না দিয়ে এ দেশে যেন এখন বাঁচাই কঠিন।
শুধু যে রাজনৈতিক দলগুলোই চাঁদাবাজি করছে এমনটি নয়। রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি চাঁদাবাজি প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে প্রশাসনের লোকজন। সাম্প্রতিক সময়ে একজন উপদেষ্টার প্রেস সচিবের বিরুদ্ধ চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠেছে। এই ছাত্র উপদেষ্টার বিরুদ্ধেও চাঁদাবাজির অভিযোগ তুলেছেন অন্য আরেকজন গ্রেপ্তারকৃত চাঁদাবাজ। কিন্তু এসব নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের এক ধরনের নীরবতা সবাইকে হতবাক করে দিয়েছে। ছাত্র উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম একজন বীর যোদ্ধা, সেনাপতি। তিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম তাঁর ব্যক্তিগত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ছয় শ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে, যে বিষয়ে তদন্তের অগ্রগতি নেই। তার রেশ কাটতে না কাটতেই আবার তাঁর প্রেস সচিবের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। মনে রাখতে হবে, উপদেষ্টাদের প্রেস সচিব থাকে না, তাঁদের থাকে জনসংযোগ কর্মকর্তা। তাহলে একজন উপদেষ্টা প্রেস সচিব রাখলেন কিভাবে, কোন কর্তৃত্ব বলে? সেটাও যেমন প্রশ্ন, তেমনি এই ধরনের প্রেস সচিবরা প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি করছেন কিভাবে? এসব প্রশ্নের কোনো আনুষ্ঠানিক উত্তর নেই সরকারের পক্ষ থেকে, উপদেষ্টার পক্ষ থেকেও।
কিছুদিন আগে গুলশানে একজন সাবেক এমপির বাসায় চাঁদাবাজি করতে গিয়ে ধরা পড়েন জুলাই ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন নেতা। তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, জেলে পাঠানো হয়েছে। তাঁদের পক্ষ থেকে আবার অভিযোগ করা হয়েছে, আসিফ মাহমুদকে চাঁদার ভাগ দিতে হয়। আসিফ মাহমুদ যদিও প্রতিবাদ করেছেন। তিনি বলেছেন, তিনি তাঁদের ঠিকমতো চেনেন না। কিন্তু বাস্তবতা হলো—তিনি চিনুন বা না চিনুন, এ ধরনের ঘটনা অনাকাঙ্ক্ষিত এবং দুর্ভাগ্যজনক। আমরা দেখছি যে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি এখন যেন ওপেন সিক্রেট ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। থানায় চাঁদাবাজি হচ্ছে। কয়েক লাখ ব্যক্তির বিরুদ্ধে মিথ্যা হয়রানিমূলক হত্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। এসব হত্যা মামলার যাঁরা আসামী, তাঁদের কাছ থেকে পুলিশ চাঁদাবাজি করছে। বলা হচ্ছে, পুলিশ আকার্যকর, পুলিশ নিষ্ক্রিয়, পুলিশ আইন-শৃঙ্খলা দমন করতে পারছে না, পুলিশের মনোবল ভেঙে গেছে, কিন্তু চাঁদাবাজির ক্ষেত্রে পুলিশের একাংশের মনোবল ঠিকই চাঙ্গা। এ রকম অভিযোগও আছে, মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে অনেক পুলিশ সদস্য চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন।
পুলিশ ছাড়াও সরকারি অফিস-আদালতগুলোতে ঘুষের রেট বেড়ে গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে ভুক্তভোগী একজন ব্যবসায়ী বলছিলেন, আগে যেখানে ঘুষ দিতে হতো এক লাখ টাকা। এখন দিতে হয় পাঁচ লাখ টাকা। যেকোনো সরকারি দপ্তরে এখন ঘুষ এবং চাঁদাবাজি ছাড়া কোনো কাজ হচ্ছে না। এগুলো প্রতিরোধের জন্য যেন কেউ নেই।
রাজনৈতিক দলের কিছু বিপথগামী লোকজন উৎসব করে সিলেটের সাদা পাথর লুট করছে। এটিও এক ধরনের চাঁদাবাজি। তাদের প্রতিরোধ করার মতো কেউ ছিল না। বরং এই চাঁদাবাজি ও লুটের উৎসবে প্রশাসনও যুক্ত হয়েছিল। প্রশাসন, রাজনৈতিক দলগুলো মিলেমিশে যেন চাঁদাবাজি করেছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বারবার বলছেন, চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। বিএনপি দলের ভেতর শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করছে। চার হাজারের বেশি বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার পরও চাঁদাবাজদের থামানো যায়নি।
সামনে নির্বাচন। ব্যবসায়ীসহ সাধারণ নাগরিকরা উদ্বিগ্ন, আতঙ্কিত। নির্বাচনে যে রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে, তারা হয়তো আবার নতুন মাত্রায় চাঁদাবাজি শুরু করবে। ব্যবসায়ীদের কাছে গিয়ে তাদের জিম্মি করে, ভয় দেখিয়ে চাঁদাবাজি করবে। অনেকে হয়তো নির্বাচনের খরচের নামে চাঁদাবাজি করবে। এই ‘খরচ’ না দিতে পারলে তাঁদের ওপর নেমে আসবে নতুন করে অত্যাচার, নির্যাতন। তাঁদের হয়তো আবার নতুন করে হয়রানি করা হবে। ফ্যাসিবাদের দোসর ট্যাগ লাগিয়ে নাজেহাল করা হবে।
সব রাজনৈতিক দল মুখে বলছে তারা চাঁদাবাজদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয় না। চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে তারা কঠোর অবস্থানে থাকবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, চাঁদাবাজরা দলীয় ছত্রচ্ছায়াতেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে নির্বিঘ্নে অবাধে চাঁদাবাজি করছে। এবার নির্বাচনে তাই রাজনৈতিক দলগুলোকে একটা অঙ্গীকার করতে হবে। চাঁদাবাজ যেই হোক না কেন, তাকে বর্জন করতে হবে। নির্বাচনে তারা কী পরিমাণ খরচ করবে সেটি স্বচ্ছতার সঙ্গে বলতে হবে। কোনো ব্যবসায়ী, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে জোর করে টাকা আদায় করে নির্বাচন করা যাবে না। যদি কোনো রাজনৈতিক দল কোনো ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান বা শিল্পপতি বা কারো কাছ থেকে অনুদান নেয়, সেটি প্রকাশ্যে নিতে হবে। বিশ্বের বহু দেশে এ রকম নিয়ম আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনের তহবিলে চাঁদা দেওয়া বৈধ। সেই অনুদানের তথ্য প্রকাশ করা হয়। আমরা দেখেছি, বিগত নির্বাচনে ইলন মাস্ক ট্রাম্পকে বিপুল পরিমাণ অনুদান দিয়েছিলেন। সেটি তিনি আনুষ্ঠানিক ঘোষণার মাধ্যমে দিয়েছিলেন। অন্য ব্যবসায়ীরাও আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তিকে চাঁদা দেন। স্বেচ্ছায় যখন কোনো ব্যক্তি কোনো রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনের জন্য কোনো সহায়তা করেন, সেটি দোষের নয়। কিন্তু গোপনে জোর করে যদি কারো কাছ থেকে অর্থ আদায় করা হয়, সেটি অপরাধ। ইউরোপে এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও এখন ঘোষণা দিয়ে অনুদান দেওয়ার চল রয়েছে। অনুদান এবং চাঁদাবাজি এক জিনিস নয়, এই বাস্তবতা উপলব্ধি করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি বিভিন্ন ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তির কাছ থেকে অনুদান গ্রহণকে স্বীকৃতি দেয় এবং তারা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে তা গ্রহণ করে তাহলে চাঁদাবাজির পথ বন্ধ হবে। কিন্তু যখনই এটি গোপনীয়ভাবে হবে, তখনই তার মধ্যে থাকবে অস্বচ্ছতা। এমনিতেই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এখন বেশ খারাপ। ব্যবসায়ীরা নানা চাপে এবং আতঙ্কে। তাঁরা হাত-পা গুটিয়ে বসে আছেন। তাঁরা কোনো বিনিয়োগ করছেন না। এর মধ্যে এক বছর ধরে বেশুমার চাঁদাবাজি হয়েছে। এখন যদি নতুন করে নির্বাচনকেন্দ্রিক চাঁদাবাজির উৎসব শুরু হয়, তাহলে অর্থনীতি ভেঙে পড়বে। নতুন সরকার সেই অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার করতে পারবে না। কাজেই নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দল তার নির্বাচনী ইশতেহারে অন্তত একটি অঙ্গীকার করুক, তারা কেউ চাঁদাবাজি করবে না, দখল বাণিজ্য করবে না, লুটেরাদের প্রশ্রয় দেবে না। পাশাপাশি যে যার কাছ থেকে রাজনৈতিক দল পরিচালনার জন্য অনুদান নেবে, সেই অনুদানের ঘোষণা প্রকাশ্যে দেবে। আমরা সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য যদি এ রকম একটি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারি, তাহলেই বাংলাদেশে দুর্নীতি, বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি এবং লুটতন্ত্র বন্ধের সূচনা হবে। আমরা কি সেই সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে পারব?
লেখক : নাট্যকার ও কলাম লেখক
ই-মেইল: auditekarim@gmail.com